দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকেই জীবিকানির্বাহের তাগিদে তাঁদের ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। তিন মাসে পোশাককর্মীরা ব্যাংকে থাকা তাঁদের আমানত থেকে ৩০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। আবার অনেকেই তাঁদের ব্যাংক হিসাবে মাসে যে পরিমাণ টাকা জমা রাখতেন, সেটা রাখছেন না। তাতে ব্যাংকে পোশাককর্মীদের আমানতের পরিমাণ কমছে।
এদিকে পোশাককর্মীদের আন্দোলনের মুখে গত বছরের শেষ দিকে নতুন মজুরিকাঠামো ঘোষণা করেছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সদ্য বিদায়ী ২০২৩ সালের জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে পোশাকশ্রমিকদের ৯ লাখ ৩ হাজার ৭৫৩টি ব্যাংক হিসাবে সর্বমোট জমা ছিল ৩০০ কোটি টাকা। এর আগের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে যা ছিল ৩৩০ কোটি টাকা। ওই প্রান্তিকে হিসাবসংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৭৩ হাজার ৫০৩টি। অর্থাৎ তিন মাসে পোশাকশ্রমিকদের হিসাবসংখ্যা বাড়লেও আমানত কমেছে ৩০ কোটি টাকা বা ৯ শতাংশ।
এ নিয়ে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, বিদায়ী বছরে মূল্যস্ফীতি বেশি থাকার কারণে শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাবে টাকা কমতে পারে। কারণ, এ রকম সময়ে অনেকেই জমানো টাকা তুলে ফেলেন। আবার নতুন করে সঞ্চয় করতে পারেন না। এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান করোনার সময় থেকে ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে বেতন দেওয়া শুরু করলেও এখন সেই প্রবণতা কমছে। আমানত কমার ক্ষেত্রে এর প্রভাবও থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
সদ্যসমাপ্ত ২০২৩ সালে খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত এক দশকের মধ্যে রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, এই বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে দেশে গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৭ শতাংশ, যা জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আর জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের আগস্ট মাসে তো দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক লাফে ১২ শতাংশ অতিক্রম করে। ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে ওই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে ওঠে।
২০২৩ সালে খাদ্য মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি সার্বিক মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও রেকর্ড হয়েছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত দেশে টানা ৯ মাস সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। এর আগে মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির উত্তাপ ছিল সবচেয়ে বেশি। ওই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠেছে, যা ১৩৪ মাস বা ১১ বছর ২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১২ সালের মার্চে ১০ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল সার্বিক মূল্যস্ফীতি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্রমিকদের সঞ্চয় ভাঙার অন্যতম কারণ হলো জীবনযাত্রার অত্যধিক ব্যয়। আমরা গবেষণায়ও দেখেছি, দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির যে চিত্র প্রকাশ পায়, তার থেকেও পোশাককর্মীরা যেসব এলাকায় থাকেন, সেখানে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও তীব্র। তাঁদের বেতন কিছুটা বেড়েছে বটে, তবে সেটাতেও তাঁদের ওপর চাপ কতটা কমবে তা দেখার বিষয়।’
এদিকে মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে ২০২৩ সালের শুরু থেকে তৈরি পোশাক খাতের কর্মীদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি জোরালো হতে শুরু করে। ফলে গত এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শ্রম মন্ত্রণালয় মজুরি বোর্ড গঠন করে।
অক্টোবরে বোর্ডের চতুর্থ সভায় মালিকপক্ষ পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাব করেন ১০ হাজার ৪০০ টাকা, যা শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধির প্রস্তাবের প্রায় অর্ধেক। এর পরদিনই শ্রমিকেরা আন্দোলনে নামেন। একপর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় মালিকপক্ষ নতুন করে প্রস্তাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ৭ নভেম্বর মালিকপক্ষের প্রতিনিধি আগের প্রস্তাবের চেয়ে ২ হাজার ১০০ টাকা বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেন। সেটিই পরে চূড়ান্ত হয়। ১ ডিসেম্বর থেকে নতুন এই মজুরিকাঠামো কার্যকর হয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা তুলে নেওয়া যে দ্রব্যমূল্যের প্রভাবে হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা যখন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁরা বারবার এটা বলেছেন যে খাবার কিনতেই হিমশিম খাচ্ছেন। শ্রমিকেরা যে শুধু তাঁদের সঞ্চয় ভেঙেছেন তা–ই নয়, ওই সময়ে বেতন বৃদ্ধি না পাওয়ায় তাঁদের অনেকে ধারদেনা করেও চলেছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, পোশাকশ্রমিকদের ৯ লক্ষাধিক ব্যাংক হিসাবে ২০২৩ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে গড়ে জমা ছিল ৩ হাজার ৩২৩ টাকা, যা এর আগের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ছিল ৩ হাজার ৭৭৯ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২১ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিক থেকে শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য প্রকাশ করে আসছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, তখন ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬০টি ব্যাংক হিসাবের বিপরীতে মোট আমানত ছিল ২০৪ কোটি টাকার বেশি। তখন একজন শ্রমিকের ব্যাংক হিসাবে গড়ে জমা ছিল ৪ হাজার ১৪৫ টাকা। সে অনুযায়ী এখন শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাবে গড় টাকার পরিমাণ কমেছে।
বিদায়ী বছরের অক্টোবর মাসে সিপিডি এক পর্যবেক্ষণে জানায়, তখনকার বাজার পরিস্থিতিতে একটি শ্রমিক পরিবারের প্রয়োজনীয় খাবারের খরচ মাসে ১৬ হাজার ৫২৯ টাকা। আর খাদ্যবহির্ভূত খরচ ১২ হাজার ৮৮২ টাকা। একেকটি শ্রমিক পরিবারের গড় সদস্য ৩ দশমিক ৭ জন। এর মধ্যে উপার্জনক্ষম সদস্য ২ জন। সেই হিসাবে শ্রমিকের মাসিক নিম্নতম মজুরি ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা হওয়া প্রয়োজন।
এর আগে মার্চ মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি ঢাকা শহরের চারজনের একটি পরিবারের প্রতি মাসে খাবারের পেছনেই ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা খরচ হয় বলে জানিয়েছিল। তখন সিপিডি আরও জানায়, একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মোট আয়ের ৬০ শতাংশই খরচ করতে হয় খাবারের জন্য।
প্রথম আলো