ব্যাংকের টাকা যাচ্ছে কই

  • মো: হারুন-অর-রশিদ
  •  ০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:১৫
অনেকে এখন ব্যাংকে টাকা রাখতেও ভয় পাচ্ছেন। – প্রতীকী ছবি

গরিবের কোমরে দড়ি বাঁধলেও জামাই আদর ঠিকই পাচ্ছে কোটিপতি। বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা বর্তমান গণতন্ত্রহীন রাজনৈতিক সিস্টেমের মতোই স্বৈরাচারী বা একপেশে। এখানেও যারা শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করে না তাদের জন্য কিছু দিন পরপরই ঋণ মওকুফের দারুণ সব অফার এসে হাজির হয়। তারপরও তারা সেই ঋণ পরিশোধ করে না। এর দায়ে কোনো আইনি জটিলতা তাদের হাতে বা কোমরে দড়ি বাঁধতে পারে না। যত সব আইন-আদালত ওই বেটা গরিবের জন্য। ব্যাংকের ঋণ তুলে পরিশোধে বিলম্ব হলে আর যায় কোথায়, হাতে দড়ি বেঁধে চৌদ্দ শিকের ভাত খাইয়ে ভিটেমাটি নিলামে তুলে ছাড়বে। যাই হোক আইন বলে একটা কথা আছে না! আইনের প্রয়োগই যদি না হয় তাহলে সেই আইন তৈরি করে কী লাভ! যত প্রয়োগ ওই গরিবের ওপর দিয়েই হয়।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং অবস্থা খুবই নাজুক। নির্ভরতার জায়গাও আজ শূন্যের কোঠায়। অনেকে আজ ব্যাংকে টাকা রাখতেও ভয় পাচ্ছেন। তারা নিরাপদ মনে করছেন না। কয়েক দিন পরপর ব্যাংকিং খাতের বড় দুর্নীতি মানুষের মনে ভয়ের সঞ্চার করেছে। ব্যাংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, অনিয়ম হলে এর নেতিবাচক প্রভাব রাষ্ট্রকে বিপদের দিকে ধাবিত করে। কিন্তু আজকের সময়ে দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে- দেশে ব্যাংকিং খাতের প্রসার যেমন ব্যাঙের ছাতার মতো ঘটেছে তেমনি বেড়েছে এ খাতে অনিয়ম। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি থেকে শুরু করে বিসমিল্লাহ গ্রুপ, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, এটিএম কার্ড জালিয়াতিসহ ছোট-বড় নানা অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে হরহামেশা। ব্যাংকিং খাতে এসব ঘটনার বড় কারণ হলো, সুশাসনের অভাব। যারা অপরাধের সাথে জড়িত তাদের বিচার হয় না, এমনকি তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। আইন তাদের স্পর্শ করতে পারে না যার কারণে ব্যাংকিং খাতে একের পর এক কেলেঙ্কারি ঘটেই চলেছে।

রাষ্ট্রের পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা এতটাই দক্ষ যে, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা কোথাও পালিয়ে থাকলেও খুব সহজেই তাদের খুঁজে বের করে আনতে পারে। আবার কেউ ২০ বছর আগে মারা গেলেও বর্তমানে রাজপথের মিছিল-মিটিংয়ে তাদের ‘উপস্থিতি’ পুলিশের নজর এড়াতে পারে না। পুলিশও নাকি তাদের ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাতে ‘দেখে’ যার কারণে চৌকস পুলিশ আসামির তালিকায় তার নামটি সবার আগে দিয়ে দেয়। যে পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা ১০-২০ বছর আগে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিকে বর্তমান মিছিল-মিটিংয়ে শনাক্ত করতে পারে সেই একই পুলিশ বা গোয়েন্দা কেন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সাথে জড়িত, এমন একজনকেও এখন পর্যন্ত খুঁজে বের করতে পারেনি? আহা! কী তাদের দক্ষতা।

রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো দুর্নীতির কালো ছায়া ব্যাংকিং খাতকে ঢেকে ফেলার চেষ্টা করছে। দুঃখজনক হচ্ছে, ব্যাংকিং খাতের বড় বড় দুর্নীতি ও অনিয়মেরও কোনো বিচার হয় না। ফলে অপরাধপ্রবণতার মাত্রা বাড়ছেই। ব্যবসায়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ব্যাংক লুটের সাথে বেশি পরিমাণ জড়িত হচ্ছে এবং এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠানের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করছেন না। কোনো আইনও তাদেরকে স্পর্শ করতে পারছে না।

২০১৭ সালে অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি-ই (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) এক অর্থনৈতিক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে ব্যাংকিং খাতের বেহাল দশার কথা তুলে ধরেছিল। তাদের সেই প্রতিবেদনে অর্থনীতিতে সবচেয়ে দুর্বল দিক ছিল ব্যাংক ও আর্থিক খাত। তারা দেখিয়েছিল, এ খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১ শতাংশই খেলাপি। এর বড় অংশই আবার কুঋণ, যা আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। মোট বিতরণ করা ঋণে সরকারি ব্যাংকের অবদান ১৮ শতাংশ। কিন্তু কুঋণে সরকারি ব্যাংকের ‘অবদান’ ৪৫ শতাংশ। এ ছাড়া একের পর এক কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ছে। কিন্তু এর কোনো বিচার করা হয়নি বা কারা এর সাথে জড়িত তাও কখনো প্রকাশ করা হয়নি। এই সুযোগে জালিয়াত চক্র আরো বেশি সক্রিয় হয়ে ব্যাংক কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত হয়ে ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক অর্থ কেলেঙ্কারির এক মামলার শুনানিকালে বলেন, ‘আমরা তো মনে হয়, নাটক দেখছি। নাটক দেখে হাততালি ছাড়া আর তো কিছু দেয়ার নেই। হয় হাততালি দিতে হবে, না হয় বসে থাকতে হবে। জজ, আইনজীবী আর যে লাখ লাখ চোখ চেয়ে আছে, কেউ কোনো কাজ করতে পারছেন না। কেন সবাই নীরব? সব ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে- আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখব?’ হয়তো এটিই সত্য যে, কিছু দুর্বৃত্তের কারণে রাষ্ট্রীয় সব সম্পদ লুট হয়ে যাবে আর সবাইকে তা চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে। এ ছাড়া উপায় কী? যেখানে আইনের শাসন নেই, জবাবদিহির বালাই নেই, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নেই, সেখানে আর কী প্রত্যাশা করা যেতে পারে? শুধু অর্থনৈতিক খাতই নয়; পুরো সেক্টরে দুর্নীতি, দুঃশাসনের মহাকাব্য রচিত হচ্ছে। প্রতিরোধ করার কেউ নেই।

এরই মধ্যে গত ২৪ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘ইসলামী ব্যাংকে ‘ভয়ঙ্কর নভেম্বর’ শিরোনামে প্রকাশিত এক অনুসন্ধ্যানী রিপোর্ট জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ওই রিপোর্টে দেখানো হয়, ইসলামী ব্যাংক থেকে নভেম্বরে তুলে নেয়া হয়েছে দুই হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে দুই কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) থেকে দুই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে একটি অসাধু চক্র। একইভাবে বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকেও দুই হাজার ৩২০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে এ কোম্পানিগুলো। সব মিলিয়ে তিন ব্যাংকে সন্দেহজনক ঋণ সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। ফলে এ তিন ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদসহ দেনা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। ২৯ নভেম্বর নিউ এজ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়- ‘এস আলম গ্রুপ, একাই ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।’

একটি কোম্পানি এত টাকা লোন কিভাবে নিলো এই খবর কি বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা সরকার কেউই জানে না? এমন একটা সময় ব্যাংকের এই টাকাগুলো তুলে নেয়া হচ্ছে যখন দেশে ডলার সঙ্কট, টাকার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য ধরনা ধরছে সরকার। বাজেট সহায়তার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চাইছে। আজকে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে আসছে, তা হলো- সাধারণ গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গেলে কত ফরমালিটিজ মেনে চলতে হয়। কথায় কথায় তাদেরকে ব্যাংকের নিয়ম শুনিয়ে কুপোকাত করা হয়। অথচ ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে, তার কোনো হদিসই বাংলাদেশ ব্যাংক বা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ রাখছে না। দুর্নীতিবাজরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করে বিদেশের মাটিতে বাড়ি গাড়ি করছে। কিন্তু গরিবের সামান্য কিছু তো ব্যাংকেই রাখতে হয়; কিন্তু তার বেলায়ও তাদের জন্য রয়েছে নিরাশার সংবাদ। কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়িত বা বন্ধ হলে প্রত্যেক আমানতকারী সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পাবেন। ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো গ্রাহকের একাধিক অ্যাকাউন্টে এক লাখ টাকার বেশি থাকলেও তিনি সর্বোচ্চ এক লাখ টাকাই পাবেন। এমন বিধান অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয়েছে ‘আমানত সুরক্ষা আইন-২০২০’। কথায় আছে না, সব আইন কেবল গরিবের বেলায়। ব্যাংকের টাকা মহালুটের তাণ্ডবে গ্রাহকদের হয়তো এখন থেকে মিছিল তুলে জানতে হবে, হৈ হৈ রৈ রৈ, ব্যাংকের টাকা যাচ্ছে কই বলে।

রাষ্ট্রকে বাঁচানোর জন্য এখনই সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারী, ব্যাংকের টাকা লুটকারীরা যত বড় রুই-কাতলা হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আমাদের সবার উচিত রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করা। আজকে এটি প্রমাণিত সত্য, বড় বড় দুর্নীতিবাজের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় সব জায়গায় দুর্নীতির বিস্তার ক্ষিপ্রগতিতে বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা না পেলে জবাবদিহির জায়গাগুলো থাকে না। এই সুযোগে সরকারদলীয় নেতাদের মদদে বা যোগসাজশে সব অপকর্ম ঘটে থাকে। এখানে বিচারের বাণী নীরবে আর নিভৃতেই কাঁদে। কোমরে দড়ি আর লাল দেয়ালের ভয় শুধু গরিবের জন্য।

[email protected]