ব্যাংকিং খাতে নতুন যুগের সূচনা? কঠোর হচ্ছে আইন, ভাঙছে পুরোনো বলয়

দেশের ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে বড় ধরনের সংস্কার আসছে ব্যাংক কোম্পানি আইনে। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান এবং পরিচালনা পর্ষদে পারিবারিক আধিপত্য কমানোর উদ্যোগ। নতুন আইন কার্যকর হলে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একবার খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হলে নতুন করে কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ, এলসি বা গ্যারান্টি সুবিধা পাবে না।

প্রতীকী ছবি

প্রস্তাবিত সংশোধনীতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলোর একটি হলো ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’ চিহ্নিত করার ধারাটি বাতিল করা। ২০২৩ সালে এই ধারা যুক্ত করা হলেও এর জটিল ও বাস্তবতাবিবর্জিত প্রক্রিয়ার কারণে প্রায় দুই বছরে একজনকেও আনুষ্ঠানিকভাবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করেন, এই প্রক্রিয়া দুর্নীতির ঝুঁকিও তৈরি করেছিল। তাই এই ধারাটি বাদ দিয়ে খেলাপিদের বিরুদ্ধে প্রচলিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হচ্ছে।

ব্যাংকের পরিচালনা কাঠামোতেও আসছে বড় পরিবর্তন। পরিচালনা পর্ষদের সর্বোচ্চ সদস্য সংখ্যা ২০ থেকে কমিয়ে ১৫ জনে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকের কাছাকাছি, অর্থাৎ সাত বা আটজন থাকবেন স্বতন্ত্র পরিচালক, যা বর্তমানে সর্বোচ্চ তিন জন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে অবশ্যই স্বতন্ত্র পরিচালকদের মধ্য থেকে নির্বাচন করতে হবে। বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে পেশাদারত্ব বাড়াবে এবং শেয়ারহোল্ডারদের অযাচিত প্রভাব কমাবে।

একইসঙ্গে ব্যাংক পরিচালনায় পারিবারিক প্রভাব কমাতেও কঠোর হচ্ছে আইন। নতুন প্রস্তাবে এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ দুজন পরিচালক থাকতে পারবেন, যা আগে তিন জন ছিল। পাশাপাশি ‘পরিবার’-এর সংজ্ঞাও বিস্তৃত করা হয়েছে। এখন থেকে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান ও ভাই-বোনের পাশাপাশি শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়রাও পরিবারের সদস্য হিসেবে গণ্য হবেন, যা মূলত স্বজনপ্রীতি বন্ধ করার একটি প্রচেষ্টা। এছাড়া, পরিচালকদের পদে থাকার সময়সীমাও কমানো হচ্ছে। বর্তমানের টানা ১২ বছরের পরিবর্তে এখন থেকে একজন পরিচালক সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে মোট ৬ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।

নতুন আইনে ব্যবসায়িক গ্রুপের লাগামও টেনে ধরা হচ্ছে। এখন থেকে কোনো গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে, সেই গ্রুপের অন্য কোনো সহযোগী প্রতিষ্ঠানও আর ঋণ সুবিধা পাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. মো. নজরুল হুদা এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘খেলাপিকে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হিসেবে ভাগ করার কোনো বাস্তব মানদণ্ড নেই। এতে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হতো। নতুন সংশোধনী সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।’ তিনি আরও যোগ করেন, বোর্ডের আকার কমানোর চেয়ে যোগ্য ও পেশাদার ব্যক্তি নিয়োগ দেওয়াই বেশি জরুরি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে এই সংশোধনীর খসড়া প্রস্তুত করে পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদন দিয়েছে এবং বর্তমানে এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পর্যালোচনার জন্য রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে সেপ্টেম্বরের মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন করে ডিসেম্বরের মধ্যেই অধ্যাদেশ আকারে আইনটি জারি করার প্রস্তুতি চলছে। মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির শর্ত হিসেবে ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানোর তাগিদ থেকেই এই সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here