ব্যবহার এক চমৎকার শিল্প

  • মুহাম্মদ মিজানুর রহমান
  •  ২৩ আগস্ট ২০২৩, ০৬:১৭
ব্যবহার এক চমৎকার শিল্প – নয়া দিগন্ত

মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য কথা এক চমৎকার শিল্প। এ গুণে যে যত এগিয়ে, জ্ঞানের সঠিক ব্যবহারে পার্থিব সুবিধা সে তত সহজে নিজের করে নিতে পারে। সব কালেই মানুষ নিজের প্রতি অন্যকে মুগ্ধ করতে নানা কৌশল অবলম্বন করে আসছে। রপ্ত করেছে অলঙ্কারশাস্ত্র। কেউ কথাকে ছোট ও আকর্ষণীয় করে অন্যের সামনে উপস্থাপন করে। আবার কেউ কথার মধ্যে প্রকাশ করে সাহিত্যের অনুপম ব্যবহার। কেউবা কথামালাকে শ্রোতার উপযোগী করে তার মন জয় করে নেয়। উদ্দেশ্য একটাই, অন্যের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলা। কখনো কখনো মানুষ নিজের আলাপ-ব্যবহারে অন্যকে এমনভাবে প্রভাবিত করে, যে আকর্ষণবলয় থেকে সে কখনো বেরিয়ে আসতে পারে না। নিজের অগোচরে হয় সে তাকে আদর্শ বানিয়ে নেয়। অথবা প্রিয় বন্ধুর আসনে বসিয়ে দেয়। কী চমৎকার শক্তি এই কথায়!

এ ভালো গুণটি রপ্ত করতে নিজেকে সভ্য করতে হয়। কারণ সভ্য আচরণগুলো মানুষকে ভদ্র করে। এ জন্য জ্ঞান অর্জন করা অত্যাবশ্যক। তবে সেই জ্ঞান যেন সবসময় বিনয়পূর্ণ হয়ে থাকে। জ্ঞানের সাথে ভদ্রতার সংমিশ্রণ না ঘটলে তা কখনো অন্যের কাছে সমাদৃত হয়ে উঠে না। যে জ্ঞান মানুষের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন আনতে পারে না, সেই জ্ঞান মানুষকে খুব একটা প্রকাশযোগ্য করে তুলতে পারে না। তাই নিজের আচরণে নিজের প্রতিবিম্ব খোঁজার চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয় এবং সেটি ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য কাজে লাগাতে হয়। তাহলে সুবাসিত শব্দচয়ন, মার্জিত আচরণ, উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও জ্ঞানের উত্তম ব্যবহার সফলতার দিকে নিয়ে যাবে। পরিবেশ অনুযায়ী জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার করাই জ্ঞানীর কাজ। যে পরিবেশে জ্ঞান প্রতিবাদের দাবি, সেখানে মৌনতা কখনো জ্ঞানের বিনয়পূর্ণ আচরণ নয়।

আপনি নিজের মধ্যে আচরণিক পরিবর্তন সাধন করে চলছেন। আপনি একজন মানুষ, তবে সাধারণ মানুষের চেয়ে আপনার অবস্থান একটু উঁচুতে। এটি আপনার অহঙ্কারের বিষয় নয়, সংশোধনের সময়। এ সময় যদি আপনি অহমিকার জগতে প্রবেশ করেন, আপনার ধ্বংস অনিবার্য। আত্ম সংশোধনে চাইলে আপনি কনফুসিয়াসের উক্তিটি স্মরণে রাখতে পারেন- ‘অন্যের যে রকম ব্যবহারে নিজে বিরক্ত হও, অন্যের প্রতি ভুলেও সেরূপ ব্যবহার করো না।’ আপনি যখন এ আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন, মানুষের পক্ষ থেকে খুব কম অভিযোগ আপনার দিকে আসবে। সমাজে অন্যের চেয়ে অগ্রগামী হয়ে থাকলে সবাই যে আপনাকে ভালো বলবে না তা নয়। তবে কেউ মন্দ বললে তার কারণ শনাক্ত করুন। এবার কারণটি নিয়ে ভাবুন। যদি তা গ্রহণযোগ্য হয়, কালবিলম্ব না করে কাজটি পরিশুদ্ধ করে নিন।

আপনি অন্যের কাছে জনপ্রিয় হতে চাইলে আপনার আচরণ অবশ্যই পরীক্ষার সম্মুখীন করতে হবে। মনে রাখবেন, আপনি যখন মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠবেন, ক্রমে মানুষও আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবে। সুতরাং ভালো কাজের বিনিময় ভালো দিয়ে পরিশোধ করুন। মানুষের অনিষ্ট করা থেকে বিরত থাকুন। ভালো কাজকে কোনোভাবে অবজ্ঞা করবেন না। সে আপনার দৃষ্টিতে যত ক্ষুদ্র হোক না কেন। ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলো একদিন মানুষের জন্য অনেক বড় ফায়দা নিয়ে আসে। আপনার কথাকে মানুষের জন্য প্রশান্তিদায়ক করে উপস্থাপন করতে হবে। এমনভাবে কথা বলবেন না, যে কথা অন্যের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাহলে আপনার খুব প্রিয়ভাজনও একদিন আপনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।

কথা এমন এক শক্তি, যা অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। তাই কখনো কথাকে অন্যের জন্য বেদনাদায়ক করে তুলবেন না। কথার সৌন্দর্য হারিয়ে কথা বলবেন না। কথার আদব সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে- ‘অহঙ্কারবশে তুমি কখনো মানুষের জন্য তোমার গাল ফুলিয়ে রেখে তাদের অবজ্ঞা করো না। তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করো, অবশ্যই আওয়াজসমূহের মধ্যে সবচেয়ে অপ্রীতিকর আওয়াজ হলো গাধার আওয়াজ।’

ভালো ব্যবহার কেন করব? করব কারণ, আমরা যা কিছু করি সব কিছুর পেছনে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য থাকে। আপনার উদ্দেশ্য আপনাকে দু’ধরনের উপকার এনে দিতে পারে- ১. আপনি দুনিয়ায় এর প্রতিদান পাবেন; ২. দুনিয়ার পাশাপাশি আপনি পরকালেও এর দ্বারা লাভবান হবেন। যদি আপনার কাজগুলো আল্লাহকে খুশি করার জন্য হয়ে থাকে, তাহলে আপনি উভয় ফায়দা পেয়ে যাবেন। সুতরাং নিজের ইচ্ছেকে মজবুত করুন। নড়বড়ে ভিত্তির ওপর কখনো নিজের সংকল্প দাঁড় করাবেন না।
আপনি যদি আপনার ব্যবহারকে মানবিক করে গড়ে তুলতে পারেন, আপনার এ পরিশ্রম কখনো মূল্যহীন হয়ে পড়বে না। আল্লাহ কখনো মানুষকে তার কাজের প্রতিদান থেকে বঞ্চিত করেন না। সুতরাং আচরণকে একান্ত নিজের জন্য করে নিন। এডওয়ার্ড জনের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করতে চাই- ‘মৃত্যুর পরে যার জন্য মানুষ মানুষের হৃদয়ে অম্লান হয়ে থাকে সে হচ্ছে তার ব্যবহার।’ আসুন সেই ব্যবহার দিয়ে জীবন সাজাই।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও গল্পকার