ব্যবসা করার জন্য বাংলাদেশ থেকে আফগানিস্তান, মিয়ানমার বেশি উপযুক্ত: বিশ্বব্যাংক সূচক অনুযায়ী কারণগুলো কী?
বিশ্বব্যাংক পরিচালিত “ইজ অব ডুয়িং বিজনেস” অর্থাৎ সহজে ব্যবসা করার সূচকে আফগানিস্তান ও মিয়ানমারের থেকেও পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংকের ওই র্যাংকিংয়ে বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬তম।
অন্যদিকে আফগানিস্তানের অবস্থান ১৬৭তম এবং মিয়ানমার আছে ১৭১-এ।
একটি দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষুদ্র বা মাঝারি ব্যবসা চালু এবং সেটা পরিচালনা করা কতোটুকু সহজ বা কঠিন – সেই বিষয়গুলো কয়েকটি সূচকের আওতায় বিশ্বব্যাংক পরিমাপ করে।
একটি ব্যবসা শুরু থেকে পরিচালনা পর্যন্ত প্রয়োজনীয় ১০টি সূচকের উপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। সেগুলো হল: ব্যবসায় শুরু, নির্মাণের অনুমোদন নেয়ার প্রক্রিয়া, বিদ্যুতের সরবরাহ, সম্পত্তির নিবন্ধন, ক্রেডিট অর্জন, সংখ্যালঘু বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, কর প্রদান, বৈদেশিক বাণিজ্য, চুক্তির বাস্তবায়ন ও অস্বচ্ছলতা দূরীকরণ।
বাংলাদেশের অবস্থান গত বছরের র্যাংকিং থেকে এক ধাপ উঠে এসেছে ঠিকই, তবে সাতটি সূচকে আগের চাইতে পিছিয়ে গেছে। এর জন্য বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ধীরগতিকে প্রধান কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
আবার এই সূচকগুলোতে বিগত বছরগুলোর তুলনায় উন্নয়নের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে আফগানিস্তান।
পাঁচটি ক্ষেত্রে রেকর্ড হারে সংস্কারের মাধ্যমে তারা নিজেদের এই অবস্থান পরিবর্তন করতে পেরেছে বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে।
যে সূচক-গুলোয় পিছিয়েছে বাংলাদেশ:
ব্যবসা শুরু:
ব্যবসা শুরুর সূচকে গত বছর বাংলাদেশের স্কোর ১৩৮ হলেও এবার সেটা ৭ পয়েন্ট কমে ১৩৮ এ দাঁড়িয়েছে।
ব্যবসা শুরু করতে বাংলাদেশে গড়ে ১৯.৫ দিন সময় লাগে অন্যদিকে আফগানিস্তানে সময় লাগে মাত্র ৮ থেকে ৯ দিন। এবং মিয়ানমারে ১৪ দিন।
নির্মাণের অনুমোদন:
নির্মাণের অনুমোদন পেতে বাংলাদেশের যেখানে ২৭৩.৫ দিনের চেয়ে বেশি সময় লাগে সেখানে আফগানিস্তানের সময় লাগে ১৯৯ দিন। অন্যদিকে মিয়ানমারের লাগে মাত্র ৯৫ দিন।
বিদ্যুৎ সংযোগ:
বিদ্যুৎ সংযোগের সহজলভ্যতার দিকে বাংলাদেশ প্রতিবছর এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, তবে আফগানিস্তান ও মিয়ানমারের তুলনায় এখনও অনেক পিছিয়ে।
বাংলাদেশের স্কোর যেখানে ২২.৭৫ সেখানে আফগানিস্তানের স্কোর ৪৪.৫৮ এবং মিয়ানমারের স্কোর ৫২.৫২।
কেননা বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে বাংলাদেশের এখনও ২২৩.৭ দিন লাগে। যেখানে আফগানিস্তানের ১১৪ দিন এবং মিয়ানমারের মাত্র ৭৭ দিনের প্রয়োজন হয়।
আরও পড়তে পারেন:
‘সেক্স টয়’ সম্পর্কে অদ্ভূত সব তথ্য
ই-কমার্স কি পাল্টে দেবে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য
বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের চামড়ার বাজারে?
ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ গত বছর থেকে বিদ্যুৎ গ্রিডে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে।
২০১৫ সাল থেকে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় নেটওয়ার্কের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। এতে দুটি শহরেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে প্রয়োজনীয় সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে।
এতে ব্যবসা পরিচালনায় নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে আগে যে সময় ব্যয় হতো সেটা অনেকটাই কমে এসেছে।
২০১৪ সালে যেখানে নতুন সংযোগ পেতে ৪শ দিন সময় লাগতো ২০১৮ সালে সেটা কমে মাত্র ১৫০ দিনে দাঁড়িয়েছে।
তবে আরও দ্রুত ও আরও বেশি সংস্কারের উদ্যোগ নিলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
সম্পত্তি নিবন্ধন:
সম্পত্তি নিবন্ধনে এখনও বাংলাদেশের সময় লাগে ২৭০.৮ দিন। যেখানে আফগানিস্তানের লাগে ২৫০ দিন, অন্যদিকে মিয়ানমারের লাগে ৮৫ দিন।
তবে এই সূচকে গত বছরের তুলনায় এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
কর প্রদান:
এই সূচকেও দুই দেশের চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। কর দিতে আফগানিস্তানে বছরে ২৭৫ ঘণ্টা এবং মিয়ানমারে ২৮২ ঘণ্টা ব্যয় হয়। যেখানে বাংলাদেশে ব্যয় হয় বছরে ৪৩৫ ঘণ্টা।
এই সূচকেও গত বছরের তুলনায় এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
বৈদেশিক বাণিজ্য:
বৈদেশিক বাণিজ্যে আফগানিস্তানের স্কোর ৩০.৬৩% এবং বাংলাদেশের স্কোর ৩১.৭৬%। অর্থাৎ বাংলাদেশের তুলনায় আফগানিস্তানের অবস্থান এখানে এক শতাংশ কম। তবে মিয়ানমারে স্কোর এই সূচকে ৪৭.৬৭%।
সীমান্তে রপ্তানিতে বাংলাদেশের সময় লাগে গড়ে ১৬৮ ঘণ্টা যেখানে আফগানিস্তানের লাগে ৪৮ ঘণ্টা এবং মিয়ানমারের লাগে ১৪২ ঘণ্টা।
চুক্তি বাস্তবায়ন:
চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের স্কোর মাত্র ২২.২১। যেখানে আফগানিস্তান এগিয়ে আছে ৩১.৭৬ পয়েন্ট নিয়ে অন্যদিকে মিয়ানমারের স্কোর ২৪.৫৩।
এছাড়া মিয়ানমার ও আফগানিস্তানের চাইতে এ খাতে বাংলাদেশের ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বেশি।
অন্যান্য সূচক:
সংখ্যালঘুদের বিনিয়োগ সুরক্ষার সূচকে গত বছর বাংলাদেশের স্কোর ৮৯ হলেও এবার সেটা কমে ৭৬ এ দাঁড়িয়েছে।
এদিকে আফগানিস্তান তাদের অস্বচ্ছলতা দূর করতে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। যেন দেশটির ক্রেডিট অ্যাক্সেসকে জোরদার করা যায়।
ওই আইনে প্রধান কর্পোরেট সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে যেন সংখ্যালঘু বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেয়া যায়।
সেই-সঙ্গে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে মালিকানা, নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এবং বৃহত্তর কর্পোরেট স্বচ্ছতার বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়েছে।
এছাড়াও কর পরিশোধ সহজ করায় ব্যবসা শুরু করা সহজ হয়ে পড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ইনডিকেটরস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক রিটা রামালহো জানান, “দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর এগিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হল তারা তাদের শক্তিশালী সংস্কার কর্মসূচিগুলো অব্যাহত রেখেছে।”
এছাড়া অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিবেশ তৈরি করতে তাদের অধ্যবসায়, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরণের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেন তিনি। এক্ষেত্রে তিনি আফগানিস্তানের উদাহরণ টেনে বলেন, “সহিংসতা ও অ-নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশটি নিজেদের যেভাবে প্রমাণ করেছে সেটা প্রশংসাযোগ্য”
ভারত ও পাকিস্তান:
অন্যদিকে ছয়টি সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে র্যাংকিংয়ের ৭৭তম অবস্থান এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শীর্ষে উঠে এসেছে ভারত।
দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ অর্থনীতির দেশ ভারতের দিন দিন এগিয়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে দেশটির ভবনের মান নিয়ন্ত্রণ ও ভবনের অনুমোদনের প্রক্রিয়া উন্নত করার বিষয়টিকে।
দিল্লি ও মুম্বাই দুটি শহরেই এই সংস্কার করা হয়।
একাধিক আবেদনপত্রের একীকরণ এবং নতুন পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) প্রবর্তনের মাধ্যমে নতুন ব্যবসা শুরু করা অনেকটাই সহজ করে গিয়েছে।।
কেননা এতে বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া যেমন দ্রুত হয়েছে তেমনই হয়েছে সহজলভ্য।
ভারতে অন্যান্য সংস্কারের মধ্যে ক্রেডিট শক্তিশালী-করণ অন্যতম। এতে কর দেয়ার পাশাপাশি দেশের বাইরে বাণিজ্য দ্রুত ও সহজ হয়েছে।
এদিকে পাকিস্তান তাদের তিনটি শক্তিশালী সংস্কার কর্মসূচী গত বছর থেকে এ পর্যন্ত অব্যাহত রাখার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে।
লাহোর ও করাচী দুটি শহরেই সম্পত্তি নিবন্ধন পদ্ধতি সহজ করা হয়েছে। উভয় শহরগুলি দুর্নীতির সমাধান এবং
নতুন ব্যবসা নিবন্ধন করা সহজতর করার পাশাপাশি অস্বচ্ছলতা দূর করতেও দেশটি নতুন সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।