অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২১ অক্টোবর ২০২৫, মঙ্গলবার
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১ বিলিয়ন ডলার বা ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি)। সংগঠনটি জানায়, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেশের শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, দেশের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে, যা উদ্বেগের। এ ঘটনায় ঘটনায় দেশের রপ্তানিকারকরা যেমন শঙ্কিত, বিদেশি ক্রেতারাও উদ্বিগ্ন। সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এসব তথ্য তুলে ধরেন। খাতভিত্তিক সংগঠনগুলোর এপেক্স বডি বিকেএমইএ, বিজিএমইএ, বিটিএমএ, বিজিপিএমইএ, লেদার অ্যান্ড লেদার গুডস, ফুট অ্যান্ড ভেজিটেবলস, ঔষধ শিল্প, জুয়েলারি এক্সপোর্টার্স, সুয়িং থ্রেড, ফ্রোজেন ফুডস, প্লাস্টিক গুডস, সিল্ক গুডস, হস্তশিল্প, ক্রাফ্ট অ্যান্ড গিফ্টওয়্যার ইত্যাদি এসোসিয়েশনসহ সংশ্লিষ্ট সকল সংগঠন মিলে যৌথভাবে এ সংবাদ সম্মেলন করে।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের ব্যবসায়ী সমাজ ও রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য এক বড় সতর্কবার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা শঙ্কিত এবং আমাদের বৈদেশিক ক্রেতারাও উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, কার্গো ভিলেজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট কার্যকর নয় এবং এটি নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। একইভাবে শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
ক্ষতি ১২ হাজার কোটি টাকা: মো. হাতেম বলেন, এই অগ্নিকাণ্ডে রপ্তানিকারকদের ক্ষতির পরিমাণ এখনই নির্ধারণ করা কঠিন। সরাসরি ক্ষতি হয়েছে আগুনে পুড়ে যাওয়া পণ্যে, তবে এটি কেবল সরাসরি ক্ষতি নয়, পুড়ে যাওয়া কাঁচামাল থেকে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি হবে না, তাতে আরও বড় ক্ষতি হবে। অগ্নিকাণ্ডের কারণে সামনের কয়েকদিন আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হবে, বাজারে অবস্থান হারানোর আশঙ্কা রয়েছে, ক্রেতাদের আস্থা কমবে এবং আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের সদস্যদের কাছে জরুরি বার্তা পাঠিয়ে ক্ষতির পরিমাণ জানার চেষ্টা করছি, তবে এখনও পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়নি। একটি স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে সামগ্রিক ক্ষতির সঠিক চিত্র পাওয়া সম্ভব হবে। তবুও প্রাথমিকভাবে আমাদের ধারণা-সব মিলিয়ে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বা বারো হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের মধ্যে রয়েছে- ওষুধের কাঁচামাল, চিকিৎসা সরঞ্জাম, রাসায়নিক পণ্য, ইলেকট্রনিকস, কসমেটিকস বা প্রসাধন, অনলাইন ব্যবসার পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, কৃষিপণ্য, শাকসবজি, ফলমূল এবং অন্যান্য পচনশীল পণ্য, বিকেএমইএ, বিজিএমইএ, বিটিএমএ, বিজিএপিএমইএ’র নমুনা, লেদার অ্যান্ড লেদার গুডস, জুয়েলারি এক্সপোর্টার্স, প্লাস্টিক গুডস, সিল্ক গুডস ও হস্তশিল্পের পণ্য। এসব পণ্যে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
ঔষধ শিল্পের ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল ভস্মীভূত: বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব জাকির হোসেন বলেন, আমরা ৩২ কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছিলাম, কার কী ক্ষতি হয়েছে জানতে। দেখলাম, তাদের ২০০ কোটি মূল্যের কাঁচামাল ভস্মীভূত হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে জাকির হোসেন বলেন, একেকটি ওষুধ উৎপাদনে ১০-১২টি থেকে ৫৩টি উপকরণের প্রয়োজন হয়। ফলে ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল পুড়ে যাওয়ার কারণে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। তিনি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে ছুটির দিনগুলোতে কাস্টম হাউজের শুল্কায়ন বন্ধ রাখার সমালোচনা করেন। জাকির বলেন, ২৪ ঘণ্টাই চালু রাখতে হবে। স্বল্প পরিসরে হলেও। নয়তো ফের এমন ঘটনা ঘটতে পারে।
সরকারি দপ্তরগুলো দায় এড়াতে পারে না: ইএবি সভাপতি মো. হাতেম বলেন, এই অগ্নিকাণ্ডের দায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএবি), কাস্টম হাউস এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস-কেউই এড়াতে পারে না। কারণ, সিএএবি এই কার্গো ভিলেজের মালিক, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আমদানিকৃত পণ্যের তত্ত্বাবধায়ক, আর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস হলো হ্যান্ডলিং এজেন্ট। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কেউ যথাযথ মনোযোগ দেয়নি বলে অভিযোগ করেন হাতেম। তার মতে, বর্তমান গুদাম ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল এবং এখনো ম্যানুয়ালি পরিচালিত হয়।
এছাড়া কাস্টমস ছাড়পত্র প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতার কারণে প্রচুর পণ্য জমে থাকে, ফলে সীমিত স্থানের সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করে। কেমিক্যাল ও ওষুধের কাঁচামালের মতো স্পর্শকাতর পণ্যের গুদাম আলাদা, অধিক সুরক্ষিত এবং নিরাপদ দূরত্বে স্থাপন করা উচিত ছিল।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল্স এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান। বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার ঘটনায় পাশের দেশের ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের পোশাক খাতের বাজার যেন কমে যায় তা পাশের দেশ চায় উল্লেখ করে এই ব্যবসায়ী বলেন, এ বছর আমাদের পোশাক খাতে ৬ শতাংশ বাজার কমেছে, নিট খাতে ৫ শতাংশ কমেছে। গত বছর জুলাই আন্দোলন হয়েছে, সে সময়ও এত কমেনি। তাহলে এ বছর কেন বাজার কমলো? এটা ষড়যন্ত্রের অংশ। বিটিএমএ সভাপতি বলেন, এক ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে আমাদের দেশে। একের পর এক ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমরা বড়ভাবেই ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছি। এটা কোনো খেলার মাঠ না, এটা আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর এবং রাজধানী শহরে। আমাদের ভীষণভাবে ভাবার বিষয় আছে। রাসেল সতর্ক করে দিয়ে জানান, এই ক্ষতি এখন বিমানবন্দর পর্যন্ত চলে গেছে। এরপর ঘরবাড়ি পোড়ানোর সময় আসবে। এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, এটি এমন একটা ভূরাজনৈতিক অবস্থান, এখানে অনেকের চোখ পড়েছে। বহির্বিশ্বে যেন আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় তা নিয়ে এক ধরনের ষড়যন্ত্র আছে।
ইএবি’র ৬ দাবি: ইএবি দাবি, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের বিপরীতে করা বীমা দাবি দ্রুত নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া। যেসব পণ্যের বীমা করা ছিল না, সেগুলোর ক্ষেত্রে সরকারি বিশেষ তহবিল গঠন করে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা দেয়া। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কার্গো ভিলেজের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ। ঔষধ শিল্পের জন্য আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আলাদা গুদামের ব্যবস্থা করা। নিরাপদ দূরত্বে রাসায়নিক গুদাম স্থাপন এবং কার্গো ভিলেজের গুদাম ব্যবস্থাপনাকে সম্পূর্ণ অটোমেটেড ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সমুদ্র, বিমান ও স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ৬৫ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে ৪.১ বিলিয়ন বা ৪১০ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ এই বিমানবন্দর দিয়ে দেশের মোট আমদানির ৬ শতাংশ পণ্য আসে।
উল্লেখ্য, গত শনিবার হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিস, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী এবং বিজিবি’র সাড়ে সাত ঘণ্টার চেষ্টায় ওই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।