এক মাস পরই আবার ছন্দপতন ঘটেছে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিতে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এ খাতে বার্ষিক ঋণের প্রবৃদ্ধি ফের ৯ শতাংশের ঘরে নেমেছে। আগের মাসেও বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমার পেছনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সংকোচমুখী মুদ্রানীতির কারণে সুদের হার বৃদ্ধি, ডলার সংকটে আমদানিতে ধীরগতি এবং ব্যাংক খাতে চলমান তারল্য সংকট ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে বার্ষিক ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ। কিন্তু ওই সময়ের কোনো মাসেই বেসরকারি ঋণের এ লক্ষ্য অর্জন হয়নি। এ কারণে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে প্রবৃদ্ধির হার আরও কমানো হয়েছে। আগামী জুন পর্যন্ত এই প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা; যা ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ছিল ১৪ লাখ ২৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা। ফলে গত এক বছরে এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আগের মাস ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি খাতের ঋণের বড় অংশ ব্যয় হয় আমদানিতে। তবে ডলার-সংকটের কারণে চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি ডলারের ওপর চাপ কমাতে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে। সেই সঙ্গে খেলাপিঋণ বৃদ্ধি, ডলারে কেনায় খরচ বৃদ্ধি ও সরকারের ব্যাংকঋণ বাণিজ্যিক ব্যাংকনির্ভর হওয়ায় ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট চলছে। অন্যদিকে সংকচোনমুখী মুদ্রানীতির কারণে ধারাবাহিকভাবে ঋণের সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ঋণের চাহিদা কম হচ্ছে। এছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় জানুয়ারিতে ঋণের চাহিদা কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) আমদানি ঋণপত্র নিষ্পত্তির পরিমাণ কমেছে ১৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এ সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৬৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। শিল্প খাতে কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কমেছে ২৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আর শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমেছে ১০ দশমিক ০৯ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির নিম্নমুখী এ প্রবণতা শিল্প খাতের স্থবিরতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে বেসরকারি খাতে টানা কমতে থাকে ঋণের প্রবৃদ্ধি। ওই মাসে বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। এরপর ফেব্রুয়ারিতে ১২ দশমিক ১৪, মার্চে ১২ দশমিক ০৩, এপ্রিলে ১১ দশমিক ২৮, মে মাসে ১১ দশমিক ১০ এবং জুনে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমে যায়। এরপর জুলাইয়ে দুই অঙ্কের নিচে নেমে যায় প্রবৃদ্ধি। ওই মাসে প্রবৃদ্ধি কমে হয় ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। আগস্টে তা আরও কমে ৯ দশমিক ৭৫ ও সেপ্টেম্বর ৯ দশমিক ৬৯ নেমে আসে। তবে অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে ১০ শতাংশের ঘরে উঠেছিল। এর পরের মাস নভেম্বরে আবার তা কমে ৯ দশমিক ৯০ শতাংশে নেমে আসে। এর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এরপর কখনোই তা ১০ শতাংশের নিচে নামেনি।
এদিকে, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমলেও উল্টো চিত্র সরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতে নিট ঋণের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা জানুয়ারিতে বেড়ে হয়েছে ২১ দশমিক ১৩ শতাংশ।
share biz