রোহান রাজিব: বেসরকারি খাতে ধারাবাহিকভাবে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। আবার ডলার সংকটের কারণে চাহিদামতো এলসি খুলতে পারছেন না। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে রয়েছে তারল্য সংকট। তাই বেসরকারি খাতে ঋণ যাচ্ছে আগের তুলনায় কম। এর ফলে প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
গত আগস্ট শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে তা আরও দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ঋণে এই প্রবৃদ্ধি গত ২৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এরপর কখনোই তা ১০ শতাংশের নিচে নামেনি। বর্তমান মুদ্রানীতিতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ১৩ হাজার ৫৩ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৩৩ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
আর ২০২১ সালে সেপ্টেম্বর শেষে ঋণ স্থিতি ছিল ১২ লাখ ১০ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। সে হিসাবে ২০২২ সাল সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ খাতে এক বছরে ঋণ বেড়েছিল এক লাখ ৬৮ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা। ওই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
ব্যাংকাররা জানান, রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রচুর টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। আবার রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার সক্ষমতা ক্রমাগত কমছে। এছাড়া বেসরকারি খাতের ঋণের বড় অংশ ব্যয় হয় আমদানিতে। তবে ডলার-সংকটের কারণে চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খোলা যাচ্ছে না। পাশাপাশি ডলারের ওপর চাপ কমাতে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে। অপরদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কায় এখন কেউ নতুন করে প্রকল্প নিতে চাইছেন না। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে আসে, যার কারণে ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট দেখা দেয়।
অপরদিকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বাড়ছে, কিন্তু এর থেকে আদায় হচ্ছে না। তাই ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমছে ব্যাংকগুলোর। তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে পারছে না এর অন্যতম একটি কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর সরকারের যেসব বন্ড কিনে নিয়েছে, তা এখন আবার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কিনে নিচ্ছে। এর মাধ্যমেও ব্যাংকগুলো থেকে টাকা উঠে আসছে। এর অর্থাৎ হলো সরকার বন্ডের মাধ্যমে বাণিজিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দিচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুন শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল দুই লাখ ৩৬ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। আর গত ১৮ অক্টোবর শেষে স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে ১৮ দিনে ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৪৯ কোটি টাকা।
অপরদিকে একই সময়ে ২৯ হাজার ১৮১ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকার ঋণ পরিশোধ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুন শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল এক লাখ ৫৭ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। আর গত ১৮ অক্টোবর তা কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৮ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা কমে গেছে। আগামীতে আরও কমবে। কারণ ডলার বাড়ার যেসব উৎস রয়েছে, তাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আমদানিনির্ভর হওয়ায় এলসি থেকে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়। এখন যেহেতু এলসি কমে গেছে, তাই ঋণের চাহিদাও কমেছে। এজন্য প্রবৃদ্ধি কম হচ্ছে। এছাড়া চলমান মার্কিন ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে সমস্যায় পড়ছেন। বেশ কয়েকটি সম্প্রসারিত প্রকল্পও পিছিয়েও গেছে।
তিনি আরও বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গ্রাহকরা অপেক্ষা করছেন, তারা দেখতে চাচ্ছেন রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। তাই এ মুহূর্তে কেউ নতুন বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছেন, বেশ কয়েকটি ব্যাংক এখন তারল্য ঘাটতির মুখে পড়েছে। তাই কল মানি মার্কেট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে তারল্য সহায়তা নিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার তারল্য সংকটে পড়া সরকারি-বেসরকারি ১৩টি ব্যাংক ১৩ হাজার ৪৬ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নিয়েছে। এসব ব্যাংক অর্থের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাওয়ার কারণেই ধার নিচ্ছে।