- ইকতেদার আহমেদ
- ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০
বিহার ভারতের একটি রাজ্য। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী বিহারের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১০ কোটি এবং এর মধ্যে প্রায় ৯০ লক্ষ অর্থাৎ ১৬ শতাংশের কিছু বেশি ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভাজিত হলে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য হিসেবে বিহার ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারতবর্ষ বিভাগের সময় বিহারের তিন কোটির কিছু বেশি জনসংখ্যার মধ্যে ৪০ লক্ষাধিক ছিল মুসলিম। ভারত বিভাগ পূর্ববর্তী ১৯৪৬ সালে বিহারে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় ৩০ হাজার মুসলিম প্রাণ হারায়। বিহারের মুসলিমরা উর্দু ভাষাভাষী। পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রায় ৩০ লাখ বিহারি পাকিস্তানে পাড়ি জমান; যার মধ্যে ২০ লক্ষাধিক পশ্চিম পাকিস্তানে আবাসন গড়ে তোলেন আর অবশিষ্ট ১০ লাখের কাছাকাছি পূর্ব-পাকিস্তানে বসতি স্থাপন করে। পশ্চিম-পাকিস্তানে যেসব বিহারি আবাসন গড়ে তোলেন তাদের অধিকাংশই সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী করাচিতে বসতি স্থাপন করেন এবং তারা সেখানে ‘মহাজের’ নামে খ্যাত।
পাকিস্তান সৃষ্টিতে বিহারের মুসলমানদের আত্মত্যাগ বিষয়ে অবিভক্ত ভারতের মুসলিমদের শীর্ষ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভালোভাবে অবগত ছিলেন এবং তিনি এক বিবৃতিতে স্বীকার করেন, ‘আমি প্রকৃতই বিহারের মুসলমানদের জন্য গর্ববোধ করি যারা অনেক আত্মত্যাগ করেছেন, তাদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না। পাকিস্তানের গন্তব্যকে তারা কাছাকাছি নিয়ে আসেন এবং এটি অর্জনে যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকেন।’ জিন্নাহ দক্ষ ও শিক্ষিত বিহারি মুসলিমদের বিশেষত রেলওয়ের কর্মচারীদের পূর্ব-পাকিস্তানে পুনর্বাসনের আহ্বান জানিয়ে নতুন দেশটি পরিচালনা ও গঠনে সাহায্য করার আবেদন জানান।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভারত বিভাগ পূর্ববর্তী বিহারে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা তীব্র আকার ধারণ করলে তিনি তৎকালীন মুসলিম ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে বিহারিদের উদ্ধারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কলকাতা থেকে বিহারের রাজধানী পাটনায় ছুটে যান এবং আশ্রয়হীন, অসহায় ও আহত বিহারিদের আসানশোলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আসানশোল পশ্চিম-বাংলার একটি জেলা শহর, যা বিহারের সীমান্তসংলগ্ন।
ভারতবর্ষ বিভাগ পরবর্তী বেশ কিছু বছর জনসাধারণের ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে চলাচলে বাধানিষেধ ছিল না। বিহার পূর্ব-পাকিস্তানের নিকটবর্তী হওয়ায় বিহারের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মুসলিমরা পূর্ব-পাকিস্তানে বসবাসে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এর ফলে দেখা যায় বিপুল সংখ্যক বিহারি বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলায় বসতি স্থাপন করেন। বিহারিদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্নরা পশ্চিম-পাকিস্তানের উদ্দেশে পাড়ি জমান।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হওয়ায় বিহারিরা উর্দু ভাষাভাষী হিসেবে মুক্তি সংগ্রাম চলাকালীন পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেন। মুক্তি সংগ্রাম শুরুর আগে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন কার্যত ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ৭ তারিখ থেকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা শহরগুলোর সাথে ঢাকার রেল, সড়ক, বিমান ও নৌ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। এ সময়ের মধ্যে কিছু সুযোগসন্ধানী দুষ্কৃতকারী ব্যাপক হারে বিহারি নিধনে মত্ত হয় এবং নির্বিচারে অগণিত বিহারি শিশু-নারী-পুরুষকে হত্যা করে। চট্টগ্রাম ও খুলনাসহ বিভিন্ন জেলাশহরে শিল্প কারখানায় যেসব বিহারি পদস্থ কর্মকর্তা কর্মরত ছিলেন এবং যারা পরিবারসমেত শিল্প কারখানার অভ্যন্তরে বসবাস করতেন তাদের অনেককে কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরাই হত্যা করে। এমন তথ্যও পাওয়া গেছে যে, তাদের স্ত্রী-কন্যাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ নদীর পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে।
১৯৪৭ পরবর্তী দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সময় একাদিক্রমে পূর্ব-পাকিস্তানে বসবাসের কারণে বিহারিদের অনেকে এ দেশের মাটির সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এমন এক বিহারি ভদ্রলোক নোয়াখালী জেলার সর্ব দক্ষিণের রেলস্টেশন সোনাপুরে কর্মরত ছিলেন। তিনি অবসর পরবর্তী স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসমেত রেলস্টেশনের কাছে স্বল্প পরিমাণ জমি কিনে সেখানে টিনের ছাদবিশিষ্ট ইটের দেয়াল নির্মিত ঘরে বসবাস করতে থাকেন।
তার পরিবারের সারা বছরের খাদ্যের জোগানের জন্য তিনি নোয়াখালীর চলাঞ্চলে বেশ কিছু জমিও কিনেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন স্বার্থান্বেষী ধনলিপ্সুদের তার যৎসামান্য সম্পদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে এবং তারা রাজনীতির সাথে কোনো ধরনের সম্পর্কহীন সম্পূর্ণ নিরপরাধ এ পরিবারটিকে শুধুমাত্র বিহারি হওয়ার অপরাধে নির্মমভাবে হত্যা করে তার যা কিছু অস্থাবর সম্পত্তি ছিল তা লুট করে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে স্থাবর সম্পত্তিগুলো জাল দলিল সৃষ্টির মাধ্যমে হস্তগত করে। এ ঘটনাটি নোয়াখালীর প্রতিটি বিবেকবান লোকের হৃদয়কে নাড়া দেয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে এরূপ হাজারো ঘটনার কাহিনী আজ অনেকের অজানা নয়।
মুক্তি সংগ্রাম পরবর্তী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটলে তখন এ দেশে প্রায় আট লাখের কাছাকাছি বিহারি ছিল। এদের বেশির ভাগই পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ ব্যক্ত করে। পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ধনী রাষ্ট্রসমূহ বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের পুনর্বাসনের ব্যয়ভার বহন করবে এ শর্তে তাদের সে দেশে পুনর্বাসনে সম্মত হয়। পুনর্বাসন কার্যক্রম যথারীতি শুরু হলেও ১৯৮১ সাল অবধি এক লাখ ৬৫ হাজারের কাছাকাছি বিহারিকে পাকিস্তানে স্থানান্তর সম্ভব হয়। এরপর থেকে সরকারিভাবে অদ্যাবধি কোনো বিহারি পাকিস্তানের বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে এ দেশ ছেড়ে যাননি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ৬৬টি শরণার্থী শিবিরে দুই লাখ ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ বিহারি আশ্রয় গ্রহণ করে। এদের অধিকাংশই দারিদ্র্যপীড়িত ও অসহায়। বিহার সীমান্তের সন্নিকটে বাংলাদেশের সৈয়দপুর শহরে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় আড়াই লাখ বিহারির বসবাস ছিল এবং এ শহরটিতে বিহারিদের সংখ্যা বাঙালিদের চেয়ে বেশি ছিল। বর্তমানে শরণার্থী শিবিরসহ সৈয়দপুর এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষিপ্তভাবে ১০ লাখের কাছাকাছি বিহারি বসবাস করছেন। এ সব বিহারি চার যুগের অধিক সময় ধরে এ দেশে বসবাস করার কারণে এদের তৃতীয় প্রজন্ম আজ বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে গেছে। এরা অনেকে বাঙালিদের সাথে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, অনেকে পারিবারিকভাবে নিজেদের মধ্যে উর্দুর পরিবর্তে বাংলায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, আবার অনেকে দুপুর ও রাতের আহারে রুটির চেয়ে ভাতকেই অধিক পছন্দ করে। এরা আজ এ দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত এবং এদের নাগরিক ও ভোটাধিকার দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে দেশের উচ্চাদালতের সিদ্ধান্ত এদের অনুকূলে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমারের সাবেক আরাকান ও বর্তমান রাখাইন প্রদেশের মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সুদূর অতীত থেকে সে দেশে বসবাস করে এলেও সে দেশের সামরিক শাসকরা সাংবিধানিকভাবে তাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এরই ফলে তাদের সব ধরনের নাগরিক অধিকার ও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমদের কেউ বিদেশে যেতে চাইলে তার সে দেশে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না থাকায় পাসপোর্ট গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। তাই আরাকানের অনেক রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশি সেজে ভুয়া বাঙালি পরিচয়ে অবৈধভাবে এ দেশের পাসপোর্ট গ্রহণ করে বিদেশে বাঙালি ও বাংলাদেশী পরিচয়ে চাকরি করছেন। আরাকানের রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ও বাংলাদেশ কোনো রাষ্ট্রেই নিজ নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করায় তারা আজ সব ধরনের নাগরিক অধিকার ও ভোটাধিকার বঞ্চিত রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশে বসবাসরত বিহারিদের অবস্থান ভিন্নধর্মী। পাকিস্তানের শাসনামলে বিহারিরা বাঙালিদের মতো পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যদিও বিহারিদের বেশির ভাগ পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিন্তু নানা জটিলতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কার্যকর না হওয়ায় বর্তমানে শরণার্থী শিবিরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব বিহারি বসবাস করছেন তাদের সবাই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত এবং তাদের ভোটাধিকারও দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে আটকে পড়া বিহারি হিসেবে পাকিস্তান গমনের উদ্দেশে যেসব বিহারি বসবাস করে আসছেন এদের প্রত্যেকে জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন ক্যাম্প থেকে এসে স্ব স্ব পেশায় নিয়োজিত থেকে রুটি-রুজির ব্যবস্থা করছেন। শরণার্থী শিবির থেকে এদের বের হতে এবং সেখানে প্রবেশের ব্যাপারে কোনো ধরনের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নেই। এরা কেউ আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় শরণার্থী শিবিরের বাইরে বসবাস করতে চাইলে সে ক্ষেত্রে কোনো আইনগত বাধা নেই। ২০০০ পরবর্তী প্রতিটি জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনে শরণার্থী শিবিরে ও শরণার্থী শিবিরবহির্ভূত এলাকায় বসবাসরত বিহারিদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দেখা গেছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনসমূহে দেশের বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অপরাপর দলের প্রার্থীদের বিহারিদের কাছে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করতে দেখা গেছে এবং সব প্রার্থী ভোট-পরবর্তী তাদের সমস্যা সমাধানে আশার বাণী শুনিয়ে এসেছেন।
ঢাকার পল্লবী থানার বিহারিদের কালশী শরণার্থী শিবিরের লাগোয়া একটি বস্তি রয়েছে। এ বস্তিটি ‘রাজু বস্তি’ নামে পরিচিত। ২০১৪ সালে ১৪ জুন প্রত্যুষে কালশী শরণার্থী শিবিরে একই পরিবারের ৯ জন বিহারি নারী-পুরুষ-শিশুকে গৃহের মধ্যে তালাবদ্ধ রেখে বাইরে থেকে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে যেভাবে পুড়িয়ে মারা হয় এর নির্মমতা ও পৈশাচিকতা পৃথিবীর যেকোনো শান্তিকামী মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করবে। আজ ভাবতে অবাক লাগে যাদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে এরা সবাই মুসলমান। আর যারা এদের পুড়িয়ে মেরেছে তারাও মুসলমান। অথচ ইসলাম ধর্ম তো কোনো নিরীহ মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা অনুমোদন করে না। আর এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, ‘একজন মানুষ যদি অন্যায়ভাবে অন্য কোনো মানুষকে হত্যা করে তবে চিরদিনের জন্য তার (অপরাধীর) স্থান হবে নরকে।’ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যে সংবাদ ছাপা হয়েছে তা থেকে জানা যায়, ঘটনার ২-৩ দিন আগে স্থানীয় সংসদ সদস্য শরণার্থী হিসেবে নিবাসি বিহারি নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করেছিলেন শরণার্থী শিবির থেকে রাজু বস্তিতে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ যেন কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন করা না হয়। এ বিষয়ে শরণার্থী শিবিরবাসী বিহারিদের অভিমত যে ট্রান্সফরমার থেকে তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় সেটির ক্ষমতা সীমিত বিধায় রাজু বস্তির বিদ্যুৎ সরবরাহ শরণার্থী শিবির থেকে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে অব্যাহত রাখা হলে অধিক বোঝা বহনের কারণে ট্রান্সফরমারটি জ্বলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে এবং একবার ট্রান্সফরমারটি জ্বলে গেলে গ্যাস ও পানির সমস্যা জর্জরিত শরণার্থী শিবিরবাসীর দুর্ভোগ অসহনীয় পর্যায় পৌঁছবে। সেদিন শরণার্থী শিবিরের বিহারি নেতারা সংসদ সদস্যের অনুরোধ উপেক্ষা করায় তা তার বিবেচনায় তার আত্মসম্মানের হানি ঘটায়।
তাছাড়া তার সাথে বিহারি নেতাদের এ বিষয়ে কথা বলার সময় তর্কাতর্কিসহ হাতাহাতির যে উপক্রম হয় তাতেও তিনি অপমানিত বোধ করেন এবং তাদেরকে এর পরিণতি সম্পর্কে হুমকি প্রদান করেন। একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে রাজু বস্তি থেকে সংসদ সদস্যের লোকজন তার নাম করেই বিদ্যুৎ বিল আদায় করতেন। শরণার্থী শিবিরের বিদ্যুৎ বিল সরকার বহন করার কারণে রাজু বস্তিবাসীদের অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য সংসদ সদস্যের লোক ব্যতীত বিদ্যুৎ বিভাগের কাউকে কোনো ধরণের অর্থ দিতে হতো না। অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে অবৈধ অর্থ উপার্জন ছাড়াও শরণার্থী শিবির অভ্যন্তরস্থ ভূমি প্রধান সড়কসংলগ্ন হওয়ায় বর্তমানে এর মূল্য বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শরণার্থী শিবিরের ভূমি আত্মসাতের মাধ্যমে কিভাবে আরো সম্পদ অর্জন করা যায় সেদিকে এ সংসদ সদস্যের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল। এলাকার বিবেকবান মানুষ এমনটিই নিশ্চিত করেছেন।
৯ জন বিহারি নারী-পুরুষ-শিশু যখন আগুনে পড়ে মরছিলেন তখন পুলিশের গুলিতে আরো একজনের প্রাণহানি ঘটে। বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা যায়, সংসদ সদস্যের প্রত্যক্ষ মদদে তার নিয়ন্ত্রিত বাহিনী পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় এ নৃশংস হত্যাকা- সংঘটিত করে।
এ কথাটি সত্য যে, আমাদের দেশে ইতোপূর্বে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর রাজনৈতিক ইন্ধনে একাধিক সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হয়েছে কিন্তু তাতে জীবনহানির ঘটনা বিরল। এ সব সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা নিরসনে সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সবসময় সোচ্চার ছিল। আজ দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, যখন একই ধর্মাবলম্বী একটি জাতি শুধুমাত্র জাতিগত ভিন্নতায় অপরটির ওপর আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার নৃশংসতায় লিপ্ত তখন সরকার ও সরকার পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত দল কেন নিশ্চুপ?
আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিহারিদের অনেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করা ছাড়াও রাজাকার ও আল বদরের খাতায় নাম লিখিয়ে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়ে অনেক নিরীহ বাঙালি নারী-পুরুষকে হত্যা করেছে এ কথাটি যেমন সত্য, ঠিক তেমন এটিও সত্য এসব বিহারির প্রায় সবাই স্বাধীনতা-পরবর্তী এ দেশের বাঙালিদের আক্রোশের কারণে প্রাণ হারিয়েছেন। আজ বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আটকে পড়া বিহারি নামে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে সব বিহারি বসবাস করছেন তাদের অধিকাংশই নিরীহ এবং এদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্ম স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখেনি। আজ এটি অমোঘ সত্য যে, আটকে পড়া যেসব বিহারি শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছেন তাদের কারো ভাগ্যে পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর যেহেতু তারা বর্তমানে ভোটাধিকার প্রাপ্ত যার অর্থ দাঁড়ায় এ দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত সুতরাং কেন তাদের বিহারি নামে অভিহিত করে বঞ্চনা, হয়রানি ও নিপীড়নের সম্মুখীন করা হচ্ছে। তারা প্রকৃতই আমাদের নাগরিক হয়ে থাকলে তাদের নিয়ে আর কোনো ধরনের অমানবিক ও অমানুষিক ঘটনা না ঘটিয়ে তাদের দুর্দশা লাঘব করতে পারলে তারা যে ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পথ সুগম করে দিয়েছিল সে দায়ের কিছুটা হলেও শোধ হবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশেষক
E-mail: [email protected]