বিশ্বের ধ্বংসাত্মক ৫ আর্থিক সঙ্কট ও বাংলাদেশ

বিশ্বের ধ্বংসাত্মক ৫ আর্থিক সঙ্কট ও বাংলাদেশ

১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন বাজারের ধস এবং পরবর্তী আর্থিক সঙ্কট যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বজুড়ে যে বিপর্যয় নামিয়ে এনেছিল আমরা অনেকে এখনো তা স্মরণ করি। দুর্ভাগ্যবশত, আর্থিক সঙ্কট ইতিহাসে এক সাধারণ বিষয় এবং প্রায়ই আক্রান্ত দেশে এটি অর্থনৈতিক সুনামির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেকসময় এই সুনামি রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থাকেও ওলটপালট করে দিতে দেখা যায়। আমরা নিচে আধুনিক সময়ের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক পাঁচটি আর্থিক সঙ্কটের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেসব দেশ বা অঞ্চলের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল তার নানা নির্ণায়ক বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। এই আলোচনার মূল বিষয়টি হলো বাংলাদেশ এখন যে সময় পার করছে তাতে বড় আকারের অর্থনৈতিক ঝুঁকির শঙ্কা কতখানি রয়েছে তা তুলে আনা। আর একই সাথে ঘনীভূত সঙ্কট প্রকাশ্য হওয়ার আগে নিরোধমূলক কোনো পদক্ষেপ নেয়ার মতো থাকলে তা নীতিনির্ধারকদের সামনে নিয়ে আসা। বৈশ্বিক আর্থিক বিপর্যয়ের তথ্য এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকা থেকে নেয়া।

১৭৭২ সালের ঋণসঙ্কট : ১৭৭২ সালের সঙ্কটটি লন্ডনে উদ্ভূত হয় এবং দ্রুত ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ১৭৬০ এর দশকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তার ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলোতে বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে সম্পদ সংগ্রহ করে। এটি বহু ব্রিটিশ ব্যাংকের মধ্যে অতি আত্মবিশ্বাস এবং দ্রুত প্রসারণের একটি প্রবণতা তৈরি করে। এই হাইপ বা ঢেউটি হঠাৎ শেষ হয় যখন ব্রিটিশ ব্যাংকিং হাউজ নীল, জেমস, ফোর্ডিস এবং ডাউনের অন্যতম অংশীদার আলেকজান্ডার ফোর্ডিস তার পুঞ্জীভূত ঋণ পরিশোধের দায় থেকে বাঁচতে ফ্রান্সে পালিয়ে যান। এই সংবাদটি ইংল্যান্ডে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাংকিং খাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। আর এ আতঙ্কের কারণে আমানতকারীরা তাৎক্ষণিক নগদ টাকা উত্তোলনের জন্য ব্রিটিশ ব্যাংকগুলোর সামনে দীর্ঘ লাইন দিতে শুরু করে। পরে সঙ্কটটি স্কটল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও ইউরোপের অন্যান্য অংশ এবং ব্রিটিশ আমেরিকান উপনিবেশগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ঐতিহাসিকরা দাবি করেছেন যে, বোস্টন টি পার্টির বিক্ষোভ এবং আমেরিকান বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এই অর্থনৈতিক মন্দাজনিত সঙ্কট।

১৯২৯-৩৯ সালের মহামন্দা : এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে খারাপ আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়। অনেকে মনে করেন যে, ১৯২৯ সালের ওয়াল স্ট্রিটের ক্র্যাশের ফলে এক মহামন্দা সৃষ্টি হয় এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বল নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের কারণে তা আরো বেড়ে যায়। এই মন্দা বিশেষত শিল্পজাত দেশগুলোতে প্রচুর আয় ও উৎপাদন হারানো এবং রেকর্ড বেকারত্বের কারণে প্রায় ১০ বছর স্থায়ী হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ১৯৩৩ সালে সঙ্কটের শীর্ষ সময়ে ২৫ শতাংশের কোটায় পৌঁছে যায়।

১৯৭৩ সালের ওপেকের তেলের দাম বৃদ্ধির আঘাত : এই সঙ্কট শুরু হয়েছিল যখন মূলত আরব দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত পেট্রোলিয়াম রফতানিকারক দেশগুলোর সংস্থা-ওপেক সদস্যরা চতুর্থ আরব-ইসরাইলি যুদ্ধের সময় আরবদের বিরুদ্ধে ইসরাইলে অস্ত্র সরবরাহের প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ওপেক দেশগুলো তখন তেল নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয় এবং আকস্মিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী দেশে জ্বালানি তেলের রফতানি বন্ধ করে দেয়। এটি তেলের তীব্র সঙ্কট সৃষ্টি করে এবং তেলের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য অনেক উন্নত দেশে অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়। এটি পরবর্তী সময়ে যে সঙ্কট ডেকে আনে তা ছিল একযোগে ঘটে যাওয়া জ্বালানির দাম বৃদ্ধিজনিত খুবই উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক স্থবিরতার ঘটনা। অর্থনীতিবিদরা এ সময়টাকে ‘স্থবিরতার’ (স্থবিরতা এবং মুদ্রাস্ফীতি) সময়কাল হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এই সঙ্কটের পর উৎপাদন পুনরুদ্ধার করতে এবং মুদ্রাস্ফীতিকে তার সঙ্কটকালের আগের পর্যায়ে নিয়ে যেতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগে যায়।

১৯৯৭-এর এশিয়ান সঙ্কট : এই সঙ্কটটি ১৯৯৭ সালে থাইল্যান্ডে উদ্ভূত হয়েছিল। এটি দ্রুত পূর্ব এশিয়া এবং এর ব্যবসায়িক অংশীদার দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে ‘এশিয়ান টাইগার’ নামে পরিচিত পূর্ব এশীয় দেশ থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং এবং দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক অঞ্চলে অতি প্রত্যাশাবাদী মূলধন প্রবাহের সৃষ্টি হয়। এর ফলে এই দেশগুলোতে ঋণ সম্প্রসারণ অতিমাত্রায় বাড়তে থাকে। একই সাথে এসব দেশের অর্থনীতিতে বিদেশী ঋণের পুঞ্জীভূতি সৃষ্টি হয়। ১৯৯৭ সালের জুলাইয়ে থাই সরকারকে বিদেশী মুদ্রার অভাবের কারণে এত দিন ধরে চলে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে তার স্থিত বিনিময় হারটি পরিত্যাগ করতে হয়েছিল। এটি এশীয় আর্থিক বাজারগুলোতে আতঙ্কের এক তরঙ্গ সৃষ্টি করে। আর এতে কোটি কোটি ডলার বিদেশী বিনিয়োগের বহিঃপ্রবাহ শুরু হয়। বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীরা পূর্ব এশীয় সরকারগুলোর সম্ভাব্য দেউলিয়া অবস্থার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে উঠলে বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে সঙ্কটে পড়া দেশগুলোর খেলাপি হওয়া এড়াতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির জন্য বেইল আউট প্যাকেজ তৈরির পদক্ষেপ নিতে হয়।

২০০৭-০৮-এর আর্থিক সঙ্কট : ২০০৭-০৮-এর যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সঙ্কট এক মহামন্দার সূত্রপাত করে। এটি বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারগুলোতে একধরনের সর্বনাশ ডেকে আনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাউজিং বুদ্বুদের (বাবল) পতনের ফলে সৃষ্ট সঙ্কটে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বিনিয়োগ ব্যাংক লেম্যান ব্রাদার্স ভেঙে পড়ে। এর ফলে অনেক মূল আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ধসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। আর এতে প্রয়োজন হয় অভূতপূর্ব অনুপাতের সরকারি বেইল আউট বা পুনরুদ্ধার উদ্যোগের। পরিস্থিতির স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে প্রায় এক দশক সময় লেগেছিল। এর মধ্যে কয়েক মিলিয়ন চাকরি এবং কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় উবে যায়।

বাংলাদেশে অনিবার্য হয়ে উঠবে অর্থনৈতিক সঙ্কট? : উপরে যে পাঁচটি বড় অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তার প্রতিটির বিশেষ এক বা একাধিক কারণ ছিল যা সঙ্কটকে ঘণীভূত করে একপর্যায়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এর মধ্যে বেশ কয়েকটি কারণের উপস্থিতি রয়েছে, যার ফলে নিকট ভবিষ্যতে সঙ্কট মোকাবেলায় কার্যকর ও প্রতিকারমূলক কিছু করা না গেলে বড় কোনো আর্থিক সঙ্কট সৃষ্টি তথা অর্থনৈতিক বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। ১৭২৭ সালের গ্রেট ব্রিটেনে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মূল কারণ ছিল দেশটির শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি ব্যাংকের অন্যতম মালিক আলেকজান্ডার ফোর্ডিস তার ঋণের দায় পরিশোধ এড়াতে ব্রিটেন ছেড়ে ফ্রান্স পালিয়ে যাওয়ার কারণে। এতে ব্যাংকগুলো দায় পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে মর্মে আতঙ্কিত হয়ে আমানতকারীরা ব্যাংকগুলোতে টাকা উত্তোলনে হুমড়ি খেয়ে পড়েন।

বাংলাদেশে গত এক দশক সময়ে অনেক শীর্ষ বেসরকারি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানা সুনির্দিষ্ট কয়েকটি গ্রুপের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। এর আগে ’৮০-এর দশকের শেষে আর্থিক খাতে সংস্কার বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যাংক মালিকানা ও ঋণ প্রদান কিছুসংখ্যক ব্যক্তি বা গ্রুপের হাতে চলে যাওয়া এবং খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত দৃঢ ভিত্তি লাভ করে এবং বেসরকারি খাতের বেশ কিছু ব্যাংক দীর্ঘ মেয়াদে শিল্প কারখানায় বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয়। গত এক দশকে নানামুখী চাপের মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিমালা শিথিল করার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার কারণে সূচিত সংস্কার উদ্যোগ অকার্যকর হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চাপের মুখে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানার পরিবর্তন ঘটিয়ে বিশেষ কয়েকটি গ্রুপের হাতে তুলে দেয়া হয়। এই গ্রুপগুলো নামে বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ব্যাংকের বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের বড় অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে একটি গ্রুপই নামে বেনামে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ঋণ গ্রহণ করেছে বলে জানা যাচ্ছে। এর বাইরে পরবর্তী বৃহৎ ৯টি গ্রুপের নেয়া ঋণ হবে এর সম পরিমাণ। অর্থাৎ বড় ১০ গ্রুপের নামে বেনামে নেয়া ব্যাংক ঋণ মোট ঋণের এক-তৃতীয়াংশের মতো। আনুষ্ঠানিক তথ্যে এর কোনো কিছু জানা যাচ্ছে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকারের অন্যান্য অনুসন্ধানকারী সংস্থার অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে আসছে।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের এসব বৃহত্তম নিয়ন্ত্রক ও ঋণগ্রহীতা যে পরিমাণ অর্থ আর্থিক খাত থেকে গ্রহণ করেছেন দেশের অভ্যন্তরে তার কতটা বিনিয়োগ হয়েছে তা অনুসন্ধানসাপেক্ষ। এ ধরনের শীর্ষ গ্রুপের পক্ষে কোনোভাবেই গ্রহণ করা ঋণ বা বিনিয়োগ ফেরত দেয়ার অবস্থা দেখা যায় না। আর নেয়া ঋণের বৃহদংশ বেনামে গ্রহণের ফলে এ নিয়ে মামলা মোকদ্দমায় সামনে চলে আসবে যাদের নাম এ ঋণ নিতে তাদের কেবল ব্যবহার করা হয়েছে। এর সাথে ঋণ অনুমোদনের সাথে যুক্ত ব্যাংকাররা এর শিকার হবে যাদের অনেকেই পরিচালকদের চাপের মুখে ঋণপ্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পেশ বা পাস করতে বাধ্য হয়েছেন।

এখনকার বাস্তব অবস্থা হলো ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণ নেবার মতো নিয়ন্ত্রণ এ ধরনের গ্রুপের হাতে আর না থাকলে গৃহীত ঋণ ফেরত দেয়ার চাপ আসবে। এতে একের পর এক ঋণ বা বিনিয়োগ খেলাপি হয়ে পড়বে। আর সে চাপের মুখে আলেকজান্ডার ফোর্ডিসের মতো শীর্ষ ঋণগ্রহীতা বিদেশ পালালে এর প্রভাব ব্যাংক খাতে কতটা পড়তে পারে তা অনুমান করাও কষ্টকর। সরকারের অর্থনৈতিক নীতিপ্রণেতারা এই চিত্র সম্পর্কে অনবহিত বলে মনে হয় না।

১৯২৯ সালের মহামন্দায় ওয়ালস্ট্রিট ক্র্যাশ করা ছিল মূল কারণ। শেয়ারবাজারে ধস নামার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশেও একাধিকবার হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পুঁজিবাজারের আধিপত্য না থাকায় তা অর্থনৈতিক ধসের কারণ হতে পারেনি। তবে ব্যাংকিং খাতের অনাহূত পরিস্থিতি ও অন্য সূচকগুলোর বিপর্যয়ের সাথে শেয়ারবাজারের অবস্থা যুক্ত হওয়ার পর অবস্থার সামগ্রিক পতন ত্বরান্বিত হবে।

বাংলাদেশে ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে দ্বিতীয় দফা বিপর্যয়ের কারণে নতুন শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা বা বিদ্যমান উদ্যোগের সম্প্রসারণে শেয়ারবাজার তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। ২০০৬-০৭ সালের শেয়ারবাজার বিপর্যয়ে পুঁজি হারানো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা দ্বিতীয় দফা তাদের পুঁজি হারান ২০১০-১১ সালে। এরপর শেয়ারবাজারে উত্থান-পতনের নানা ঘটনায় এটি কোনো সময়ই কার্যকর হয়ে উঠতে পারেনি। সর্বশেষ পুঁজিবাজারে মূল্যসূচক কমতে কমতে লেনদেন নেমে এসেছে তলানিতে। যত সময় যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই খারাপের দিকে যাচ্ছে।

অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটার ইতিহাসে বিনিময় হার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই বিনিময় হারে থাকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ভারসাম্যের বিশেষ ভূমিকা। সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্যঘাটতি আর সার্বিক লেনদেনের ঘাটতি দুটোই বাড়ছে। বাণিজ্যঘাটতি বাড়ছে রফতানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কারণে। আমদানিও কমছে, তবে সে তুলনায় কম। আর রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির ধারা কিছুটা বজায় থাকায় চলতি লেনদেনের ঘাটতি বিপজ্জনক পর্যায়ে যায়নি। তবে জনশক্তি রফতানির হার কমে যাওয়ায় সামনে রেমিট্যান্সেও নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যেতে পারে।

করোনাভাইরাসের কারণে নতুন এক পরিস্থিতি দেখা যেতে পারে। বিশ্ববাজারে চীনের পণ্যের চাহিদা এতে কমে যাবে। তবে একই সাথে বৈশ্বিক বাজারের সার্বিক চাহিদাও কমে যাচ্ছে, যার ফলে সার্বিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের রফতানি আয়ে নেতিবাচক অবস্থা লক্ষ করা যাচ্ছে। বাণিজ্যযুদ্ধ এবং করোনা আতঙ্কে চীনের সঙ্কুুচিত হয়ে যাওয়ার সুবিধা রফতানিবাজারে বাংলাদেশ নিতে পারছে না, যতটা নিচ্ছে ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো। ভিয়েতনাম শিগগিরই পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে শীর্ষে উঠে যেতে পারে। অন্য দিকে, করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগে ধীরগতি নেমে এসেছে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার অন্তঃপ্রবাহ কমতে পারে। আর আগামী বছর থেকে অনেক চীনা প্রকল্পের বহির্মুখী দায় পরিশোধ শুরু হবে। সব মিলিয়ে একটি বড় আকারের বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্কট অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় বাংলাদেশ এর প্রভাব কাটাতে পেরেছিল। এর একটি কারণ ছিল বাংলাদেশের তখন বায়ার্স ক্রেডিট ছিল কম। বৈদেশিক দায়দেনা পরিশোধের চাপ বেশি ছিল না। এখন সেই পরিস্থিতি আর নেই। গত ১০ বছরে চীনসহ আরো কয়েকটি দেশের ব্যয়বহুল বায়ার্স ঋণে অনেক বড় আকারের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সেই সাথে বেসরকারি খাতকে সরকারের সভরেন গ্যারান্টিতে বিদেশী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। ফলে ১৯৯৮ সালের মতো এশীয় অর্থনৈতিক সঙ্কটের মতো বাংলাদেশ ঘিরে কোনো আস্থাহীনতা দেখা দিলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ঋণ শোধে চাপ বাড়াবে। সে ধরনের পরিস্থিতিতে গ্রিসের মতো বিদেশী দায় পরিশোধে পুরো রাষ্ট্র খেলাপি হওয়ার উপক্রম হতে পারে। বাংলাদেশের কাছে প্রতিবেশী ভারত চীনসহ বিভিন্ন বাণিজ্য অংশীদার দেশে যেভাবে সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে তাতে বাংলাদেশ বড় কোনো সঙ্কটে পড়ে যেতে পারে। এখন যে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাংলাদেশের রয়েছে, তা দিয়ে কোনোভাবেই এই সঙ্কট মোকাবেলা করা যাবে না।

বাংলাদেশে অর্থনীতির বাইরে থেকে যে ধরনের চাকচিক্য তৈরি করা হয়েছে তার সাথে ভেতরের বাস্তব অবস্থার তুলনা করলে একধরনের শূন্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উপরে যেসব অর্থনৈতিক সঙ্কটের উল্লেখ করা হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই সঙ্কটের প্রাক্কালে বাংলাদেশের মতো এ ধরনের রমরমা অবস্থা ছিল। এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বলে দেখানো হচ্ছে। অথচ শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকারের হার বাড়ছে। কর্মবাজারে যেভাবে জনশক্তি যোগ দিচ্ছে সে তুলনায় কাজ সৃষ্টি হচ্ছে না। বাজেট ঘোষণার সময় এর যে আকার নির্ধারণ করা হয়েছে এখন তা ঠিক রাখা যাচ্ছে না। ৪৬ শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৪-৫ শতাংশ রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ফলে গড়পড়তা ২০ শতাংশ বাজেট কাট করার জন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

সরকারের আয় পরিস্থিতি যা তাতে নতুন বছরে বাজেটের ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কঠিন হতে পারে। এর মধ্যে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আসলেই কত ছিল তা নিরূপণ করার জন্য উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ সরকারকে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতির সূচকগুলো যে এত খারাপ অবস্থায় পড়েছে তা সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হচ্ছে না। স্বীকার করলে এই সমস্যা সমাধানের বিষয়টি আলোচনায় আসত। বাংলাদেশ যে মন্দায় পড়েছে, আর্থিক খাতের সামনে যে বিপর্যয় অপেক্ষা করছে, বৈদেশিক খাতে যে নেতিবাচক আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তা উপলব্ধি করা হলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। তা না হলে দেশের অর্থনীতি আরো চাপের মুখে পড়বে। অর্থনীতির সুনামি সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিকেও গ্রাস করতে পারে।

[email protected]