বিশ্বব্যবস্থায় চীনের উত্থানের উল্টাদিক

আনু মুহাম্মদ :

বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় এককালের সমাজতান্ত্রিক চীন ক্রমেই শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও তার প্রভাব ক্রমবর্ধমান। ইদানীং তার রাজনৈতিক অবস্থানও দেখা যাচ্ছে। এক সময়ে বিপ্লবী রূপান্তর এবং তার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে পুঁজিবাদী বিশ্বের অংশীদার পরাশক্তি হওয়ার এই ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে এক নতুন অভিজ্ঞতা।

১৯৯০-এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র সাম্রাজ্যিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। নিশ্চিত হয় পুঁজিবাদের একক বৈশ্বিক ব্যবস্থার পথ। একে ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ব্যাপক প্রচার করা হলেও দেশে দেশে দেখা দিতে থাকে ভিন্ন যাত্রা। দেখা যায়, এর মধ্য দিয়ে সারাবিশ্বের অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী, নিপীড়ক, যুদ্ধবাজ শক্তিগুলোরই মতাদর্শিক বিজয় সূচিত হয়েছে। পরাজিত হয়েছে তাদের জন্য এতদিনকার মতাদর্শিক ও শারীরিক বাধা। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে শুধু যে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের পুনরুজ্জীবন ঘটেছে; তাই নয়; বৈষম্য ও নিপীড়নের নানা রূপ আরও জোরদারভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নতুন উদ্যমে বিশ্বব্যাপী ঝাঁপিয়ে পড়েছে যুদ্ধবাজ ও গণবিরোধী সব ধরনের শক্তি।

বিশ্বব্যবস্থায় এসব পরিবর্তনে চীন রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে তার যাত্রাপথে কোনো পরিবর্তন আনেনি। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে কোনো অবস্থানও গ্রহণ করেনি। বরং নানাভাবে এর সঙ্গে সমন্বয় করতে চেষ্টা করেছে। সেই সঙ্গে চেষ্টা করেছে পরিবর্তিত ব্যবস্থার সঙ্গে মানানসই হিসেবেই নিজেকে সজ্জিত করতে। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে এই এককেন্দ্রিক শক্তির সঙ্গে দরকষাকষির ক্ষমতা যে কমে গেছে– তা চীন টের পেয়েছে প্রথম থেকেই।

চীন যে অবরোধ তোলার জন্য ১৯৯০ সাল থেকে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করে, তার কিছু প্রামাণ্য বিবরণ দিয়েছেন হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর চীন নিয়ে লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে। ধারাবাহিক দেনদরবারের পর মার্কিন প্রশাসন অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও, বিশেষত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবরোধ শিথিল করে। প্রকৃতপক্ষে মার্কিন প্রশাসনের মধ্যে চীনপন্থি এবং চীনবৈরী দুটো প্রবণতাই আছে। বলাই বাহুল্য, এর সঙ্গে চীনে মার্কিন ব্যবসায়িক স্বার্থের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ।

পুঁজিমুখী সংস্কারের মধ্য দিয়ে চীন দ্রুত পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার শক্তিশালী অংশীদারে পরিণত হয়েছে গত কয়েক দশকে। চীন যে খুব দ্রুত এবং ধারাবাহিকভাবে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করে সবাইকে বিস্মিতই করেনি; খুব দ্রুত একটি ছোট কিন্তু খুবই সম্পত্তিশালী গোষ্ঠী গড়ে তুলে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। এই নতুন এলিট গোষ্ঠী চীনে তাইজিদাং নামে পরিচিত। এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রবাসী চীনা পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত, অনেকেই বিদেশে শিক্ষাপ্রাপ্ত, ব্যবসায় বিশেষ আগ্রহী এবং সফল। চীনা পার্টি প্রশাসনের সঙ্গে এরা যে খুবই ঘনিষ্ঠ, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বিভিন্ন হিসাবে দেখা যায়, চীনে বিপুল সম্পদশালীর (মার্কিন ডলারে বিলিয়নেয়ার) সংখ্যা এখন প্রায় ৩০০ পার হয়েছে। ১০ বছর আগেও এদের সংখ্যা ছিল ১৩০। একই প্রক্রিয়ায় চীনে মধ্যবিত্তেরও বিস্তার ঘটেছে, তাদের একটি শক্তিশালী ভিত্তি নির্মিত হয়েছে। প্রধানত তাদের ওপর ভর করেই চীনে বিভিন্ন বিলাসসামগ্রীর বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। মাথাপিছু বার্ষিক  আয় ১৭ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি হলে মধ্যবিত্ত বলে বিবেচিত হয়। চীনে এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এখন ১০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারও সম্প্রসারিত হয়েছে অনেক। প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের ভোগ্যপণ্যের বাজার এখন চীন।

তবে ১৯৪৯ সালের বিপ্লবের পরপরই অগ্রাধিকার দেওয়া উদ্যোগে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বিস্তৃত নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচিতে চীনের দ্রুত সাফল্য ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা। দীর্ঘ মেয়াদে চীনের জন্য এটি একটি প্রাথমিক ও শক্ত ভিত্তি তৈরি করে। ১৯৪৯ সালে যেখানে শিক্ষার হার ছিল মাত্র ২৮ শতাংশ, তা দুই দশকের মধ্যে ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। শিক্ষার মতো চিকিৎসাক্ষেত্রেও বিপ্লব-উত্তর চীনে বিভিন্ন উদ্ভাবনী পথে বিশাল জনগোষ্ঠীর সুস্থ থাকার অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে কেন্দ্রীয়ভাবে বিপ্লবী ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার আগেই মুক্তাঞ্চলে জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিকাশ ঘটানো হয়েছিল। বিপ্লবের পরপরই তাই সারাদেশে সর্বজনের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। যথেষ্ট সংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তারের অভাবে নগ্নপদ ডাক্তার, ধাত্রীদের দিয়ে বিরাট বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। চীনের লোকজ চিকিৎসা বিকাশের পাশাপাশি তার সঙ্গে আধুনিক চিকিৎসার সমন্বয় করে ক্রমে সবার কাছে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
চিকিৎসাসেবা বিস্তৃত করার পাশাপাশি রোগের কারণ দূর করতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, পরিচ্ছন্নতা ও সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করায় সামাজিক আন্দোলনসহ ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত পার্টি কমিটি ও কমিউন কাঠামো ছিল এসব বিষয়ে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রধান মাধ্যম। সবার আগে সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করার বিষয়টি তো ছিলই– বস্তুত সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই চীনের বিশাল জনসংখ্যার স্বাস্থ্য পরিস্থিতির গুণগত উন্নতি হয়।

বাজারমুখী সংস্কার প্রক্রিয়ায় কমিউনের সঙ্গে সঙ্গে এসব সর্বজনকেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিও আর কার্যকর নেই। শিক্ষা ও চিকিৎসাও আগের মতো পুরো রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে বহন করা হয় না। এর অনেক কিছুই এখন বাণিজ্যিক তৎপরতার আওতায়। এসব খাতে অবশ্য রাষ্ট্রীয় ব্যয় এখনও উঁচু। আর উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধির ধরনের কারণে এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং পরিবেশ দূষণ।

চীন এখনও নিজেকে সমাজতান্ত্রিক বলে দাবি করে। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক, না পুঁজিবাদী– তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে তাত্ত্বিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। তবে এতটুকু বলাই যায়, এটি নিশ্চিতভাবে নতুন একটি মডেল উপস্থিত করেছে। চীনা অর্থনীতিকে এখন আর পুরোপুরি কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত বা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি বলা যায় না। কেননা, জিডিপির প্রায় ৭০ শতাংশই এখন আসে অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিমালিকানাধীন কৃষি ও ছোট-বড় বিভিন্ন ব্যবসা থেকে। জমির ওপর ব্যক্তিমালিকানা এখনও স্বীকৃত না হলেও দখলি স্বত্ব আছে। তবে সরকারের ভূমিকা এখনও কেন্দ্রীয়। মূলধনি হিসাব, বিনিয়োগ, মালিকানা হস্তান্তর ইত্যাদিতে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আছে। ব্যাংক ঋণ, বিনিয়োগ গতিমুখ সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত। নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা চীনে এখনও অনেক বেশি। এর মূল ভিত্তি অবশ্য বিপ্লব-উত্তর চীনেই নির্মিত হয়েছে।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক, সর্বজনকথা
পত্রিকার সম্পাদক