পিয়াস সরকার
১৪ অক্টোবর ২০২২, শুক্রবার
যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান করে নেয়। ১০৪টি দেশের এক হাজার ৭৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৬০১ থেকে ৮শ’র মধ্যে। এটি প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের সর্বোচ্চ অবস্থান শিক্ষার বিভিন্ন সূচকের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় এই র্যাঙ্কিং। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হচ্ছে নানা উন্নয়ন প্রকল্প। সরকারের গাঁট থেকে খস্চে কোটি কোটি টাকা। হচ্ছে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, অবকঠামো ইত্যাদি। কিন্তু বাড়ছে না কেবল মান। বাংলাদেশ থেকে র্যাঙ্কিংয়ে স্থান করে নেয়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ। পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তারা দ্বিতীয় এবং বিশ্বব্যাপী অবস্থান ৬০১-৮০০।
এরপর তালিকায় থাকা ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানই ১২০১ থেকে ১৫০০। এগুলো হলো- বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। তালিকায় ৬ বছর ধরে এক নম্বরে আছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এরপরের অবস্থানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যামব্রিজ ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে। ঢাকা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় ৭ বছরের মধ্যে র্যাঙ্কিংয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থান এটি।
২০১৭ সালে তালিকায় জায়গা হয়নি দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের। ২০১৮ সালে এক হাজারেরও পর চলে যায় ঢাবি। ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালেও এক হাজারে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। ২০২২ সালে ঢাবি’র অবস্থান ৮০১-১০০০’র মধ্যে। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশগুলোর র্যাঙ্কিংয়ে দেখা যায় ভারতের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট সাইন্স ২৫১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে। ভারতের ৩৮টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১০০০ এর মধ্যে। পাকিস্তানের কায়দে আজম ইউনিভার্সিটির অবস্থান ৪০১-৫০০। ১০০০ এর মাঝে দেশটির বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা ২১টি। শ্রীলঙ্কার ইউনিভার্সিটি অব প্যারাডেনিয়ার অবস্থান ৫০১ থেকে ৬০০। ১০০০-এ রয়েছে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়। নেপালের ত্রিভূবন ইউনিভার্সিটি ৮০১-১০০০। কয়েকটি মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে এই র্যাঙ্কিং করা হয়ে থাকে। এগুলো হলো- টিচিং (শিক্ষাদান), রিসার্স (গবেষণা), সাইটেশন (গবেষণা ও উদ্ধৃতি), ইন্টারন্যাশনাল আউটলুক (আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি) ও ইন্ডাস্ট্রি ইনকাম (শিল্পের সঙ্গে জ্ঞানের পরিমাপ)। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্যানুযায়ী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৩ ও বেসরকারি ১০৯টি। দেশের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে এই ১৬২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই র্যাঙ্কিংয়ে স্থান পাওয়া ১৫০০’র তালিকার মাঝে রয়েছে ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়। এর বাইরে স্থান পেয়েছে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়।
সব মিলিয়ে এই ১৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮টিই বেসরকারি। এ থেকে অনুধাবন করা যায় দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশ কেন র্যাঙ্কিংয়ে এত পিছিয়ে? বাংলাদেশ সরকার প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। ইতিমধ্যে ৩৪টি জেলায় ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আর কাজ চলছে ৭টিতে। বিশ্বদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। ইতিমধ্যে ৩৪টি জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৫৮টি। আর ৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাজ চলমান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি শিক্ষার মান। গড়ে তোলা হয়নি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষানীতি। শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নের চেয়ে অবকাঠামো ও নিয়োগেই বেশি তৎপর প্রশাসন। আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ধরনের অবকাঠামো উন্নয়ন কিংবা শিক্ষক নিয়োগ ছাড়াই ভর্তি করছে শিক্ষার্থী। গবেষণা নিয়েও আছে নানা সমালোচনা। ইউজিসি’র তথ্যানুযায়ী দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় অনেক পিছিয়ে। অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বছরজুড়ে এক থেকে দু’টির বেশি জার্নাল প্রকাশ করতে পারেনি। এ ছাড়াও এই শিক্ষকরা বিভিন্ন স্থানে ক্লাস নেয়ার কারণে গবেষণাতে মনোনিবেশ করতে পারেন না। এ ছাড়াও শিক্ষা ও গবেষণায় তীর্যক প্রভাব আসে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি ও স্বজন সখ্যতার কারণে।
এ ছাড়াও শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যার অনুপাতের তারতম্য রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কক্ষে ৫০ জন শিক্ষার্থীর সংখ্যা মানসম্মত সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ১০০ থেকে ১৫০ জন শিক্ষার্থীও। আবার প্রতি ২০ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক থাকা প্রয়োজন। ইউজিসি’র তথ্যানুযায়ী, ৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৯৫৭ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছে ১৫ হাজার ১৯৪ জন। কিন্তু এই শিক্ষকদের প্রায় ৩ হাজার রয়েছেন বিভিন্ন ছুটিতে। ইন্ডাস্ট্রি ইনকামের দিক থেকেও পিছিয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামের কাজ নিয়ে কথা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। ২০২২ সালে এসেও সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি কারিকুলাম। এ ছাড়াও অভিযোগ আছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কারিকুলাম সংশোধনের জন্য ইউজিসি’র কাছে দীর্ঘ সূত্রীতায় পড়ে যায়। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মৌলিক কিছু বিষয়ে অধিক পরিমাণ শিক্ষার্থী পাস করে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলা, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যয়ন শেষ করে কর্মমুখী জীবনের সঙ্গে যোগসূত্র করতে পারছেন না। সার্বিক বিষয়ে জানতে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, র্যাঙ্কিং তারা যেভাবে তৈরি করে এটি মেনে আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিদেশি শিক্ষক, শিক্ষার্থী আসবে না।
আমাদের শিক্ষা জীবনে শেখানো হয় না গবেষণা কী জিনিস। হঠাৎ করে একজন শিক্ষকতা শুরু করলেন তাকে ধাক্কা দেয়া শুরু হয় গবেষণার জন্য। আমাদের গবেষণার জন্য যে অর্থ প্রয়োজন সেটি আমাদের নেই। আমরা জিডিপি’র ২.১ শতাংশ শিক্ষায় পাই। উচ্চ শিক্ষায় এটি অসম্ভব কম। বড় বড় মেগা প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করি অথচ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো আধুনিক করতে পারিনি। যেখানে খাওয়াটা আধুনিক হবে। আমাদের শিক্ষকদের রাজনীতি করতে হয়। না হলে তারা ভাইস চ্যান্সেলর হতে পারবেন না। বিএনপি এখন উচ্চবাচ্য করছে তারা ক্ষমতায় এলে কতো শতাংশ বাজেট দেবে সেটাতো তারা বলছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের বিশাল বিশাল ছবি থাকে সেখানে আমরা এগুবো কীভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে বৃত্তি পান তার থেকে বেশি পান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত অন্তত ৫০টা বৃত্তি দেয়া।
কুদরত-ই-খুদা ৫-৭ শতাংশ জিডিপি’র বরাদ্দের কথা বলেছিলেন। তখন থেকে ৫-৭ শতাংশ আসতো তাহলে আমরা ১০০ এর মধ্যে থাকতাম। র্যাঙ্কিং নিয়ে তিনি আরও বলেন, এত কম বেতনে বিশ্বে জার্মানি ছাড়া কোনো দেশে পড়ালেখা হয় না। নারী শিক্ষার অগ্রদূত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটার প্রতিফলন হয় না। পশ্চিমারা কিছু মানদণ্ড জুড়ে দিলো সেটা নিয়েই আমরা পড়ে আছি। এখানে একটা অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিং নিয়ে চিন্তা করছে। ভাইস চ্যান্সেলর প্রাক্তন ৫ জন শিক্ষককে নিয়ে পরিকল্পনা করেছেন। ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের পরিকল্পনা জমা দেওয়ার কথা। সেভাবে এগুলো আমাদের র্যাঙ্কিং আরও অনেকদূর যাবে। তার জন্য আমাদের দাবি জানাবো এর জন্য বাজেট বাড়াতে হবে।