দলছুটদের কিংস পার্টিকে কেউ বিশ্বাস করে না : আল মাসুদ হাসানুজ্জামান

ড. আল মাসুদ হাসানুজ্জামান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। তিনি ব্রিটিশ কাউন্সিল স্কলার, সিনিয়র ফুলব্রাইট স্কলার এবং জাপান ফাউন্ডেশনের ফেলো। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, বর্তমান পরিস্থিতি ও সামনের নির্বাচন নিয়ে প্রথম আলো তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ সাবিহা আলম

নির্বাচন এলেই অচলাবস্থা। এটা কেন?

আল মাসুদ হাসানুজ্জামান: নির্বাচন নিয়ে যে অচলাবস্থা, সেটা বাংলাদেশের জন্য নতুন নয়। এর অন্যতম কারণ গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করতে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধানের পথে হেঁটেছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে একটা তিন দলের রূপরেখা হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলো সেটা আর অনুসরণ করেনি। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোটের মাধ্যমে। নির্বাচনের পরই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্দিষ্ট ধারার রাজনীতিতে চলে যায়। পরবর্তী বছরগুলোয় তারা পরস্পরবিরোধী রাজনীতির ধারা জিইয়ে রাখে। তিন জোটের যে রূপরেখা, তা বাস্তবায়নের কোনো পথই তারা খোলা রাখেনি।

বামপন্থীরা তিন মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে প্রস্তাব করেছিল, সেটাও টেকেনি। তবে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নির্বাচনের চেষ্টা আওয়ামী লীগ সফল হতে দেয়নি। ফলে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। মোটামুটিভাবে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই ব্যবস্থা অব্যাহত ছিল এবং ক্ষমতাসীন দলকে প্রতিবারই আমরা হারতে দেখেছি। এরপর তো পঞ্চদশ সংশোধনী এল এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ব্যবস্থা, সেটা রহিত হয়ে গেল। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিল না। নির্বাচনকে ঘিরে যে রাজনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি, গণতন্ত্রের যে ক্ষতি, সেটা এখনো ভোগ করছি আমরা। ২০১৮ সালের নির্বাচনও গ্রহণযোগ্য হয়নি। এর মধ্যেই আবার আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আমি বলব, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচনী ব্যবস্থা, সেটা ছিল খণ্ডিত সংস্কার ছিল। এই মুহূর্তে নির্বাচনকেন্দ্রিক যে বিপরীতমুখী অবস্থান দুটি দলের, তাতে সমস্যা সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি কি দল হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? আর ভোটাররা?

আল মাসুদ হাসানুজ্জামান: দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে নির্বাচনের ফল কী হবে, সেই বিবেচনা থেকে বিএনপি অংশ নেয়নি। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নির্বাচন হলে ফল সব সময় দলের পক্ষে যায়, তারা এই ধারণা মাথায় রেখেছিল। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু তখন ছাড় দিতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন তাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেওয়া হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচনী প্রক্রিয়া কতটুকু প্রভাবমুক্ত থাকবে, সেই সন্দেহ ছিল বিএনপির। সর্বোপরি বিএনপির প্রধান দাবিই ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ দাবিতে তারা কোনো ছাড় দেয়নি। আমরা সে সময় নৈরাজ্য দেখেছি। এখনো আমরা নৈরাজ্য দেখছি।

আর এই নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য এক দল অন্য দলকে দোষী করছে। সুযোগসন্ধানী কোনো গোষ্ঠী বা সন্ত্রাসীরা এই সুযোগ নিতে পারে। ২০১৪ সালের নৈরাজ্য সরকার কঠোর হাতে দমন করেছে। বিএনপি সে সময় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে আসতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান দুটি দলেরই লক্ষ্য হলো যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া এবং তা ধরে রাখার চেষ্টা করা। এ ব্যাপারে দুটো দলের কেউই কারও চেয়ে কম যায় না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে সরে আসা, সংসদে কথা বলতে না দেওয়াসহ নানা অভিযোগ আছে দুটি দলের বিরুদ্ধেই। এই ধরনের সংস্কৃতিতে ২০১৪ সালে বিএনপি কীভাবে নির্বাচনে আসত? তারা সে পথই মাড়ায়নি। এতে বাংলাদেশের ভোটাররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কারণ তাঁরা ভোট দিতে পারেননি।

কিন্তু ২০১৮–তে তো বিএনপি আবার নির্বাচনে ফিরে গেল? এখনই–বা তার কী অবস্থা?

আল মাসুদ হাসানুজ্জামান: ২০১৪ সালে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সেই সরকার সংহতও হয়। ফলে তারা আর পরে কোনো নির্বাচন দেয়নি। ২০১৮ সালে বিএনপির কাছে কোনো বিকল্প ছিল না। নির্বাচনে না গেলে নিবন্ধন হারাত। নির্বাচনে গিয়েও যে তারা খুব ভালো করেছে তা নয়। তবে সে নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। বিএনপি ২০১৮ সালের পর থেকে সভা–সমাবেশ করতে পারেনি। নমনীয় পদক্ষেপ দেখলাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে যখন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো। এর পর থেকে তারা সভা–সমাবেশ করেছে।

তাদের এলাকায় যেতে পেরেছে। কিন্তু এক দাবিতেই অনড় আছে। সেটা হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। মানুষ কিন্তু ভেবেছিল যেহেতু মাঠের বিরোধী দল এখন সভা–সমাবেশ করতে পারছে, হয়তো দুই দলের মধ্যে একটা সমঝোতা হবে। মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিল। পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে চাপ এখনো আছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের পরামর্শ সরকার আর ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দল আবারও কঠোর অবস্থানে চলে গেছে। যার ফলশ্রুতিতে দেখা গেল ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে পারল না। নেতৃস্থানীয়দের অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল, তারা গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা কতটা জারি রাখতে পারল?

আল মাসুদ হাসানুজ্জামান: বাংলাদেশের রাজনীতি দুই দলভিত্তিক। হয়তো জোট আছে, কিন্তু রাজনীতি কোন পথে যাবে, তার নির্ণায়ক এই দুটি দল। ১৯৯১ সালের পর থেকে নির্বাচিত কর্তৃত্ববাদ শুরু হয়েছে। সর্বসম্মতভাবে সংসদীয় গণতন্ত্র হলো ঠিকই, কিন্তু সংসদীয় ব্যবস্থাকে চালু রাখার যে শর্তগুলো যেমন সংসদকে ক্রিয়াশীল রাখা, সংসদের ভেতরে তদারকিমূলক কর্মকাণ্ড রাখাসহ আরও কিছু পূর্বশর্ত, সেটি অনুসরণ করা হয়নি। ফলে শুরু থেকেই কাঠামোগত একটা সমস্যা ছিল। এটা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। সংসদে বিরোধী দলের মাইক বন্ধ করে দেওয়া, সংসদে স্পিকারের পক্ষপাতমূলক আচরণ, সংসদীয় কমিটিগুলো যথাসময়ে গঠন না করাসহ নানা সমস্যা ছিল।

পঞ্চম সংসদ ব্যস্ত ছিল অধ্যাদেশগুলো নিয়মিতকরণে। দেখা গেল সংসদে বিভিন্ন বিলের ওপর পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হচ্ছে না। কমিটিতে বিল বিবেচনায় থাকা অবস্থায় পাস হয়ে গেছে। ফলে সেখানে অপারেশন ক্লিন হার্টের মতো ঘটনা ঘটেছে। আমরা নির্বাচিত সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচরণ দেখেছি। বিরোধী দলও সংসদ চালুর প্রথম দিকে যে সহযোগিতা করেছে, সেটা আর অব্যাহত রাখেনি। তারা সংসদ বর্জন করেছে। তারা যে সময়টায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছে, সে সময়টায় আর সংসদে ফিরে আসেনি। ফলে সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়ে। পরবর্তী সংসদগুলোতেও আমরা একই ধরনের আচরণ অব্যাহত থাকতে দেখি। ফলে আমরা একটা হাইব্রিড ডেমোক্রেসি দেখতে পেলাম। যা দেখতে পাচ্ছি তা হলো কর্তৃত্বপরায়ণতা এবং গণতন্ত্রের মিশেল। নামে গণতন্ত্র হলেও কাজে আমরা কর্তৃত্বপরায়ণতা দেখতে পাই।

আপনি কি বলতে চাইছেন শুরু থেকেই গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের কাজটা ঠিকঠাকমতো হয়নি?

আল মাসুদ হাসানুজ্জামান: শুধু সরকারি দল নয়, বিরোধী দলও কোনো চেষ্টা করেনি। যদি যুক্তরাজ্যের কথা বলি, বিরোধী দলকে ওখানে বলা হয় হার ম্যাজেস্টিস মোস্ট লয়াল অপজিশন। তারা ছায়া সরকার গঠন করে। তাদের ছায়ামন্ত্রী আছে। তারা সরকারের কার্যক্রম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করে ও বিকল্প দেয়। এর উদ্দেশ্য পরবর্তী নির্বাচনে যেন জনগণ একটা বিকল্প খুঁজে পায়।

বাংলাদেশে এমন কিছু আমরা দেখিনি। ছায়া সরকার নিয়ে আজ পর্যন্ত আমরা কোনো কথা শুনলাম না। আমরা অপজিশন ডে চালুর কথা বলেছিলাম। সেটা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তরপর্ব একটা নতুন সংযোজন। কিন্তু দেখা গেল সেখানে গঠনমূলক প্রশ্নের পরিবর্তে স্তুতি হচ্ছে বেশি। গণতন্ত্র একটি পরিশীলিত শাসনব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাকে ধরে রাখতে হলে সংসদীয় রীতিনীতি প্রণয়ন, আন্তরিকতার সঙ্গে তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এর অনুপস্থিতি আমরা দেখলাম। বিশেষত, দুই দলের বিপরীতমুখী অবস্থান সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির লালনে সহায়তা করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশ কি আমাদের মতো সমস্যায় পড়েছে?

আল মাসুদ হাসানুজ্জামান: আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। তাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা খুবই শক্তিশালী। সেখানেও অর্থ ও পেশিশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক কালে একধরনের ধর্মভিত্তিক আদর্শ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যার প্রভাব পড়েছে রাজনীতিতে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের আমরা একচেটিয়া প্রভাব দেখছি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী একে দলতন্ত্র বলেছেন। পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আছে। দেশটিতে যেই দলই সরকার গঠন করুক, সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকতে হবে। মালদ্বীপে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। ভোটে জনমতের প্রভাব পড়েছে। মালদ্বীপের রাজনীতি আমাদের মতো নয়। বাংলাদেশের মতো এত সমজাতীয় এবং একই সঙ্গে রাজনীতিতে এত দ্বান্দ্বিক ও সাংঘর্ষিক কোনো দেশ নেই।

নেপালে বিপ্লবের পর রাজতন্ত্র রহিত হয়েছে। তারপর তারা গণতন্ত্রের পথে গেছে। মাওবাদীরা ক্ষমতায় এসে নানা সংস্কার করেছে। এর একটি হলো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব। এ ব্যবস্থায় সংসদে শুধু বড় দল নয়, ছোট দলগুলোরও প্রতিনিধিত্ব থাকে। এই মিশ্র ব্যবস্থা জাপান, জার্মানিতেও আছে। বাংলাদেশের মানুষের দুটো দলের বাইরে বেরোনোর ক্ষমতা নেই। এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে হলে বাংলাদেশেও মিশ্র ব্যবস্থা চালু করা যায়। দুটোই থাকুক, প্রয়োজনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হোক আংশিক। এতে করে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। সামাজিক বৈচিত্র্য, কথিত ‘সংখ্যালঘু’দের প্রতিনিধিত্ব (কথিত কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো নাগরিককেই সংখ্যালঘু বলার সুযোগ নেই) থাকে সংসদে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের কথা আমরা বলার চেষ্টা করছি। বিভিন্ন গবেষণায় বলার চেষ্টা করেছি। দলগুলো কর্ণপাত করেনি।

পৃথিবীর আর কোনো দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের মতো? না বাংলাদেশ ‘অতুলনীয়’?

আল মাসুদ হাসানুজ্জামান: নির্বাচনে অনিয়ম হচ্ছে এমন আরও দেশ আছে। যেখানে স্যাংশনগুলো দেখতে পাই, সেখানে আমাদের মতো পরিস্থিতির কিছু কিছু মিল আছে। স্যাংশনের কী প্রভাব পড়েছে, তা নিয়ে অবশ্য ধোঁয়াশা আছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমনকি অস্ট্রেলিয়া সরকারও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা বা মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয় কিছু শর্ত উপস্থিত থাকলে। যেমন যে দেশ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সে দেশের সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা প্রদানকারী দেশের স্বার্থ কতটুকু। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো যদি ওই দেশগুলোর ওপর নির্ভর করে, তাহলে তাদের নির্দেশ মেনে চলতে হয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা আইএমএফের ঋণের কথা বলতে পারি।

আমাদের দেশের রাজনীতিতে বাইরের শক্তির প্রভাব কতটুকু?

আল মাসুদ হাসানুজ্জামান: শুরুতে তো মনে হয়েছিল তাদের কথার প্রতিফলন ঘটছে। কিন্তু এখন সরকার হার্ড লাইনে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আমরা এখনো কিছু কিছু পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি। তারা সংলাপ ও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার কথা বলছে। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে। এখন তো আর এক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা নেই। চীন, রাশিয়াও এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। তাদের প্রভাব প্রশমন এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাজনিত অগ্রাধিকার। পশ্চিমারা বাংলাদেশে কোনো অস্থিতিশীলতা চায় না। ওই অক্ষ থেকে তারা বাংলাদেশকে দূরে রাখতে চায়। ভারতকে অগ্রাহ্য করে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগ এখানে ফলপ্রসূ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের নিরাপত্তাজনিত স্বার্থ এক। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখন আর ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখছে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে সাপ্তাহিক ব্রিফিং করছে, সেখানে আমরা দেখছি কর্মকর্তারা সরাসরি বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলছেন। বাংলাদেশকে নিয়ে স্বতন্ত্র বিবেচনা আমেরিকার আছে। তারা চায় যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা মানবাধিকারের যে কথা তারা বলছে, সেটা যেন বাংলাদেশে বাস্তবায়ন হয়।

নির্বাচন কমিশন বলছে তারা দ্রুত তফসিল ঘোষণা করবে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী, বিএনপি বলছে তাদের দল ভাঙার চেষ্টা চলছে, আমরা ভুঁইফোড় কিছু রাজনৈতিক দলের উত্থান দেখছি। এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যেই কি কমিশন নির্বাচন করার দিকে এগিয়ে যাবে?

আল মাসুদ হাসানুজ্জামান: নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক বিধিবিধান মেনে চলে। একটি সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা আছে তাদের জন্য। এখন অপেক্ষা সমঝোতার জন্য অলৌকিক কিছু ঘটার। সমঝোতা না হলে আবারও একতরফা নির্বাচন হতে পারে। কিংস পার্টি হচ্ছে, দলছুটদের নিয়ে নতুন নতুন দল হতে দেখছি আমরা। তাদের কেউ বিশ্বাস করে না। কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট আলাদা। ভোটাররা দেখবে এই দলগুলোর জনভিত্তি কতটুকু আছে, তারা ক্ষমতাসীনদের বিপরীতে কতটা জোরালো অবস্থান নিয়ে দাঁড়াতে পারবে—এসব। যাদের জনসমর্থন আছে তাদের যদি নির্বাচনে আনা না যায়, তাহলে একতরফা নির্বাচন হবে। এতে করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চর্চা সমস্যাসংকুল হবে।

কিংস পার্টির উত্থান তো এবারই প্রথম নয়? এগুলোর স্থায়িত্ব হয় কেমন?

আল মাসুদ হাসানুজ্জামান: এরশাদ আমলে চতুর্থ সংসদের নির্বাচনে ৭৬টা দল মিলে কিংস পার্টি করেছিল। আ স ম আবদুর রব ছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা। এই দলগুলোর কী অবস্থা হয়েছে, আপনারা দেখেছেন। আমরা এমপিদের বেচাকেনা দেখেছি। পাকিস্তানের ১০ বছরে সাতবার এমপি কেনাবেচা হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী যখন ক্ষমতা ছাড়লেন, তখন জোট হয়েছে। স্থায়ী হয়নি। এদের সাধারণ জনগণ সুদৃষ্টিতে দেখে না। মানুষ এ দলের নেতা–কর্মীদের দলত্যাগী বলে মনে করে।

দল হিসেবে বিএনপির ভবিষ্যৎ কী?

আল মাসুদ হাসানুজ্জামান: দল হিসেবে বিএনপির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ক্ষমতাসীন দলের ওপর। বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষমতাসীন দল কতটুকু পর্যন্ত সহ্য করবে, তা এখন বিবেচ্য। অপরদিকে সরকার দলের বদান্যতার সুযোগ আছে, সবাই প্রত্যাশা করে যেহেতু তারা ক্ষমতাসীন, তারা সমঝোতার পথে এগিয়ে আসবে। দুটো পক্ষের কোনোটিই ছাড় দিতে চায় না। বিএনপির ছাড় দেওয়ার সুযোগ থাকত যদি তাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো প্রত্যাহার হতো, গ্রেপ্তার কম হতো। বিএনপির মূল নেতৃত্বও সে অর্থে অনুপস্থিত। যাঁরা হাল ধরেছেন, তাঁরা সভা–সমাবেশ করতে পারেননি। তারপরও বিএনপিকে তাঁরা এক রাখার চেষ্টা করেছেন। নির্বাচন এলে অনেকেই অংশ নিতে চান। কিন্তু তাঁরা তো হাইকমান্ডের বিরুদ্ধে যেতে পারবেন না। ধরপাকড়ের পর দলটি আরও নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে। হরতাল ও অবরোধ ছাড়া তাদের হাতে কিছু নেই। তাদের জন্য যে জনসমর্থন আছে, সেটা তারা কীভাবে কাজে লাগায়, এটাই দেখার বিষয়। আবার হরতাল–অবরোধ দীর্ঘদিন চললে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সমঝোতার কোনো উদ্যোগ কি দেখতে পান? আমাদের ভবিষ্যৎ কী?

আল মাসুদ হাসানুজ্জামান: রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশে কখনোই সমঝোতার পথে হাঁটেইনি। এর আগেও বিদেশিরা চেষ্টা করেছেন। নাগরিক সমাজের কথা যদি বলি, তাঁরাও তো পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রান্তিকালের শুরু হয়েছিল আগেই, এখন আমরা মহাসংকটের দিকে যাচ্ছি। তফসিল ঘোষণার আর দেরি নেই। সংকট সমাধানের পথ বহুদূর।

প্রথম আলো