বিরোধী রাজনীতির হাতে হাতকড়া, পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি

  • মো: হারুন-অর-রশিদ
  •  ০২ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:১৯

একটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য সংবিধান মেনে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা প্রথম ও প্রধান কাজ। গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনগণের কল্যাণে কাজ করবে, এটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। কল্যাণরাষ্ট্র জনগণের অধিকারকে সর্বাগ্রে মূল্যায়ন করে। আমাদের দেশের সরকার কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দেয়। সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করার ব্যাপারে একেবারেই নারাজ। সরকারের হাবভাব দেখে মনে হয়, তাদের মতো জনকল্যাণকর সরকার বুঝি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। সরকার মনে করে, দেশের নাগরিকরা শুধু শুধু ঝামেলা করে আর সরকারের গায়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করে। নাগরিকের এই কর্ম করা খুবই অন্যায়। সরকার তো চায়, দেশের সব নাগরিক সুখে-শান্তিতে থাকুক। আর এই সুখে শান্তিতে রাখতে গিয়ে যদি সরকারকে স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়, তাতে সরকারের দোষ কোথায়?

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করা হয়েছিল। সব বিবেচনায় বাকশাল প্রতিষ্ঠা ছিল গণতান্ত্রিক অধিকারকে নস্যাৎ করা; কিন্তু যারা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছেন তারা বলছেন, এটি করা হয়েছিল মানুষের কল্যাণের জন্য।

আজকে তাবৎ দুনিয়ার মানুষ বলছে বাংলাদেশে কোনো গণতন্ত্র নেই। ভোটের অধিকার নেই। বাকস্বাধীনতা নেই। আইনের শাসনের লেশমাত্র উপস্থিত নেই। বিচারকের কলমের স্বাধীনতা নেই। বিরোধী রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক অধিকারকে পদে পদে লাঞ্ছিত করা হয়। সভা-সমাবেশের স্বাধীনতাকে পুলিশের লাঠিতে লণ্ডভণ্ড করা হয়। অথচ সরকার বলছে, তারা নাকি গণতান্ত্রিক সরকার। তারা নাকি মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করছে। ভোটের অধিকারের ব্যাপারে সরকারের বক্তব্য এই দিক দিয়ে সত্য, তারা জনগণকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে কষ্ট দিতে চায় না। যার কারণে জনগণের ভোট তারা নিজেরাই দিয়ে দেয়। বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না, কারণ তারা রাস্তাঘাট বন্ধ করে জনভোগান্তির সৃষ্টি করে। সরকারি দল সভা-সমাবেশ করার সময় জনসমাবেশের আশপাশের কয়েক কিলোমিটার রাস্তা সারা দিন বন্ধ থাকলেও সেখানে জনগণের কোনো ভোগান্তি হয় না। কারণ এটি সরকারি দলের সভা-সমাবেশ। আর এই অধিকার কেবল তাদেরই আছে।

ভাগ্য ভালো, লগি-বৈঠা দিয়ে আওয়ামী লীগের লোকেরা মানুষ পিটিয়ে হত্যা করে লাশের উপর লাফালাফি করেছে। দিনে-দুপুরে হাজার হাজার মানুষের সামনে বিশ্বজিৎকে আওয়ামী লীগের লোকেরা কুপিয়ে হত্যা করেছে। এই কর্ম যদি বিএনপি বা অন্য কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দলের লোকেরা করত তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিএনপি-জামায়াতকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে প্রমাণ করার জন্য আওয়ামী লীগের হাতে উপযুক্ত প্রমাণ হয়ে থাকত; যার উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, এক মাগুরা উপনির্বাচনের দোহাই দিয়ে গত ১৪ বছরে দেশের গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাটিকে গিলে ফেলেছে অথচ মাগুরার উপনির্বাচনের অভিশাপ থেকে বিএনপি এখনো মুক্তি পেল না।

আওয়ামী লীগের বক্তব্যের ভাষা ও শব্দ বিশ্লেষণ করলে যেটি বোঝা যায়, দেশে আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্য কোনো রাজনৈতিক দল থাকবে না। আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হাতে পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে তাদের রাজনৈতিক শক্তিকে দমন করা হচ্ছে। একজন রাজনৈতিক কর্মী দেশ গঠনের হাতিয়ার। তাদের সম্মান জানানো উচিত। এর বিপরীতে শুধু সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মী হওয়ার কারণে মামলা দিয়ে তাদের পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হচ্ছে। খোদ আদালতের সামনেই নিত্য দৃষ্টিগোচর হয় এমনই একটি দৃশ্য।

আমাদের সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদে আছে- আইনসম্মত নিরপেক্ষ আদালত কর্তৃক প্রকাশ্য বিচার ব্যতীত কাউকে কোনো ধরনের শাস্তি দেয়া যাবে না। ৩৫ (৫) নং অনুচ্ছেদে বলা আছে- কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাইবে না, কিংবা নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাইবে না। এ ছাড়া আইনসম্মত অধিকার ছাড়া কারো শারীরিক ক্ষতিসাধন সংবিধানের ৩১ ধারারও লঙ্ঘন। জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ কারাবন্দীদের জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে অনুসৃত যে ন্যূনতম নীতিমালা তৈরি করেছে সেখানকার ৩৩ নং অনুচ্ছেদে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোকে অমানবিক বলা হয়েছে। তবে আওয়ামী সরকার এই অমানবিকতাকেই মানবিক আচরণের কাতারে নিয়ে সাধারণ জনগণকে ভয় দেখাচ্ছে যাতে তারা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কথা না বলে। সহজ কথায়, সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে তাদের রাজনৈতিক গতিকে দমিয়ে রাখতে চায়।

এই ডাণ্ডাবেড়ির কাছে মানবতা হয়েছে ধিকৃত, রাজনীতি হয়েছে ঘৃণিত। সভ্যতাকে নামিয়ে আনা হয়েছে আদি বর্বর যুগে। সম্প্রতি মায়ের মৃত্যুর খবরে গাজীপুর জেলা কারাগার থেকে প্যারোলে মুক্তি পান কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো: আলী আজম। তাকে হাতকড়া আর ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে এলাকায় নিজ বাড়িতে মায়ের লাশ দেখতে নিয়ে যায় পুলিশ। স্থানীয়দের অনুরোধেও খোলা হয়নি হাতকড়া-ডাণ্ডাবেড়ি। অথচ জেল কোডের ৭২১ ধারা অনুযায়ী, কেবল দুর্ধর্ষ বন্দীদের নিরাপদ আটক নিশ্চিত করার জন্যে আদালতে পাঠানোর সময়ে পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি লাগাতে হবে। একজন দুর্ধর্ষ অপরাধী, জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর বিধান থাকলেও একজন রাজনৈতিক কর্মীকে কেন ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হবে? জেল কর্তৃপক্ষ হরহামেশা খেয়ালখুশি মতো যেকোনো বন্দীকে ডাণ্ডাবেড়ি পরাতে পারে না। এটি সংবিধান ও বিদ্যমান আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। নিরাপত্তার কারণে এমনটি করা হচ্ছে, এই অজুহাতে একজন রাজনৈতিক বন্দীকে যন্ত্রণা দেয়া বা তার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার এখতিয়ার রাষ্ট্রের নেই। মো: আলী আজম একজন রাজনৈতিক বন্দী; খুনি বা সন্ত্রাসী নন। তিনি সাজাপ্রাপ্ত কোনো কয়েদিও নন। তাহলে তার পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি কেন? কারণ তিনি বিএনপির একজন কর্মী।

কারাগারে ফাঁসির আসামিকেও জামাই আদরে থাকতে দেখেছি। ৩০ মামলার অভিযুক্ত বা অপরাধী রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও দেখেছি জামাই আদরে কোর্টে আনা-নেয়া করতে। তবে তারা বিরোধী দলের কেউ নয়; সরকারি দলের বা সরকারপুষ্ট সরকারি হোমরা-চোমরাদের আত্মীয়স্বজন। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর যে অমানবিক আচরণ করা হয় যেন রাষ্ট্রের চোখে কেবল এরাই অপরাধী। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রত্যেক নাগরিকের সম আইনি অধিকার রয়েছে। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়, একজন নাগরিকেরা যতটুকু সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখেন, তাকে তার প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিকের সেই অধিকারকে নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী- সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। এই সত্যটি সরকারি দল মানতে চায় না। তাদের চোখে বৈষম্যের একপাক্ষিক দৃষ্টি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে যে কায়দায় আটক করা হয়েছে, তা প্রতারণা ছাড়া আর কী হতে পারে? রাতের আঁধারে ডিবির লোকজন তাদের আলোচনার নাম করে ডিবি অফিসে নিয়ে ১১ ঘণ্টা পরে গ্রেফতার দেখানো আইনের শাসনের পরিপন্থী নয় কি? একজন ব্যক্তিকে আটকের তো সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম আছে। তাদের কারাগারে ডিভিশন পেতেও হাইকোর্টের অর্ডারের প্রয়োজন হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন ও সব রকম নিপীড়নমূলক কার্যের মাধ্যমে বিরোধী শক্তিকে ভয় দেখিয়ে গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করার অপচেষ্টা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ানক পীড়াদায়ক হয়ে দাঁড়াবে।

বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমন করার কৌশল হিসেবে ইদানীং মোবাইল চেক করা হচ্ছে। যদি মোবাইলে বিএনপির কোনো নেতা কিংবা পোস্টার বা মিছিল-মিটিংয়ের ছবি পায় তাহলে তার আর নিস্তার নেই। পুলিশ রাস্তাঘাটে পথচারীদের মোবাইল চেক করে বিএনপি সংশ্লিষ্ট কোনোকিছু পেলে তাকে গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এটি একজন নাগরিকের স্বাধীন ইচ্ছার ওপর স্বৈরাচারী হস্তক্ষেপ। একজন আওয়ামী লীগ কর্মীর মোবাইলে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট কোনোকিছু পেলে তাকে কি গ্রেফতার করা হচ্ছে? হচ্ছে না। এভাবে একজন নাগরিকের স্বাধীন ইচ্ছার ওপর হস্তক্ষেপ করা কি সাংবিধানিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ নয়? বিএনপি কি কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন, নাকি নিষিদ্ধ সংগঠন? একটি সরকারের ইচ্ছার কাছে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করা রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজ হতে পারে না। কারণ এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনভাবে সংগঠন করার অধিকার এই দেশের সংবিধানই দিয়েছে; কিন্তু বাস্তবতা হলো- অগণিত জীবনের আত্মদানের মাধ্যমে অর্জিত রক্তস্নাত স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে এখন রাজনৈতিক কর্মীদের কারাগারে জীবন কাটাতে হচ্ছে। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের পদে পদে বিপদের আশঙ্কা হানা দিচ্ছে। রাজনৈতিক অধিকারের কথা বলাটাই বিপজ্জনক। আজকে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক স্বাধীনতার যে দার্শনিক ভূমিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল, স্বাধীনতার পর পরই তা ধ্বংস হয়ে গেছে।

রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে নির্বাচনী ব্যবস্থা ও স্বচ্ছতা, বহুত্ববাদ, রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ, সরকারের নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থা ও ক্ষমতার ব্যবহারসহ নানা বিষয় জড়িত। সত্য কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে এখন কোনো নির্বাচনী ব্যবস্থা নেই। সরকার চায়, নির্বাচনের তারিখ হবে, মনোনয়ন হবে- নিদির্ষ্ট দিনে বা তার আগের দিন রাতে সরকারি দলের লোকজন, পুলিশ আর প্রশাসন মিলে সরকারি দলকে ভোট দিয়ে ইচ্ছামাফিক ফল প্রকাশ করবে। কষ্ট করে জনগণকে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেয়ার প্রয়োজন নেই। আসল কথাটা হচ্ছে, দেশটা এখন কর্তৃত্ববাদের ইচ্ছায় পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।

পরিশেষে বলতে চাই, সরকার শুধু ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসন- এসব মৌলিক প্রশ্নকে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা-বহির্ভূত করে দিয়েছে। জনগণদকে প্রজাতন্ত্রের মালিকানা থেকে বিতাড়িত করেছে। জনগণের ওপর অতিরিক্ত নজরদারি, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ এবং অতিরিক্ত বল প্রয়োগে সরকার রাষ্ট্রকে নিজস্ব সম্পত্তিতে রূপান্তর করেছে যার কারণে বিরোধী দলের রাজনীতিকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে ঠাণ্ডা করার মতো কৌশল সরকার বেছে নিয়েছে। কিন্তু এটি আজ ও ভবিষ্যতের জন্য ভয়ঙ্কর অশনি সঙ্কেত।

[email protected]