বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা যাতে রাজনীতি করতে না পারে সেজন্য তাদের সাজা দিয়ে দূরে রাখতে সরকার নতুন ট্রাইব্যুনাল তৈরি করছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল দুপুরে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন তিনি। গত ৮ই মে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্য্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো এই সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব। মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী সব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই বিরোধী নেতাদের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আইন মন্ত্রণালয় থেকে সুনির্দিষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে কোন কোন মামলায় বিচার হবে, বিনা শুনানিতে। আমরা খবর পাচ্ছি, নতুন ট্রাইব্যুনাল তৈরি করা হচ্ছে। অর্থাৎ উদ্দেশ্যটা হচ্ছে, বিরোধী রাজনীতিকদের কারাগারে বন্দি করে রাখা এবং তাদেরকে রাজনীতি করতে না দেয়া। আর অবৈধ সরকারের সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সাজা দিয়ে কারান্তরীণ করতে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করার জন্য বিচার বিভাগকে ব্যবহার করছে। সম্পূর্ণ বানোয়াট, মিথ্যা এবং গায়েবি মামলায় এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এখানে শুধুমাত্র তারাই রাজনীতি করবে। তার ফলশ্রুতিতে প্রত্যেকটা নির্বাচনে একটা ফল দেখতে পাচ্ছি। তারাই নির্বাচন করছে। তাদের প্রার্থীদের তারাই সিলেক্ট করছেন। ডামি প্রার্থী তারাই নির্বাচন করছেন। আর তথাকথিত বিরোধী দল হিসেবে যারা আছেন, তাদেরকেও তারাই (আওয়ামী লীগ) সিলেক্ট করে দিচ্ছেন এবং আসনগুলোও সিলেক্ট করে দিচ্ছেন। ফখরুল ইসলাম বলেন, তথাকথিত উন্নয়নের দোহাই দিয়ে যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় নৈতিকতা এবং মূল্যবোধকে বিসর্জন দেয়া হয়, জনগণের কাছে সেটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশীয় বিষয়ক সহকারী সচিব ডনাল্ড লু’র ঢাকা সফর এবং প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি আরও বলেন, দেখুন এসব আমাদেরকে জিজ্ঞাসা না করে উনাদের (আওয়ামী লীগ সরকার) জিজ্ঞাসা করুন। এসব নিয়ে আমরা ইন্টারেস্টেড না। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের জনগণের ওপরই আমাদের ভরসা, আমাদের পুরো আস্থা, সেই আস্থার ওপরে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি। রাজনীতিও আমাদের জনগণকে নিয়ে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, একটা কথা আমি বলতে চাই, উনাদের (সরকার) একটা ফল্স ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ওভারকাম দ্যা ক্রাইসিস, সংকট থেকে তারা উপরে উঠে গেছেন।
আমি বলবো, সংকট আরও গভীর করেছে। বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংকট আরও গভীর হয়েছে, সরকারের সংকটও আরও গভীর হয়েছে। যদি এখনো সংকট নিরসনের চেষ্টা না করেন তাহলে ভবিষ্যৎ আপনার জন্য খুব ভালো না। বিশ্ব মা দিবসের দিন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শুধু বিএনপি’র মা নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মা। এজন্য যে, এই মহিয়সী নেত্রী তিনি সারাটা জীবনে এই গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। দুর্ভাগ্য আমাদের এই মহিয়সী নেত্রীর তার সঠিক মূল্যায়নটা এদেশের অনেকে করতে পারছেন না। খালেদা জিয়া এখন লড়াই করছেন তার জীবনের সঙ্গে। তার স্বাস্থ্যের অবস্থা খুবই খারাপ। আপনারা দেখছেন যে, প্রায়শ তিনি যাচ্ছেন হাসপাতালে। চেকআপ হচ্ছে। আবার বাসায় ফিরে আসছেন। আসার পরেও কিন্তু ২৪ ঘণ্টাই তিনি মেডিকেল কেয়ারের মধ্যে আছেন। মির্জা ফখরুল বলেন, এখানে একটা গোত্র তৈরি করা হচ্ছে যাদেরকে সমস্ত রকম দুর্নীতি-অনিয়মের মধ্যদিয়ে অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। একটা লুটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেটা দিয়ে তারা এই সরকারকে টিকিয়ে রাখছে, এরমধ্যে তারা নিজেরাও জড়িত এবং তাদের সুবিধাভোগী লোকজনরা জড়িত। আজকে যেগুলো দেখছেন, সেগুলো হচ্ছে লুট, মেগা লুট। একজন ব্যক্তি সে এখন সিঙ্গাপুরে গিয়ে হাইয়েস্ট ইনভেস্টার, চার নম্বরে আছেন- তাই না।
আর কয়েকজন ব্যক্তি আছেন পানামা লিস্টের মধ্যে পড়ে যায় এত টাকা তারা বানিয়েছেন। এরা দুর্নীতি-অনিয়মের ওপর ভিত্তি করে এই রাষ্ট্রকে কী করে পরনির্ভরশীল করা যায় এবং তাদের বিশেষ গোত্রকে কীভাবে অন্যায়ভাবে আর্থিক দিক থেকে শক্তিশালী করা যায়, সেই লক্ষ্যে তারা কাজ করছে। তিনি বলেন, কারও কোনো জবাবদিহিতা নাই তো, কারও কোনো স্ট্যাক নাই তো। এখানে দেখেন একজন মন্ত্রীর যার লন্ডনে বাড়ি পাওয়া গেছে আড়াইশ’-তিনশ’টার মতো। পত্রিকায় দেখা যায় যে, মন্ত্রী-এমপি’র বাড়ি-সম্পদ দেশের বাইরে রয়েছে, কারও কোনো স্ট্যাক নেই এখানে। তারা ডোন্ট কেয়ার। তাদের যে বক্তব্য, দাম্ভিকতা- এটা অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে, এমনভাবে কথা বলেন যে, উনারা ছাড়া দেশে আর কেউ নাই। ফখরুল ইসলাম আরও বলেন, বাংলাদেশ একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র অলিরেডি হয়েই গেছে। আমরা সেটা আগে থেকেই বলে আসছি যে, এই সরকার পরিকল্পিতভাবে এই রাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। কখন ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়? যখন অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলে, যখন তার রাজনৈতিক স্টাকচারটা ভেঙে ফেলে, সামাজিক কাঠামো ভেঙে যায়- যখন কোথাও জবাবদিহিতা থাকে না তখন রাষ্ট্র একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়, নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। এখন গোটা দেশে একটা নৈরাজ্য চলছে। বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি তৈরির পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র দিয়েছিলেন, মিক্সড অর্থনীতি এবং পরবর্তীকালে প্রাইভেট সেক্টর চালু করেছিলেন। ফলে উন্নয়নের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
বেগম জিয়া তার শাসনামলে সেগুলো এগিয়ে নিয়ে গেছেন। একটা বিষয় আপনাদের মনে থাকার কথা ২০০৬ সালের সময়ে নিউজউইকের মতো পত্রিকা কাভার স্টোরি করেছিল, বাংলাদেশ ইমার্জিং টাইগার। এমনভাবে তারা (আওয়ামী লীগ সরকার) কথা বলে যে, গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময়ে কোনো উন্নয়নই হয় নাই। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যে উন্নয়ন হয়েছে সেই উন্নয়নই অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি করেছে। আজকে যেগুলো দেখছেন, সেগুলো হচ্ছে লুট, মেগা লুট। সরকারি হাসপাতালের অবস্থা তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আপনারা কি সরকারি হাসপাতালে কেউ গেছেন? যদি যান বিশেষ করে ঢাকার বাইরে সরকারি হাসপাতালে যান, অবিশ্বাস্য- হাসপাতালে ঢোকা যায় না এত দুর্গন্ধ, এত নোংরা, দালালদের অত্যাচার চিন্তা করা যায় না। আর হাসপাতালের চারপাশে নতুন নতুন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক গড়ে উঠেছে, এটা বড় ব্যবসা। এখান থেকে দালালরা আসে সরকারি হাসপাতাল থেকে ধরে নিয়ে যায় রোগী, এই হচ্ছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দলীয়করণে উপাচার্য ও শিক্ষক নিয়োগে শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে কারণে ব্রেনডেইন হয়ে যাচ্ছে, যারা মেধাবী যারা নিজের যোগ্যতা আছে তারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।
জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকার উদাসীন উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ৭০ শতাংশই ঘটে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক কিংবা ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন ধরনের অসংক্রামক রোগে। অথচ এসব রোগ মোকাবিলায় সরকারের অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ মাত্র মোট স্বাস্থ্য বাজেটের ৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর আগে গত মার্চ মাসে সিপিডি’র একটি রিপোর্টেও জনস্বাস্থ্যের এক ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটে উঠেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ১৩ কোটি মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে পারছেন না। গত মার্চ মাসেই বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ-বিএফএসএ’র শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, দেশে প্রতিবছর ১ লাখ ১৪ হাজার মানুষ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করছে। এই ক্যান্সারের মূল কারণ অনিরাপদ খাদ্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় অবৈধ সরকার কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তায় এই সরকার কেন এত উদাসীন। জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশের নাগরিকদেরকে পুষ্টিকর খাদ্য যোগান দেয়া, অনিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে সচেতন করা সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কিন্তু সরকার সেটা করছে না। নাগরিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিধানে আমদানি পণ্যের বিভিন্ন ক্ষতিকারক উপাদান শনাক্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশ ও জোট বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ রাষ্ট্রসংঘ কী ধরনের ভূমিকা গ্রহণ করেছে তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশেরও উচিত দেশে আমদানি করা প্রতিটি পণ্য বাজারে ছাড়ার আগে যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পণ্যের মান যাচাই করে নেয়া। কিন্তু বর্তমান তাঁবেদার সরকার আমদানি করা খাদ্যপণ্য যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে কিনা এ ব্যাপারে জনগণ যথেষ্ট সন্দিহান। আমদানি করা পণ্য যথাযথ পরীক্ষার ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়া গেলে প্রতিটি নাগরিককে নিজের এবং নিজেদের পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিজ উদ্যোগেই সতর্কতা অবলম্বণ করতে হবে। তাঁবেদার সরকারের ওপর ভরসা না করে নিজেই নিজের সাধ্যমত নিজের এবং পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
manabzamin