বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের যে নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে, সেটি অনেক দিক দিয়েই অভিনব, ব্যতিক্রমী। প্রথমত, এ নির্বাচনে দেশের প্রধান দুই দলের একটি—বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নেই। নেই বাম গণতান্ত্রিক জোটও, যারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে সমদূরত্ব বজায় রেখে চলে।
দ্বিতীয়ত, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে যেমন নৌকা প্রতীকধারী আছেন, তেমনি আছেন নৌকা না পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীও। যাঁদেরকে বলা হচ্ছে ‘ডামি প্রার্থী’।
তৃতীয়ত, এ নির্বাচনে কোন দল বিজয়ী হবে এবং নতুন সরকার গঠন করবে, সেটা ভোটের আগেই সবাই জেনে গেছে। এক সপ্তাহ আগে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট লিখেছে, ‘শেখ হাসিনাস পার্টি ইজ সেট টু বি রি-ইলেকটেড ইন জানুয়ারি।’ এতে বলা হয়, ‘শেখ হাসিনা চার মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে পঞ্চম দফা শুরু করতে যাচ্ছেন, তা নিয়ে সন্দেহের খুব একটা অবকাশ নেই।’
চতুর্থত, এ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল ও প্রার্থীরা কে কার বিরুদ্ধে লড়ছেন? নির্বাচন হয় দলীয় নীতি-আদর্শ ও কর্মসূচির ভিত্তিতে। সেখানে প্রার্থীর চেয়ে দলের ভূমিকা বেশি। কিন্তু নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মুখোমুখি লড়াইয়ে দল গৌণ হয়ে পড়েছে। মুখ্য হয়েছেন প্রার্থী। অর্থাৎ যিনি নৌকা নিয়ে লড়বেন আর যিনি আওয়ামী লীগ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকবেন, তাঁদের মধ্যে আদর্শগত কোনো ফারাক নেই। তাঁরা উভয়েই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী। শেখ হাসিনাকে নেত্রী হিসেবে মানেন। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের প্রতিও তাঁদের বিশ্বাস আছে। তাহলে তাঁরা একে অপরের বিরুদ্ধে একটা কথাই বলবেন, ‘দল ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
২১ ডিসেম্বর একটি বেসরকারি টেলিভিশনে বগুড়া এলাকার আওয়ামী লীগ দলীয় এক স্বতন্ত্র প্রার্থী দাবি করলেন, তিনি কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন না। যিনি নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন, তাঁর অবস্থান হবে চতুর্থ। এই প্রার্থীর দাবি, তাঁর সঙ্গে জনগণ আছে। এমনকি নির্বাচন বর্জন করা বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদেরও ভোট পাবেন। এত জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও কেন দলের মনোনয়ন চাইলেন না, জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমার তো অত টাকা নেই। লাখ লাখ টাকা দিতে হয় মনোনয়ন নিতে।’ তাঁর এ অভিযোগের উত্তর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডই দিতে পারে।
আওয়ামী লীগ যেসব আসন মিত্রদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে, সেসব আসনের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা কী করবেন? আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মনোনয়ন না পেলেও দলের নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচি নিয়ে ভোটারদের কাছে যাবেন। এর বিপরীতে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে যাঁরা লড়বেন, তাঁরাও নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ভোট আশা করবেন। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কর্মীদের নিজ দলের নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে, যদি তাঁরা লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীকে সমর্থন করেন।
৭ জানুয়ারির পর কারা বিরোধী দল হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জল্পনা চলছে। অনেকে বলেন, এটা হলো বিরোধী দল বেছে নেওয়ার নির্বাচন। কেউ কেউ বলেছেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়া কিংস পার্টি থেকে কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী আওয়ামী লীগের মধ্য থেকেও বিরোধী দল হতে পারে। বাস্তবে সেই সম্ভাবনা কম। প্রথমত, কিংস পার্টি থেকে কেউ কেউ জয়ী হলেও বিরোধী দল গঠনের মতো সংসদ সদস্য তারা পাবে না। আওয়ামী লীগের যেসব স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতবেন, তাঁরা তো আওয়ামী লীগেই থাকবেন। একই দল থেকে সরকারি ও বিরোধী দল হলে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের চীনা গণতন্ত্রই বেছে নিতে হয়। সেটা এখনই হচ্ছে না। ওপরে বহুদলীয় গণতন্ত্রের একটা প্রলেপ রাখতেই জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে বেছে নেওয়া হবে। যেমনটি হয়েছিল ২০১৪ ও ২০১৮ সালে।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণের পেছনেও এই মনস্তত্ত্ব কাজ করেছে। নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর বিএনপির দুই মেয়াদ ছাড়া জাতীয় পার্টি কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার হিস্যা পেয়ে এসেছে। ২০০৮-এর নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অংশীদার। ২০১৪ সালের সংসদে একইভাবে বিরোধী দল ও সরকারের অংশীদার। ২০১৮ সালের সংসদে তারা বিরোধী দল। বিরোধী দলের আসন পাকা করেই তারা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে বলে আমাদের ধারণা।
২০০৮ সালে মহাজোটের শরিক হিসেবে জাতীয় পার্টি ২৭টি আসন পেয়েছিল। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদে তাদের আসন ছিল যথাক্রমে ৩৪ ও ২৬টি। এবার আসন কমবে না বাড়বে, সেটা নির্ভর করবে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতি দলের নির্দেশনার ওপর। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, তাঁরা নৌকা তুলে নিয়েছেন, তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা থাকবেন। কে কীভাবে থাকেন, সেটাও দেখার বিষয়। আগের দুটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সুবিধা ছিল নৌকা ছেড়ে দেওয়া আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন না। এবার আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন। ফলে জাতীয় পার্টিকেও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। নৌকার বিপরীতে যেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন, সেখানে আওয়ামী লীগের ক্ষতি নেই। কিন্তু লাঙ্গলের কী হবে? ইতিমধ্যে জাতীয় পার্টি থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকদের বাধায় তাদের প্রার্থীরা প্রচারকাজ চালাতে পারছেন না।
আসলে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে মূল লড়াইটা যে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও অমনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে হবে, তার আলামত ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে।
রাজশাহী–১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন ওমর ফারুক চৌধুরী। তাঁর বিপরীতে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে লড়ছেন অভিনেত্রী শারমিন আক্তার ওরফে মাহিয়া মাহি। ওমর ফারুক চৌধুরী তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের পক্ষে যারা ছিল, তাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মাহিয়া মাহির তো একাত্তরে জন্মই হয়নি। তিনি কীভাবে পাকিস্তানিদের পক্ষে থাকলেন? আবার মাহিয়া মাহি ওমর ফারুক চৌধুরীকে সিনেমার আলোচিত চরিত্র চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘চৌধুরী সাহেবের টাকা আছে, কিন্তু মন নেই।’ মাহিয়া মাহি এলাকার মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করছেন। ৭ জানুয়ারি জানা যাবে টাকার জোর বেশি, না মনের?
তবে এবারের নির্বাচন সম্পর্কে আসল কথাটা বলেছেন বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে আসা ঝালকাঠি-১ আসনে (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) নৌকার প্রার্থী হওয়া মুহম্মদ শাহজাহান ওমর বীর উত্তম। বৃহস্পতিবার ঝালকাঠির রাজাপুর ডাকবাংলো মোড়ে ফাজিল মাদ্রাসা মাঠে উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত নির্বাচনী সভায় তিনি বলেন, ‘এবারকার নির্বাচন, কী নির্বাচন পাতছে, এটা তো কোনো নির্বাচন না। আরে ব্যাটা, নির্বাচনে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে, ভালো প্লেয়ার না থাকলে, উভয় পক্ষের মিছিল-মিটিং, মাইকিং-স্লোগান না থাকলে সেই নির্বাচনে মজা নাই। যা-ই হোক, এটা তো শেষ না।’
তাহলে শাহজাহান ওমরেরা কি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আরেকটি নির্বাচনের জন্য আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখবেন?
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
প্রথম আলো