সারা দেশে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একাধিকবার আল্টিমেটাম দেয়া সত্ত্বেও বিভেদ ও বিরোধ কমেনি আওয়ামী লীগে। তাই এবার বিরোধ মেটাতে দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফরে নামছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা ওইসব সফরের নেতৃত্বে থাকবেন। মূলত ঈদের আগেই দলটির কেন্দ্র থেকে সফরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যেসব এলাকায় বিরোধ সবচেয়ে বেশি সেসব এলাকায় আগে সফর করবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। যেসব এলাকায় তুলনামূলক বিভেদ কম সেখানে জেলা পর্যায়ের নেতাদের দায়িত্ব দেয়া হবে। আর রাজধানীর আশপাশের কয়েকটি জেলার বিভেদ মেটানো হবে সংশ্লিষ্ট নেতাদের ঢাকায় তলব করে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা মানবজমিনকে বলেন, মূলত উপজেলা নির্বাচনকে উৎসবমুখর ও অংশগ্রহণমূলক করতে চায় দলটি । নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে কোনো ধরনের সহিংসতা ও বিভেদ দূর করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। মানুষ যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ও ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে- সেটাই একমাত্র লক্ষ্য।
বিভেদ মেটাতে মাঠে আওয়ামী লীগ নেতারা
যারা দলীয় নির্দেশনার বাইরে গিয়ে বিভেদ ও দ্বন্দ্বের রাজনীতি করবেন তাদেরকে চিহ্নিত করে সময়মতো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এজন্য প্রতিটি উপজেলায় নিজেদের নেতাদের ওপর কড়া নজরদারি রাখছে আওয়ামী লীগ। এদিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপজেলা নির্বাচনে নিরপেক্ষ থাকার ব্যাপারে কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছেন। ঈদের দিন শুভেচ্ছাবিনিময় করে তিনি আওয়ামী লীগের নেতা এবং বিভিন্ন মহলকে এ সংক্রান্ত সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন বলে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা গণমাধ্যমকে জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উপজেলা নির্বাচনে কোনো কারচুপি করা হবে না। দলীয় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করা হবে না, মন্ত্রী-এমপিরা এবং আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের নিজের প্রার্থীকে যদি জিতিয়ে আনার জন্য কোনোরকম অবৈধ উপায় অবলম্বন করেন বা কারচুপি করে তাহলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণ হবে আগামী ৮ই মে। এই ধাপে ১৫০ উপজেলায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ধাপের উপজেলা ভোটে মনোনয়ন দাখিল করেছেন ১ হাজার ৮৯১ জন প্রার্থী। গতকাল বিকাল ৪টা পর্যন্ত মনোনয়ন দাখিলের শেষ সময় ছিল। দ্বিতীয় ধাপের তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিল ২১শে এপ্রিল শেষ সময়, মনোনয়নপত্র বাছাই ২৩শে এপ্রিল, আপিল গ্রহণ ২৪-২৬শে এপ্রিল, আপিল নিষ্পত্তি ২৭ থেকে ২৯শে এপ্রিল। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ৩০শে এপ্রিল, প্রতীক বরাদ্দ ২রা মে। আর ১৬১ উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে ২১শে মে। চার ধাপের উপজেলা ভোটের পরবর্তী দুই ধাপের নির্বাচন ২৯শে মে ও ৫ই জুন অনুষ্ঠিত হতে পারে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এবার আগেভাগেই ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, স্থানীয় নির্বাচনে কাউকে দলীয় প্রতীক দেয়া হবে না। মূলত দু’টি কারণে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। প্রথম কারণ হলো, সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা এড়ানো ও দ্বিতীয় কারণ হলো, স্থানীয় নির্বাচনকে উৎসবমুখর ও অংশগ্রহণমূলক করা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের পাশাপাশি প্রার্থী উন্মুক্ত করে দেয়ায় সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ মিশ্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার ভিন্ন কৌশল নেয়া হয়েছে। দলটির বেশ কয়েকজন নীতি-নির্ধারক মানবজমিনকে বলেন, স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে দলীয় প্রতীক নৌকা না থাকলেও দলের সমর্থিত প্রার্থী থাকবে। অর্থাৎ এলাকায় যারা জনপ্রিয় ও ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে তাদেরকে সাংগঠনিকভাবে সমর্থন দেবে আওয়ামী লীগ। আবার যেসব এলাকায় একাধিক জনপ্রিয় নেতা থাকবেন সেখানে উন্মুক্ত রাখা হবে। যুক্তি তুলে ধরে দলের নেতারা জানান, সাংগঠনিকভাবে যদি কাউকে সমর্থন দেয়া হয় তাহলে সেখানে বিরোধ হওয়ার সম্ভাবনা কম হবে। দলীয় প্রতীক না থাকলেও সাংগঠনিক সমর্থন থাকায় নির্বাচন আরও বেশি উৎসবমুখর হবে বলে দলীয়ভাবে ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিরোধ কমার সম্ভাবনাও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম মানবজমিনকে বলেন, অতীত নির্বাচন থেকে আমরা দেখেছি প্রতীক ও স্বতন্ত্রর লড়াই। এতে দল সাংগঠনিকভাবে অনেকটা দুর্বল হয়েছে বলে আমি মনে করি। তাই এবার স্থানীয় নির্বাচনে প্রতীক না দেয়া হলেও সাংগঠনিকভাবে প্রার্র্থীদের সমর্থন দেবে আওয়ামী লীগ। তবে অন্যদের বিষয়েও আমরা ছাড় দিচ্ছি। যদিও কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে চায় তারা নিতে পারবেন। উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় সব জায়গায় নিজেদের প্রার্থীকে একক প্রার্থী হিসেবে নিশ্চিত করতে চাইছেন প্রভাবশালী স্থানীয় নেতারা। এক্ষেত্রে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন মন্ত্রী-এমপি-স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য-আওয়ামী লীগের স্থানীয় দায়িত্বশীল নেতারা। এসব নিয়ন্ত্রণে যাদের দায়িত্ব অর্থাৎ কেন্দ্রীয় নেতাদের এলাকায় প্রভাব রাখতে অনেক জায়গায় তারাও জড়িয়ে যাচ্ছেন বিভেদের রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, উপজেলা নির্বাচনে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও স্থানীয় নেতারা তাদের পছন্দের প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করতে দলীয় প্রার্থী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। এতে নেতাকর্মীরা পড়েছেন দ্বন্দ্বে। কার পক্ষে কাজ করবেন সেটি নিয়ে উভয় সংকটে তারা।
এ প্রেক্ষিতে সমপ্রতি উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সাংগঠনিক নির্দেশনা পাঠিয়েছে দলটি। সেখানে বলা হয়েছে, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। একই সঙ্গে নৌকা প্রতীকও দেয়া হবে না। সাংগঠনিক নির্দেশনা দিয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বিবৃতিতে তিনি বলেন, নির্বাচনে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার কাজে নিয়োজিত প্রশাসনও শতভাগ নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে। কেউ কোনো ধরনের অবৈধ হস্তক্ষেপ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইতিমধ্যে মন্ত্রী-এমপিদেরকে সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে যে, উপজেলা নির্বাচনে যেন তারা কোনো প্রার্থীর পক্ষে-বিপক্ষে কাজ না করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মন্ত্রী-এমপিরা ইতিমধ্যে উপজেলা নির্বাচনে তাদের নিজস্ব পছন্দের ব্যক্তি বা মাইম্যানদের জন্য কাজ শুরু করে দিয়েছেন। এর ফলে উপজেলাগুলোতে এক ধরনের কোন্দল এবং বিভক্তি তীব্র আকার ধারণ করেছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতারা যে যার মতো করে পারছে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এটি আওয়ামী লীগের জন্য একটি নতুন সংকট তৈরি করেছে।
manabzamin