- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
সমাজ ও রাষ্ট্রে যখন ক্ষমতার স্বার্থে দ্বন্দ্ব-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ ও অনৈক্য-অরাজকতা লালন করা হয় তখন সেটিই বিভাজনের রাজনীতি। ঔপনিবেশিক আমলে ডিভাইড অ্যান্ড রুল বলতে যা বোঝানো হতো, বিভাজনের রাজনীতি তার থেকেও খারাপ। ব্রিটিশরা জাতিগত বিভেদ জিইয়ে রেখে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছে। জাতিগত বিভেদ অবাস্তব ছিল না। আর এখনকার শাসকরা বিভাজনের যে রাজনীতি অবলম্বন করেন তা অসত্য, অবাস্তব ও কৃত্রিম। রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী তাদের নিজ আদর্শ ও কর্মকৌশলে ভিন্ন। সবাই একই জাতীয় রাষ্ট্রে বসবাস করেন। জনগণের ঐক্য ও সংহতি যেখানে জাতিরাষ্ট্রকে করে সুদৃঢ়, সেখানে বিভাজনের রাজনীতি শান্তি ও সৌহার্দ্য বিনষ্ট করে। রাজনৈতিক শক্তিগুলো অপপ্রচার ও মিথ্যাচারের মতো অপকৌশল অবলম্বন করে অনুসৃত সামাজিক সম্পর্ককে দূষিত করে তোলে। ছলে বলে কলে কৌশলে বিভেদকে স্থায়িত্ব দিতে চায়। আর এগুলো করা হয় গণমাধ্যম ও প্রশাসনকে বিপথগামী করে। এদের কাজ হচ্ছে- ক. নাগরিক বিভেদ তৈরি করা; খ. বিরোধীদের মধ্যে ঐক্যের পথে কূটকৌশলে দ্বন্দ্ব-বিভেদ অব্যাহত রাখা; গ. ক্ষমতার প্রতি অনুগত, লোভী ও সুবিধাবাদী নেতৃত্ব ও গোষ্ঠীকে একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা; ঘ. স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বের মধ্যে অবিশ্বাস ও শত্রুতার পৃষ্ঠপোষকতা করা; ঙ. লোভ-ভীতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দলকে কুপোকাত করা; চ. সমাজের বিবিধ স্বার্থগোষ্ঠীকে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও ঝগড়া বিবাদে ব্যস্ত রাখা। এর ফলে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কখনোই সফল হতে পারে না।
অনৈতিক রাজনীতির প্রবক্তা নিকোলো ম্যাকিয়াভ্যালি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য আর্ট অব ওয়্যার’-এ বৈদেশিক শক্তি ও সমভাবে অভ্যন্তরীণ বিরোধীদের ক্ষেত্রে বিভাজনের রাজনীতিকে সিদ্ধ মনে করেন। তার মতে, যুদ্ধজয়ে কূটকৌশল ও বিভাজন নীতি অন্যায় নয়। তিনি শাসককে কুবুদ্ধি দেন যে, বিরোধী শক্তি সম্পর্কে সন্দেহপরায়ণতা ও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ তৈরি করতে পারলে শাসক সফল হতে পারেন। এভাবে রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক তৈরি করতে পারলে তার ক্ষমতার দীর্ঘায়িতকরণ সহজতর হয়ে উঠবে। বিরোধী শক্তি ক্রমেই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হবে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় ম্যাকিয়াভ্যালিয়ানদের অন্যায় অপকর্মের শত শত নমুনা রয়েছে। তবে সবাই ম্যাকিয়াভ্যালিয়ান নন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল রাষ্ট্রকে নৈতিক প্রতিষ্ঠান মনে করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন দেশে ও বিদেশে খোলামেলা বিশুদ্ধ রাজনীতি ও কূটনীতির প্রবক্তা ছিলেন। ফ্রান্সিস বেকন একই কথা বলেন। দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘পারপিচুয়াল পিস’-এ বিভাজনের রাজনীতির আরো কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলেন। বিভাজনের রাজনীতির প্রবক্তারা তাদের ক্ষমতা শক্তপোক্ত করার জন্য যা ইচ্ছা তাই করে। পরে এমন সব অজুহাত বানায় যাতে মনে হবে, বিষয়টি বাস্তব ছিল। তারা অন্যায় করে এবং সাথে সাথে তা অস্বীকার করে। প্রচলিত কথাটি আজকাল এরকম করে বলা হয়, ‘গিভ দ্য ডগ এ ব্যাড নেম, বিফোর কিলিং ইট’। সেকালে ও একালে এর প্রমাণ আছে। মার্কিনিরা যখন মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে একের পর এক আক্রমণ চালায় তার আগে তারা মুসলমানদের সন্ত্রাসী জাতি হিসেবে শনাক্ত করে। তারা ‘দ্য লং ওয়্যার’ এবং সভ্যতার দ্বন্দ্বের কথা বলে। সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে মানবতাবিধ্বংসী বায়বীয় অস্ত্রের অভিযোগ ছিল। পরে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। সমাজতত্ত্ববিদ ক্লিভ আর বড্ডি মন্তব্য করেন যে, এই বিভাজনের রাজনীতি সবসময় সবকালে বিষয়টিকে ধূমায়িত করার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
এসব তত্ত্ব কথার পর এখন বাস্তবতায় আসা যাক। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এনগায়ার উডস তার সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখান যে, আজকের বিশ্ব যথার্থভাবেই রাজনৈতিক বিভাজনে ভুগছে। স্বৈরাচার জেঁকে বসছে। সেখানকার জনসাধারণ লড়াই করে জয়ী হতে পারছে না; বরং পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠছে। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিরাজিত রাজনৈতিক বিভেদকে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা বলা যায়। তাদের গবেষণায় বলা হয়, ‘বিভাজন, বিদ্বেষ ও মগজ ধোলাইয়ের বিষাক্ত রসায়ন’ সমষ্টিগত চেতনা ও পারস্পরিক সহাবস্থানের নাগরিক মানসিকতাকে শেষ করে দিচ্ছে এবং সরকারের কর্মক্ষমতা নিষ্ক্রিয় হওয়ার পেছনে এর ভূমিকা রয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান এডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটারের বিশ্লেষণে ২০২৩ সালে তৃতীয় বিশ্বের অনেকগুলো দেশে এই প্রবণতা বহমান রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- আর্জেন্টিনা, কলোম্বিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে স্পেন ও সুইডেন।
বৈশ্বিক গণতন্ত্রের তাঁবেদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই অভিযোগ থেকে বাদ যায়নি। ওই প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে একসময় ভোটারদের নিজ দলের বা গোষ্ঠীর মধ্যে সাধারণ সহমর্মিতা ছিল। বিরোধী শিবিরের প্রতি তাদের একরকম নিরপেক্ষতা বা বৈরিতার মধ্যেও মিত্রতা ছিল। এখন তারা তাদের প্রতিপক্ষকে ভয় করে এবং ঘৃণা করে। সম্ভবত সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এ ধারণার একনায়ক বলা যায়। শুধু তাই নয়, আমেরিকানরা এখন ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী লোকের সাথে প্রেম, বিয়ে ও পাশাপাশি বসবাস করতে নারাজ। কর্মক্ষেত্রে ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে বৈষম্যের প্রবণতা বেড়ে গেছে। এনগায়র উডস এ ক্ষেত্রে তুরস্কে পরিচালিত একটি গবেষণার ফলাফল উল্লেখ করেন। সেখানে প্রতি ১০ জনের মধ্যে প্রায় আটজনই চান না তাদের মেয়ে এমন কাউকে বিয়ে করুক, যে তাদের সবচেয়ে অপছন্দের লোককে ভোট দেয়। মার্কিন সমীক্ষায় আরো দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক অভিযোজন এখন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, লোকেরা তাদের দলের সাথে একত্র হয়ে নিজের ধর্ম, শ্রেণী ও যৌন আচরণ পর্যন্ত পরিবর্তন করতে চাইছে। এডেলম্যান গবেষণা বিস্তৃত হয়েছে পৃথিবীর ২৮টি দেশে। ৩২ হাজার উত্তরদাতার মাত্র ২০ শতাংশ তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সহমত পোষণ করেন না, এমন লোকের সাথে কাজ করতে কিংবা প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করতে রাজি আছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাকি ৮০ শতাংশ মানুষ বৈরিতা অথবা নিস্পৃহতায় নিমগ্ন আছেন। ৩২ হাজার উত্তরদাতার মাত্র ৩০ শতাংশ লোক বিরুদ্ধ মতের লোকের বিপদে সাহায্য করতে রাজি। বাকি ৭০ শতাংশ বলা যায় অমানবিকতায় ভুগছে। একটি পরস্পর সহানুভূতিশীল বিশ্ব গড়ার জন্য নিঃসন্দেহে এটি এক বিপজ্জনক উদাহরণ। এত দিন ধরে মানুষ বিশ্বাস করে আসছে, ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে আন্তরিক যোগাযোগ থাকা অপরিহার্র্য। সুতরাং রাজনৈতিক বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতা ও অন্যের চরিত্র হননের মতো অনৈতিক কাজ নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের জন্য সাংঘর্ষিক। অথচ তৃতীয় বিশ্বে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত গণতন্ত্রে একে অপরকে কঠিন গালি দিচ্ছেন। ট্রাম্পের আচার-আচরণ ও কথা-বার্তায় মনে হয়, তিনি অনুন্নত গণতন্ত্রের দেশ থেকে অনেক সবক নিয়েছেন। পরাজয়ের পর যখন তিনি ন্যাশনাল পার্লামেন্ট বা ক্যাপিটাল হিল আক্রমণে পরোক্ষভাবে নির্দেশ দিলেন তখন ঢাকা, দিল্লি বা ইসলামাবাদের রাজনৈতিক নেতাদের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়।
উল্লিখিত গবেষণার উপসংহারে বলা হয়, ভিন্ন মত-পথের মানুষদের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গেলে মানুষ তার প্রতিপক্ষের সাথে নিজের মিল খুঁজে পাবে না। সুপারিশ করা হয় এই প্রবণতা থেকে সরে আসার জন্য একটি সূচনা বিন্দু তৈরি করতে হবে আর তা হবে ভোটারদেরকে আরো অর্থপূর্ণ উপায়ে ভোট দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করার মাধ্যমে। এর অর্থ হচ্ছে, যেসব দেশে নির্বাচনব্যবস্থা ভঙ্গুর বা বিপর্যস্ত হয়েছে সেই নির্বাচনব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে আনা। এ প্রসঙ্গে মনীষী টমাস গ্রিনের সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে করা যায়, ‘ডেমোক্র্যাসি মে ফেইলড ইন ম্যানি ব্যাটেলস, বাট ইট উইনস দ্য লাস্ট।’
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিভাজনের রাজনীতি বাংলাদেশে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আমরা দেখেছি এই বিভাজনের নানা সূত্র হতে পারে- ধর্ম, ভাষা, গোষ্ঠী, অর্থনৈতিক স্বার্থ ইত্যাদি। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এ সমস্যায় আকীর্ণ। আফ্রিকা না হয় বর্ণবিভেদে আচ্ছন্ন মহাদেশ, আর ভারত ধর্ম বর্ণ ও জাতিগত উৎপাতে উত্তপ্ত দেশ। কিন্তু বাংলাদেশের মতো জাতীয়তাবাদের নিরিখে একটি ‘হোমো জিনিয়াস’ বা সমগোত্রীয় দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ ও অনৈক্য-অরাজকতার অর্থ কী? বাংলাদেশ সমভূমির দেশ। ধর্মে ৯২ শতাংশ মুসলমান। বাংলা ভাষায় কথা বলে ৯৮ শতাংশ মানুষ। অর্থনীতি তথা পেশাজীবীকায় নেই ভয়ানক বিরোধ। সবাই মাছে-ভাতে বাঙালি। ইতিহাস ঐতিহ্য একই ধারার। তাহলে বিরোধের আর কোনো কারণ থাকে কি? রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সমজাতীয়তার যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, আমরা একটি ভাগ্যবান জাতি। পৃথিবীর আর মাত্র দু-একটি জাতি আমাদের মতো সমরূপ আদর্শ ও জীবনধারা অনুসরণ করে। কিন্তু রাজনীতিকে যদি আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঐক্যের নিয়ামক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করি তাহলে দেখব- বাংলাদেশ শতধা বিভক্ত, পারস্পরিক, আস্থা ও বিশ্বাসে বিরূপ ও হিংসা-বিদ্বেষের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত একটি অস্থির জাতি। হাজার বছর ধরে এই জাতির ইতিহাস গ্রথিত ও প্রোথিত হয়েছে। বহতা নদীর মতো অনেক বাঁক অতিক্রম করে বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্র অর্জনের মাধ্যমে মিলন মোহনায় পৌঁছেছে। সে দেশে বিভাজন কেন হবে? কী তার মর্মার্থ?
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জাতি যখন অর্জিত হয় তখন হাজার বছর ধরে লালিত বিশ্বাস, জীবনবোধ, অর্থনীতি, রাজনীতি একত্রিত ও সমন্বিত হয়ে একক রাষ্ট্র নির্মাণ করে। শুধু ভাষার ভিত্তিতে অথবা শুধু ধর্মের ভিত্তিতে এ জাতিরাষ্ট্র নির্মিত হয়নি। ১৯৪৭ সালের বিভাজনটি ছিল ইতিহাসের একটি পরিণতি। ১৯৪০ সালে বাংলাদেশের প্রাণপুরুষ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করে উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিমে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির সন্ধান করেছেন। সেই মুক্তির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের অভ্যুদয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। আবুল মনসুর আহমেদ বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ‘এন্ড অব দ্য বিট্রেয়াল অ্যান্ড রেস্টোরেশন অব লাহোর রেজ্যুলুশন’ বলে অভিহিত করেন। মুসলিম পশ্চিম ও মুসলিম পূর্ব- এভাবে রাষ্ট্রটি গড়ে ওঠার কথা ছিল, তা ছিল মুসলিম পরিচয়কেন্দ্রিক। পরবর্তীকালে পশ্চিমা লাঞ্ছনা-বঞ্চনার প্রতিবাদে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলা হলেও সেটিই আমাদের একমাত্র পরিচয় ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়- বাংলাদেশের প্রাথমিক শাসকরা একটি মাত্র পরিচয়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে গঠন ও নির্মাণ করার পদক্ষেপ নেন।
সংবিধান ও রাষ্ট্রের সব পরিচয় ভাষাভিত্তিক হওয়ায় একটি অসম্পূর্ণতা পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঠিক পরপরই বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে আগের অনুভূতি প্রকাশ পায়। ভারতীয় এবং পাশ্চাত্যের গবেষকদের তথ্যে এর প্রমাণ মেলে। বিষয়টি আরো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। জাতি রাষ্ট্রের পরিচয় নির্ণীত হওয়ার পর রাজনৈতিক বিভাজন পরিত্যক্ত হয়ে জাতীয় ঐক্য রচিত হওয়ার কথা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর শাসকগোষ্ঠী নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করা তথা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য রাজনৈতিক বিভাজনের নীতি গ্রহণ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ এবং জাতীয় ঐক্য গড়ার সংবেদনশীল সময়কালে শাসক আওয়ামী লীগ জাতিকে বিভক্ত করে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক চক্র মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা বিভেদ সৃষ্টি করে। সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান ফেরত দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে ওঠে। এর বাইরেও লাল বাহিনী, নীল বাহিনী ও সবুজ বাহিনী সৃষ্টি করে রাজনৈতিক সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়। আমলাতন্ত্র ও দলতন্ত্রের দ্বন্দ্বে দেশে প্রশাসনিক অব্যবস্থা ও অকার্যকারিতার সৃষ্টি হয়। ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্ত ঘটনাবলির পর সব মত ও পথকে সমন্বিত করে এগিয়ে চলার নীতি গ্রহণ করেন জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ছায়ায় জাতীয় ঐক্য সূচিত হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে তখন তারা সেই বিভেদের রাজনীতিও ফিরিয়ে আনে। এবার নতুন ভাষায় ও নতুন মোড়কে বিরোধের বিষ রোপিত হয়। স্বাধীনতার সপক্ষ ও বিপক্ষ বলে জাতিকে বিভক্ত করা হয়। ২০০৯ সাল থেকে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে তারা ইসলাম মুসলমান ও ধর্মীয় বিষয়গুলোকে স্বাধীনতার বিপক্ষের মূলনীতি বলে প্রচার করে। ধর্মনিরপেক্ষতা আবার ফিরিয়ে আনা হয় বাংলাদেশের সংবিধানে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় পঞ্চদশ সংশোধনীতে আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষতা ঘোষিত হয়। অথচ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থেকে যায়। জাতিতে বাঙালি হলেও রাষ্ট্রে বাংলাদেশী পরিচয়ে প্রকারান্তরে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতি মেলে। এতে অনিবার্যভাবেই বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্রের গহিন গভীরে ইসলামের অবস্থান নির্ণীত হয়।
এসব ভাবাদর্শের সঙ্ঘাত ও রাজনৈতিক নিপীড়নের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক বিভাজন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাজনৈতিক বিভাজন এতটা তীব্রতা অর্জন করেছে যে, ভিন্নমত পোষণ করা অথবা নিরপেক্ষ থাকাও যেন অপরাধ। ডান-বাম, উত্তর-দক্ষিণ সব ধরনের রাজনীতিতে সরকারের কোনোই সহনীয় অবস্থান নেই। রাষ্ট্রের সর্বশেষ সর্বনাশ- নির্বাচন ব্যবস্থা নির্বাসনে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের ব্যর্থতাগুলো বিদ্যমান অবস্থার পর্যালোচনা করে দেশের শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর রওনক জাহান অতি সম্প্রতি উদ্বেগ জানিয়েছেন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, আইনের শাসন ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে। সমাজ ও রাজনীতিতে বিভাজন বেড়ে চলেছে। … নির্বাচন নিয়ে সরকারের বিভিন্ন বয়ান ও জনসাধারণের বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনো মিল নেই। সরকার বলছে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, গণতন্ত্র সুদৃঢ় হয়েছে। কিন্তু এই বয়ান কি জনসাধারণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে? …সরকারের সামনে প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তাদের গণতন্ত্রের অঙ্গীকারের প্রতি জনসাধারণের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনা। আর আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই নির্বাচন নিয়ে সব বিতর্কিত বিষয়ের মীমাংসা করতে হবে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সাথে আলোচনা করে সর্বদল গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে হবে। গত ১৫ বছরে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কোনো ঐক্যে পৌঁছাতে পারেনি। দেশের জনগণ একটি সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। নির্বাচনগুলো বিতর্কিত হওয়ায় বৈশ্বিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে যত দিন বিতর্ক চলবে, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আসবে না’। (প্রথম আলো, ১ ফেব্রুয়ারি-২০২৪) ।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Nayadiganta