- মো: তোফাজ্জল বিন আমীন
- ০৬ মে ২০২৩, ২০:৪৪
আমরা এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দিনাতিপাত করছি। প্রতিনিয়ত প্রতিহিংসার রাজনীতি আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও যেন এতটুকু শান্তি নেই যেখানে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যায়। বিভাজনের রাজনীতির কারণে আমরা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার সৎসাহস হারিয়ে ফেলেছি। ফলে রাজনৈতিক সঙ্ঘাত-সহিংসতা বাড়ছে। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে! এটি অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে, মানুষের কল্যাণের পক্ষে হতে হবে। যেন সুস্থ রাজনীতির প্রতিযোগিতা হয়। রাজনীতিবিদরা প্রায়ই বলেন, মানুষের জন্য রাজনীতি। অথচ তারাই ক্ষমতার সিঁড়ি ধরে রাখতে ভিন্নমতের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার প্রয়োগ করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। বিভাজনের রাজনীতি কারো জন্য সুখকর নয়। কিন্তু নির্বাচন সামনে এলে বিভাজন আরো প্রকট হয়ে উঠে। বিভাজন বাড়ায় সৎ যোগ্য ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিরা রাজনীতিবিমুখ। ফলে রাজনীতিতে পেশিশক্তি ও ভোগবাদিতার উত্থান জনমনে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। অথচ একটা সময় সৎ ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিরা রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন, তারা হৃদয়ে রাজনীতির আদর্শ লালন করতেন। ভোগবাদিতা কিংবা বিলাসিতার সাগরে গা ভাসিয়ে দিতেন না; অর্থের পেছনে ছুটতেন না, মানুষের কল্যাণে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে দিতেন। তাদের জীবনযাপনে দেশপ্রেম দৃশ্যমান থাকত। কিন্তু এখন রাজনীতি মানে প্রতিহিংসার রাজনীতি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল বলছেন, ‘প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী। রাজনীতি মানুষের জীবনেরই অনুষঙ্গ। কেউ কেউ রাজনীতিকে অবজ্ঞা করেন। রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজেকে দূরে রাখেন। কিন্তু প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড লাসওয়েলের ভাষ্যমতে, ‘রাজনীতি হচ্ছে প্রভাব ও প্রভাবশালীদের পাঠ। সেখানে গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ না থাকলে অপরাজনীতির চাষাবাদ হয়। প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিবার-সমাজকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে রাজনীতিতে এক ধরনের হতাশা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকে অদ্যাবধি রাজনৈতিক শিষ্টাচার চর্চার প্রয়োগ চোখে পড়েনি; বরং প্রতিহিংসার রাজনীতি আদর্শ হয়ে উঠেছে। অথচ একটা সময় এমন ছিল যে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতের অমিল থাকলেও পারস্পরিক ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল।
কিন্তু এখন ভালোবাসা তো দূরের কথা; উল্টো হামলা আর মামলায় ভিন্নমতের অনুসারীকে শায়েস্তা করা হয়। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া জরুরি। কারণ চিরদিন কারো সমান নাহি যায়। রাজনীতিবিদ ক্ষমতায় না থাকলেও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জীবন বিলিয়ে দিতেন। এখন আর তেমনটি দেখা যায় না। দেশের শাসক শ্রেণী মনে করে, ‘সব কৃতিত্ব আমার, আর সব ব্যর্থতার দায় প্রতিপক্ষের। এক শ্রেণীর কিছু রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রী ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠা তো দূরের কথা ভোগ-বিলাসের গন্ধ পেলেই আদর্শ পরিবর্তন করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রীরা যখন বিভাজনের পথে হাঁটেন তখন গণতান্ত্রিক সরকারও স্বৈরতান্ত্রিক পথে পা বাড়ায়। ইতিহাসের পাতায় এরকম ঘটনা ভুরি ভুরি আছে।
দেশের মানুষ অবিচার ও জুলুমের শিকার কখন হয়? যখন বিভাজনের রাজনীতি বিরাজ করে। তখন তাদের বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ ভারী হয়ে উঠলেও ক্ষমতাসীনরা কর্ণপাত করে না। ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যত ফন্দি করা হয়, তার ছিটেফোঁটাও যদি গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বার্থে করা হতো তাহলে বিভাজনের রাজনীতি সমাজ থেকে বহু আগে বিতাড়িত হয়ে যেত। সুন্দর সমাজ ও আইনের শাসনের সুবাতাস সবাই উপভোগ করতে পারত। কিন্তু বিরাজনীতিকরণের ফলে এক শ্রেণীর সুবিধাভোগী মানুষ রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তিকে ব্যবহার করে বহু মানুষের জীবনকে নরকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু মানুষ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না। দু’-একজন প্রতিবাদ করলেও তাদেরকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে দমন করা হচ্ছে। নীতিহীন রাজনীতি দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা বোধ করি নতুন করে কাউকে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। এক শ্রেণীর নেতা-নেত্রী দিনের বেলায় হৃদয় নিংড়ানো আশা আকাক্সক্ষার কথা বলে কর্মীদেরকে উজ্জীবিত করেন। আবার তারাই রাতের অন্ধকারে নিজেদের ব্যবসায়-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে আঁতাতের রাজনীতি করেন। এক কথায়, নেতারা যা বলেন তা করেন না, যা করেন তা বলেন না। ক্ষমতার মোহে তারা দেশপ্রেম কিংবা মানবতার সংজ্ঞাটিও ভুলে যান। ফলে তাদের কাছে জনসেবা ও আর্দশ প্রাধান্য পায় না।
দেশপ্রেম কারো গায়ে লেখা থাকে না। দেশদ্রোহী হয়েও কেউ জন্মগ্রহণ করে না। পরিবেশ-পরিস্থিতি কাউকে হিরো আবার কাউকে জিরো বানায়। কিন্তু জিরো থেকে হিরো হওয়ার গল্পও আছে। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা অন্যায় কিছু নয়; কিন্তু প্রতিহিংসার রাজনীতি অন্যায়। প্রতিহিংসার রাজনীতি নির্বাসন দেয়া তখনই সম্ভব যখন ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের ঊর্ধ্বে জনকল্যাণের রাজনীতির ধারা চালু হবে। একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে মূল ভ‚মিকা পালন করে থাকেন রাজনীতিবিদরা। রাষ্ট্রের জনগণ যখন নিপীড়নের শিকার হন তার প্রতিবাদ রাজনীতিবিদদেরই করতে হয়। যদি কেবল আমলা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যেত তাহলে রাজনীতির প্রয়োজন হতো না। একটি রাষ্ট্র অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাবলম্বী হলেও দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারে না যদি না কাক্সিক্ষত মানের গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করে। বিশ্বব্যাপী দেশ দখলের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চলছে। গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে- জনগণের ইচ্ছানুযায়ী দেশ পরিচালিত হবে। সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, জনগণ নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। ফলে যেন তেন উপায়ে বিনাভোটে জয়ী হওয়ার সংস্কৃতি চালু হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্রবিরোধী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতার সংগ্রাম করেনি। যারা গণতন্ত্রকে হত্যা করতে চায় তাদের উচিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য অনুধাবন করা। যখন সুষ্ঠু ভোটের আয়োজন না করে যেনতেন উপায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হাতিয়ে নেয়া হয় তখন গণতান্ত্রিক অধিকারের বিষয়টি ভাটা পড়ে যায়। জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার তার উদাহরণ। ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে হিটলার চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। নিজ দল ছাড়াও অন্য দল থেকে তিনি মন্ত্রিসভায় জায়গা করে দিয়েছিলেন। সিভিল সোসাইটি থেকেও কয়েকজনকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়েছিলেন। পার্লামেন্ট হিটলারকে সর্বসময় ক্ষমতার অধিকার দিয়েছিল। কিন্তু হিটলার সে মর্যাদা রাখেননি। তারপর দমন-পীড়ন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা কমবেশি সবারই জানা। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে যারাই ক্ষমতায় আছে তারা হিটলার না হলেও হিটলারের অনুসরণীয় পথে দেশ পরিচালনা করতে ভুল করছেন না। ফলে প্রতিহিংসার রাজনীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। মাছের মাথা থেকেই তার পচন দেখা দেয়। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজদেহের বিনাশী পচন ও অবক্ষয় প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকেই উৎপত্তি হয়েছে।
সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে অনৈতিকতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এক দিনেই তৈরি হয়নি। এটি দীর্ঘদিনের সামাজিক-রাজনৈতিক মিথষ্ক্রিয়ার ফসল। সর্বক্ষেত্রে এক তরফা রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ফলে বিভাজনের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় গ্রাস করছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের যারা নেতা তারা সামাজিক মূল্যবোধের তোয়াক্কা না করে নীতিহীন রাজনীতির চাষাবাদ শুরু করায় সমাজের বিভিন্ন স্তরে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বাড়ছে, প্রতিহিংসার রাজনীতি দেশকে বিপথে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ আমরা কেউ চিরদিন বাঁচব না, কিন্তু বাঁচবে আমাদের দেশ, আর বাঁচবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। সুতরাং একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের স্বার্থে সরকারিদল ও বিরোধীদল বিভাজনের রাজনীতি পরিহার করবে, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।