- কাজী ওয়াদুদ নওয়াজ
- ২৮ এপ্রিল ২০২৩, ২০:০৬
বিবর্তনবাদ তত্ত্বে চার্লস ডারউইন দেখানোর চেষ্টা করেছেন কিভাবে একটি সাধারণ উত্তরাধিকার থেকে বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবজগত বিকশিত হয়েছে। ১৮৫৯ সালে তার ‘অরিজিন অব স্পিসিস’ এর মাধ্যমে ডারউইন এক সাধারণ উত্তরাধিকার থেকে বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবজগতের ক্রমবিকাশের ধারণাটিকে ব্যাখ্যা করেন। তার এই তত্ত্ব তদানিন্তন বাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় ক্যাথলিক চার্চের পক্ষ থেকে তিনি প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হন। বাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বঅনুসারে আল্লাহর সৃষ্টিপ্রক্রিয়া এককালীন ও আকস্মিক, এর কোনোই পরিবর্তন হয়নি। সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থায় যা ছিল এখনো তাই আছে। আল-কুরআনের আলোকে পুরো সৃষ্টিজগত হলো ‘কুন ফা ইয়াকুন’ সময়কে একটি পরাবাস্তব হিসেবে তুলে ধরে, যা জাগতিক স্থান ও কালরূপে নিজেকে প্রকাশ করে। পরাবাস্তব সময়ের একটি মুহূর্ত জাগতিক সময়ের কোটি কোটি বছর।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পাশ্চাত্য জগত স্বীকার করুক বা না করুক ডারউইনের চিন্তাধারা আসলে অতীত ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের ক্রমবিকাশ সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণার ধারাবাহিকতা। এ বিষয়ে ‘ইসলামে ক্রমবিকাশ তত্ত্ব…’ গ্রন্থটিতে ড. শানাভাস বলেন, ‘পূর্বতন মুসলিম চিন্তাধারার ওপর জরিপ চালিয়ে ও কুরআন অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, সে যুগের অনেক মুসলিম চিন্তাবিদ তাদের বই-পুস্তকে বিশদভাবে ক্রমবিকাশ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীদের মতো কোনো বৈজ্ঞানিক পরিভাষা ব্যবহার করেননি। …পাশ্চাত্যের পণ্ডিত ব্যক্তিরা যে মুসলিম ক্রমবিকাশের মৌলিক তত্ত্বগুলোকে ছিনতাই করে তাদের নিজস্ব উদ্ভাবনী বলেই দাবি করেছে শুধু তাই নয়, তথ্যভাণ্ডার থেকেও জেনে হোক আর না জেনে হোক, মুসলিম চিন্তাবিদদের নামও বাদ দিয়ে দিয়েছে।…এ যেন অনেকটা জর্জ ওয়াশিংটন, জন এডামস, টমাস জেফারসন ও আব্রাহাম লিঙ্কনকে বাদ দিয়ে আমেরিকার ইতিহাস লেখার মতো।’
(সূত্র : ইসলামে ক্রমবিকাশ তত্ত্ব: ডারউইন ও অরিজিন অব স্পিসিজের মধ্যকার হারানো সূত্র’- ড. টি. ও শানাভাস)
আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতি বর্তমান বিজ্ঞানীদের হাতে যে তথ্যভাণ্ডার তুলে দিয়েছে তার ভিত্তিতে একটি কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ডারউইনের তত্ত্বটির যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা আছে। আর সেই সীমাবদ্ধতার আলোকে তা আংশিক সত্যকে তুলে ধরেছে। সে যুগে বৈজ্ঞানিক তথ্যের স্বল্পতা হেতু ডারউইনের পক্ষে সেই সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না।
বর্তমান যুগে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ডারউইনের বিবর্তনবাদকে ভুল প্রমাণ করে না; বরং এর সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরে। বর্তমান যুগে বিজ্ঞানের অগ্রগতি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে আশা করা যায় ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান ডারউইনের বিবর্তনবাদের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে ক্রমবিকাশের সার্বিক তত্ত্বআবিষ্কার করতে সক্ষম হবে।
ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বের সীমাবদ্ধতাগুলো নিম্ন রূপ-
ক. ডারউইনের বিবর্তনবাদ DNA, RNA-এর উৎস সম্পর্কে কোনো তথ্যই দিতে পারে না। এ ধরনের আরো অনেক কিছুই বর্তমান বিজ্ঞানীদের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।
খ. Natural Selection-এর মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টিশক্তি গড়ে ওঠার বিষয়ে ডারউইন নিজেই যথেষ্ট সন্দীহান ছিলেন। চোখের মতো জটিল অঙ্গ প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিকশিত হওয়া আদৌ সম্ভব কি না সে ব্যাপারে তার তত্ত্বকোনোই আলোকপাত করতে পারেনি।
গ. প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যকার জটিল আন্তঃসম্পর্ক, তাদের সুসামঞ্জস্য, পারস্পরিক সহযোগিতা পূর্ণ ক্রিয়াশীলতা কখনোই Natural Selection I Survival of the fittes-এর মতো অন্ধ জান্তব প্রকৃতির অবদান হতে পারে না।
ঘ. বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে সংযোগ সেতু নির্মাণকারী জীবাশ্মের তালিকা আজো অসম্পূর্ণ। আশা করা যায় বিজ্ঞানীরা এই শূন্যস্থান ধীরে ধীরে পূর্ণ করতে সক্ষম হবেন।
জীববিজ্ঞানী Theodosus Obzhansky বলেন : ‘ক্রমবিকাশের আলোকে না দেখলে জীববিজ্ঞানের সব কিছুই অর্থহীন।’
কোনো মানবশিশু যেমন জন্মের সাথে সাথে সুঠাম সবল কর্মক্ষম হয়ে ওঠে না, একটি চারাগাছ যেমন অঙ্কুরোদগমের সাথে সাথেই ফুল-ফলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে না, সে জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা ও পরিচর্যা করতে হয়- ডারউইনের তত্ত্বটির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রাথমিক পর্যায়ে তথ্য-উপাত্তের স্বল্পতা হেতু তার সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে, বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের গতিধারায় তা পূর্ণতা লাভ করবে। কিন্তু ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বের বিরোধী গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসীদের সমস্যাটিও এখানেই তারা ধৈর্য ধরতে ও একে পূর্ণতা লাভের প্রয়োজনীয় সময়টুকুও দিতে নারাজ।
ডারউইনের ক্রমবিকাশের তত্ত্বটি মূলত প্রাণিজগত ও প্রকৃতির দ্বান্দ্বিক সম্পর্কভিত্তিক। আধুনিক জীববিজ্ঞানের তত্ত্বসমূহ যথা- Genetics, Biochemistry, Ecology Neurobiology, Physiology, I Quantum Biology-সহ জীববিজ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট জটিল বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে বর্তমানে বিবর্তনবাদ Micro-Evolutionary পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। এই দুইয়ের সমন্বয়েই হয়তো ভবিষ্যতে গড়ে উঠবে সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে ‘অখণ্ড বিবর্তনবাদ তত্ত্ব’।
বস্তুবাদী বা প্রকৃতিবাদী অবস্থান মূলত নাস্তিকতাবাদী বা বহুত্ববাদী ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত যা সৃষ্টিকে স্রষ্টার আসনে বসানোর প্রয়াস পায়। বস্তুবাদী দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের মতে মহাবিশ্ব নিজেই সয়ম্ভূ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। এর কোনো স্রষ্টার প্রয়োজন নেই। এর সৃষ্টিপ্রক্রিয়া এককালীন ও আকস্মিক। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র দিয়ে নিয়ন্ত্রিত একটি দুর্ঘটনা মাত্র। কুরআনের মতে বিশ্বজগৎ সয়ম্ভূ হওয়ার ধারণা মিথ্যা ও অলীক কল্পনা মাত্র। বস্তুজগতের ক্রম-বিকাশের প্রত্যেক স্তরে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর হুকুম (আমর) কার্যকরী থেকে তাকে নির্ধারিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
একজন বিজ্ঞানী যত প্রতিভাবানই হোন না কেন তার জ্ঞান স্থান ও কালের গণ্ডিতে আবদ্ধ। একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আপাত দৃষ্টিতে যতই সম্ভাবনাময় ও বৈপ্লবিক মনে হোক না কেন, স্থান ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে তা একটি আপেক্ষিক সত্যকেই প্রকাশ করে। এই আপেক্ষিক সত্যটি চিরন্তন সত্যের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নিজেকে ক্রমান্বয়ে পরিশীলিত করে তোলে। ক্রমবিকাশের আবর্তে সদা-ঘূর্ণায়মান মানুষের কোনো জ্ঞানকে অভ্রান্ত ও চিরন্তন বলে মেনে নেয়ার পেছনে কোনো যুক্তি আছে কি? চার্লস ডারউইনের ক্রমবিবর্তনের ধারণাটিও এর ব্যতিক্রম নয়।
ক্রমবিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে কুরআনের ধারণাগত অবস্থান তৌহিদ বা একত্ববাদের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ ধারণা সমন্বিত ও বহুমুখী ক্ষুদ্র-বৃহৎ নির্বিশেষে মানব জীবন তথা আল্লাহর পুরো সৃষ্টিচক্রকে বেষ্টন করে গড়ে উঠেছে। আল্লাহর সৃজনশীল ক্রমবিকাশের তত্ত্বপ্রকৃতিবিজ্ঞানের একাধিক শাখার (যথা- পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জৈবরসায়ন বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান, কোয়ান্টাম তত্ত্বও জেনেটিক বিজ্ঞানের) সমন্বিত ধারণার ওপর গড়ে উঠেছে। এসব বহুমুখী জ্ঞানের মাধ্যমে সংগৃহীত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতা ভিত্তিক তথ্যপ্রবাহ সম্মিলিতভাবে অতিন্দ্রীয় বাস্তবতা উপলব্ধিতে সহায়তা করে। মানুষের ক্রমবিকাশের অন্তর্নিহিত সত্য উদ্ঘাটনের নিমিত্তে কুরআনের নির্দেশিত পথ এটিই। কাজেই এ কথা নির্বিধায় বলা চলে, ডারউইনের বিবর্তন মতবাদের ওপর চূড়ান্ত মত প্রকাশের সময় এখনো আসেনি।
স্রষ্টার সৃষ্টিরহস্য উদ্ঘাটনের অন্তহীন পথ এখনো সামনে পড়ে রয়েছে। সুতরাং সাবধানে, হিসাব করে পা ফেলাই ভালো। কিন্তু যারা বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্কুলের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে বেহিসাবি পা ফেলেছেন, তারা কুরআনের আলোকে বিজ্ঞান শিক্ষার পরিবর্তে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আদলে বিজ্ঞানকে কুরআনের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন। কুরআনের মৌলিক শিক্ষাকে গুরুত্ব না দিয়ে পশ্চিমা ধাঁচে বিজ্ঞান শিক্ষা শিশুদের মন-মানসে কতখানি বিরূপ প্রতিক্রয়া সৃষ্টি করতে পারে সে হিসাব তারা করেননি। তারা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিলেন- কিন্তু কেন? কুরআনের দৃষ্টিতে ‘ঈমান’ ও অন্ধবিশ্বাস এক নয়। যথাযথ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টিরহস্য অনুধাবন ও উপলব্ধির মধ্যেই ঈমানের আসল তাৎপর্য নিহিত। সত্য উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে অস্বীকার করে পাশ্চাত্য সভ্যতা ঈমান ও বিজ্ঞানকে পরস্পর প্রতিপক্ষ হিসেবে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এটিই হলো সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। পক্ষান্তরে ইসলাম এতদুভয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের আদেশ দিয়েছে।
বিশ্ব-সৃষ্টির ধারণাগত অবস্থান সম্পর্কে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের নিম্নলিখিত উক্তিগুলো প্রণিধানযোগ্য :
ক. মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে আমার ধারণা ধর্ম ও বিজ্ঞানের সীমান্তরেখা বরাবর অবস্থান করছে। কিন্তু আমি বিজ্ঞানের দিকে থাকতেই পছন্দ করি।
খ. বিজ্ঞানের সামগ্রিক ইতিহাস এ কথাই প্রমাণ করে, পৃথিবীর কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্নভাবে ঘটে না। কার্যকারণ সূত্রে আবদ্ধ বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে একটি সুসামঞ্জস্য ঐক্য বিদ্যমান। এটি কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির কারণে হতে পারে বা নাও হতে পারে।
গ. আমরা মানুষ জাতি আসলে বাঁদরের উন্নত প্রজাতি। মাঝারি এক তারকালোকের ছোট্ট একটি গ্রহে যাদের অবস্থান। কিন্তু বিশ্বকে বোঝার সক্ষমতা আমাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছে।
ঘ. এই মহাবিশ্বের নিয়ম হলো এই যে, এখানে কোনো কিছুই নিখুঁত নয়। আসলে নিখুঁত বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই। খুঁত ছাড়া তুমি আমি কেউই এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারতাম না।
অর্থাৎ এখানেও হকিংস ধর্ম ও বিজ্ঞানের সীমান্তরেখা বরাবর অবস্থান নিয়েছেন। বিশ্বজগতের উৎপত্তি, সৃষ্টি-প্রশাসন ও ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে হকিংস বস্তুবাদী অবস্থানের উপরই দাঁড়িয়ে আছেন। যে সব বিষয় বর্তমানে আমার জ্ঞান-বুদ্ধির অগম্য বলে মনে হচ্ছে তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা কি যুক্তিসঙ্গত? বস্তুবাদী দার্শনিকদের কাছে এর কোনো জবাব আছে কি?
আল্লাহ বলেন- ‘… অসীম দয়ালু আল্লাহ পাকের এ (নিপুণ) সৃষ্টির কোথাও কোনো খুঁত আপনি দেখতে পাবেন না; আবার (তাকিয়ে) দেখুন তো, কোথাও কি আপনি কোনো রকম ফাটল দেখতে পান? অতঃপর (আপনার) দৃষ্টি ফেরান (আসমানের প্রতি), দেখুন, আরেকবারও আপনার দৃষ্টি ফেরান, (দেখবেন, আপনার) দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে আপনার দিকেই ফিরে আসবে’ (সূরা-৬৭ : আয়াত : ৩-৪)।
বস্তুবাদী বিজ্ঞানী হকিংস যাকে খুঁত বলেছেন আল-কুরআনের দৃষ্টিতে তা হলো অপূর্ণতা, সময়ের সাথে ক্রমবিকাশের পথ ধরে যা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হবে। আল্লাহর সৃষ্টির কোথাও কোনো খুঁত নেই। কিন্তু স্রষ্টা তাঁর পুরো সৃষ্টিকে অপূর্ণতার ক্ষুধা দান করেছেন। আর এই অপূর্ণতার ক্ষুধা নিবৃত্তির লক্ষ্যে আল্লাহ সৃজনশীল ক্রমবিকাশের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। কুরআন পুরো সৃষ্টিজগতের ক্রম-বিকাশকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। মহা-বিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাজাগতিক ভ্রুণের ক্রমবিকাশ, মাটির গভীরে বীজের ক্রমবিকাশ, মাতৃজঠরে জীব-ভ্রুণের ক্রমবিকাশ, মানবসভ্যতা, নৈতিকতা, ধর্ম ও সমাজ-সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ- এর কোনো কিছুই কুরআনের দৃষ্টিসীমার বাইরে নয়।
বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মতে- ‘বিশ্ব-প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের ধারণা আসলে মানুষের বহির্বিশ্ব তথা বস্তুজগতের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত সত্তা থেকে উদ্ভূত’
আইনস্টাইনের এই বক্তব্য বস্তু ও চেতনা বিষয়ে বস্তুবাদী ধারণার ঠিক বিপরীত। যা প্রমাণ করে, আইনস্টাইন বস্তুবাদী বা নাস্তিক ছিলেন না। আল-কুরআনের মতে, সৃষ্টিজগত সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান আল্লাহ কর্তৃক আদমকে প্রদত্ত জ্ঞানেরই ধারাবাহিকতা। (আইনস্টাইন যাকে বহির্বিশ্বের নিয়ন্ত্রণহীন মানবমনের সৃষ্টি বলে উল্লেখ করেছেন।)
‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে, জমাট রক্তপিণ্ড থেকে। পড়ো, তোমার সেই মহান দয়ালু প্রভুর নামে, যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি এমন কিছু তাকে শিখিয়েছেন, যা তিনি না শেখালে সে জানতেই পারত না। অথচ এই মানুষটিই বড় হয়ে বিদ্রোহে মেতে ওঠে। সে দেখতে পায় এখন তার কোনো অভাব নেই। অথচ এ নির্বোধ ভেবে দেখে না (একদিন) প্রভুর কাছেই তার প্রত্যাবর্তন হবে’ (সূরা-৯৬, আয়াত : ১-৮)।
একদা নাস্তিক ব্রিটিশ দার্শনিক ‘অ্যান্থনি ফ্লুর’ শেষ জীবনের উপলব্ধি, ‘বোধের অগম্য সীমাহীন বুদ্ধিসম্পন্ন এক সত্তার অস্তিত্ব স্বীকারের মাধ্যমেই কেবল জীবনের উৎস ও প্রাকৃতিক জটিলতার ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব।’ বস্তুবাদী বিজ্ঞানী রিচার্ড ডাউকিন ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটিকে অন্ধ ঘড়ি নির্মাতার সাথে তুলনা করেছেন। যার ভবিষ্যৎ দেখার কোনো ক্ষমতা নেই। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীন যা জীবজগতের অস্তিত্বের তাৎক্ষণিকতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। অপর দিকে, কুরআনের আলোকে আল্লাহর সৃজনশীল ক্রমবিকাশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো তাঁর পুরো সৃষ্টি বিশেষ করে মানব জাতিকে অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার পথে এগিয়ে নেয়া।
নাস্তিকতা ও দুর্বল ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত জ্ঞান আদৌ কোনো জ্ঞান নয়, নিঃসন্দেহে তা অজ্ঞানতা বা ‘জাহিলিয়া’। এ জ্ঞান মানুষের কোনো মঙ্গল করে না; বরং বিপর্যয় ডেকে আনে এবং মানব জাতির পুরো অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তোলে। মানুষের অতীত ও বর্তমান ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দেয়।