শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর যখন বিভিন্ন মহল থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা ও নির্বাচনের বাইরে রাখার নানা তৎপরতা চলছে, তখন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভিন্ন কথা বলেছেন।
তাঁর ভাষায়, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে নেবে। আমি তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক না। আমি নির্বাচন করব, অন্যদলগুলো করবে। জনগণ যাদের বেছে নেবে, তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’ সেই সঙ্গে তিনি এ–ও যোগ করেছেন, ‘যেই ব্যক্তিগুলো গণহত্যা, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা যেন নির্বাচনে অংশ না নেন, সেটাই আমাদের বক্তব্য।’ (প্রথম আলো, ৪ অক্টোবর ২০২৪)
আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিএনপির যেসব নেতা বারবার কারারুদ্ধ ও মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে মির্জা ফখরুল অগ্রগণ্য। সর্বশেষ গত বছর ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ পণ্ড হওয়ার একদিন পর রাত তিনটায় তাঁকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁর বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা প্রায় শখানেক।
বাংলাদেশে মির্জা ফখরুলই একমাত্র নেতা যিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েও শপথ নেননি। সংসদ সদস্য হিসেবে পাওয়া সুযোগ সুবিধার চেয়ে তিনি দলের মর্যাদাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। মির্জা ফখরুল ব্যক্তিগত খেদ ও মনোবেদনা ভুলে গিয়ে দেশের গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদে যেটি ভালো মনে করেছেন, সেটাই বলেছেন।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘না, আমরা চাই না দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হোক। কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমরা নই।’ এ ক্ষেত্রে আমরা আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার কথা মনে করতে পারি। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করায় আওয়ামী লীগ লাভবান হয়নি। বরং জামায়াতের প্রতি মানুষের সহানুভূতি বেড়েছে।
প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল এমন কিছু কথা বলেছেন, যা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা কিংবা অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার পছন্দ হবে না। এমনকি বিএনপি ও জোটের কট্টরপন্থী নেতারাও ভালো চোখে দেখবেন না। আওয়ামী লীগের পতনের পর এর কৃতিত্ব নিয়েও রাজনৈতিক দল ও ছাত্রনেতাদের মধ্যেও মতভেদ স্পষ্ট।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলো পনেরো বছর আন্দোলন করেও স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে পারেনি, তাঁরা ঘটিয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ একে বিপ্লব ও দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিন্তু একটি দেশে স্বাধীনতা একবারই আসে। সাতচল্লিশকে নাকচ করেই একাত্তর এসেছিল। দু্ হাজার চব্বিশ একাত্তরকে নাকচ করেনি। বরং একাত্তরের যে মৌল চেতনা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যের অবসান, সেই পথে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
ছাত্র আন্দোলনের বিজয় প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব বলেছেন, ‘আমরা রাজনীতিকেরা পুরো ক্ষেত্রটা তৈরি করেছি। জুলাইয়ে এই আন্দোলন শুরুর আগপর্যন্ত আপনারা দেখেছেন, আমরা কীভাবে আন্দোলন করেছি। এমনকি এই জুলাইয়ে সবার আগে জেলে গেছে আমাদের লোকজন। এই আন্দোলনে আমাদের হিসাবমতে, ৪২২ জন বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থক নিহত হয়েছেন। আন্দোলনের ক্ষেত্রটা পুরোপুরিভাবে তৈরি করা।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কেউ বলেছেন, এটা বিপ্লবী সরকার। ছাত্রজনতার বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে যেহেতু এই সরকার প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বাস্তবে তারা বর্তমান সংবিধানের অধীনে ও আওয়ামী লীগের মনোনীত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দীনের কাছেই শপথ নিয়েছেন। এটা সাংবিধানিক সরকার।
প্রশ্ন উঠেছে, সংস্কারের পর নির্বাচন না নির্বাচনের পর গঠিত রাজনৈতিক সরকার সংস্কার কাজ করবেন? বিএনপি ও তাদের সহযাত্রী দলগুলো মনে করে, ‘নির্বাচিত সরকারকেই রাষ্ট্রের প্রকৃত সংস্কারের কাজটি করতে হবে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে এই সরকার দায়িত্ব নিলেও তারা কোনো বিপ্লবী সরকার নয়। বর্তমান সংবিধানের অধীনেই তারা শপথ নিয়েছে।’
মির্জা ফখরুল অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আপনাকে যদি প্রশ্ন করি যে হু আর ইউ, আপনি কে—এসব সংস্কার করছেন, সংবিধান সংস্কার করছেন। আপনি কে আসলে? আপনার স্ট্যাটাসটা কী? একটা আন্দোলন করে ছেলেরা আপনাকে বসিয়ে দিয়েছে আর আপনি সব দায়িত্ব পেয়ে গেছেন? আই ডোন্ট থিংক সো (আমি সেটা মনে করি না)। আপনাকে অবশ্যই এটা জনগণের মাঝ থেকে আনতে হবে। আর জনগণ থেকে আসার একমাত্র পথ হচ্ছে নির্বাচন।’
গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম অবশ্য বলেছেন, ‘উপদেষ্টা পরিষদ বিপ্লবকে রিপ্রেজেন্ট করে। তারা জনগণের সরকার।’ এই সরকার যে অভিপ্রায় অনুযায়ী গঠিত, তা কেউ অস্বীকার করছেন না।
অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাষ্ট্রীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত ছয় কমিশন রিপোর্ট দেওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ভবিষ্যৎ রূপরেখা ঠিক করবে। রাজনৈতিক দলগুলো এর সঙ্গে একমত হয়নি। তারা বলেছে, কমিশন সবকিছু ঠিক করে তাদের সঙ্গে বসার অর্থ হয় না। রাজনৈতিক দলগুলোই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। কমিশনের সদস্য বাছাইসহ পুরো সংস্কারপ্রক্রিয়ায় তাদের ভূমিকা থাকা উচিত।
১ অক্টোবর থেকে কমিশনগুলোর কাজ শুরুর কথা থাকলেও, তা হয়নি। অবশ্য সরকারের একটি সূত্র জানিয়েছে, কমিশন প্রধানেরা কাজ শুরু করে দিয়েছেন। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে বসছেন।
এই প্রেক্ষাপটে ছয় কমিশনের কাজের অগ্রগতি জানাতে আজ শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে রাজনৈতিক দলগুলোকে বৈঠক ডেকেছেন, তার সাফল্য নিয়েও প্রশ্ন আছে। কিন্তু বৈঠকের ধরন নিয়ে কোনো কোনো নেতা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বিএনপি ও জামায়াতকে আলাদাভাবে আমন্ত্রণ জানানো হলেও গণতন্ত্র মঞ্চের শরিকদের ডাকা হয়েছে যৌথভাবে। আলাপকালে গণতন্ত্র মঞ্চের একজন নেতা জানান, তাঁদের জন্য নির্ধারিত সময় আধা ঘণ্টা। এই বৈঠকে সংস্কার কমিশন ছাড়াও আসন্ন দুর্গাপূজার সময়ের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হবে। ফলে তাঁদের( নেতাদের) মতামত জানানোর সুযোগ কমই থাকবে।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জাতীয় পার্টির নেতারা আমন্ত্রণ পাননি। প্রথম দফায় জাতীয় পার্টিকে আমন্ত্রণের বিষয়ে অনেকে আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য হলো, ১৪ দলের নেতারা যদি স্বৈরাচারের সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত হয় জাতীয় পার্টি নয় কেন?
নাগরিক সমাজের অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটোই পরীক্ষিত।
ক্ষমতায় থাকতে কেউ গণতন্ত্র দিতে পারেনি। এ অবস্থায় রাজনীতিতে তৃতীয় ধারা প্রতিষ্ঠা জরুরি। কিন্তু সেটা কাদের নিয়ে? জামায়াত বা জাতীয় পার্টি নিশ্চয়ই নয়। দিশা হারা বামেরাও কোনো পথ দেখাতে পারছে না।
তাহলে কারা সেই নতুন পথের যাত্রী হবে? প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মাহফুজ আলম প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নতুন রাজনৈতিক পরিসরের কথা বলেছেন। কিন্তু সেটা কাদের নিয়ে, কত দিনে?
- সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি
- prothom alo