সরকারের নির্বাহী আদেশে এক বছরের মাথায় গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে সাড়ে ৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে বছরে অতিরিক্ত ২০০০ কোটি টাকার আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশের বিদ্যুৎ গ্রাহকের উপর । নতুন দর অনুসারে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে বাড়ছে ৭০ পয়সা। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের বিল থেকেই নতুন এ দাম কার্যকর করা হবে।
কোন ধরনের গণ শুনানি না করেই নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের নতুন দাম নির্ধারণ করে বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারি করছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এতে বাসা বাড়িতে সবচেয়ে কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের জন্য বাড়ছে ইউনিটপ্রতি ২৮ পয়সা। আর সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের জন্য বাড়ছে ১ টাকা ৩৫ পয়সা। সেচে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম বাড়ছে ৪৩ পয়সা।
মূল্যবৃদ্ধির ফলে ইউনিটপ্রতি খুচরা বিদ্যুতের দাম গড়ে ৮ টাকা ২৫ পয়সা থেকে বেড়ে ৮ টাকা ৯৫ পয়সায় দাঁড়াচ্ছে। আর পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে গড়ে ৫ শতাংশ। এতে পাইকারি বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ টাকা ৪ পয়সায়।
ইতিমধ্যে পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। খুচরায় দাম বৃদ্ধির বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এর আগে সর্বশেষ গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন দফায় প্রতি মাসে গড়ে ৫ শতাংশ করে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। এ ছাড়া গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে গড়ে ৮ শতাংশ বাড়ানো হয় পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভণর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালহেউদ্দনি আহমদে বলনে, দেশের বিদ্যুৎ আর জ্বালানি এমন একটি খাত যার প্রভাব অর্থনীতির সব কছিুর ওপরই পরিলক্ষিত হয়। ছোট-বড় সব শিল্পই জ্বালানরি ওপর নর্ভির করে। এমনকি অতপ্রিয়োজনীয় ওষুধেরও সর্ম্পক রয়েছে বিদ্যুৎ আর জ্বালানরি দামের সঙ্গে। অনেক কারখানা মাসে কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল দেয়। ছোট ব্যবসা প্রতষ্ঠিানও এখন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল দয়ে। জ্বালানির অতিরিক্তি টাকা তো উৎপাদন খরচের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। বাজার পরস্থিতি মানুষের এমনতিইে নাগালরে বাইরে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়রে। মূল্যস্ফীতি দশের ঘর ছাড়িয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ হবে।
এদিকে নতুন দর অনুযায়ী সেচে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ৮২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা ২৫ পয়সা করা হয়েছে। নিম্নচাপে (২৩০/৪০০ ভোল্ট) বাণিজ্যিক ও অফিসে গড় দাম ১১ টাকা ৯৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৩ টাকা ১ পয়সা করা হয়েছে। মধ্যম চাপের (১১ কিলো ভোল্ট) ক্ষেত্রে এটি করা হয়েছে গড়ে ১১ টাকা ৬৩ পয়সা। উচ্চ চাপে (৩৩ কিলো ভোল্ট) শিল্পের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট গড়ে ৯ টাকা ৯০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ৭৫ পয়সা করা হয়েছে। আর অতি উচ্চ চাপে (১৩২ ও ২৩০ কিলো ভোল্ট) ৯ টাকা ৬৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ৬৬ পয়সা করা হয়েছে। ভারী শিল্পকারখানা মূলত এ শ্রেণির গ্রাহক। এ ছাড়া শিক্ষা, ধর্মীয়, হাসপাতাল ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ৬ টাকা ৯৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ৫৫ পয়সা করা হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎ কিনে নেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এরপর তারা উৎপাদন খরচের চেয়ে কিছুটা কমে সরকার নির্ধারিত পাইকারি দামে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কাছে বিক্রি করে। ঘাটতি মেটাতে পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নেয়। তবে বিতরণ সংস্থাগুলো কোনো ভর্তুকি পায় না। তারা খুচরা দামে ভোক্তার কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে মুনাফা করছে।
বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ সামলাতে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ নিয়ে গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) পিডিবি লোকসান করেছে ৪৩ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। এ ক্ষতির দায় কাটাতে ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ করেছে সরকার। এদিকে দেশের বিদ্যুৎ খাতে ভর্তূকির টাকা নগদে পরিশোধ না করে সরকারী বন্ডে সরকারী আর বেসরকারী ব্যাংকের কাছে বিক্রি করছে সরকার ।
এর আগে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করত এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আইন সংশোধন করে বিইআরসির পাশাপাশি দাম বাড়ানোর ক্ষমতা হাতে নেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। আওয়ামী লীগ সরকার গত জানুয়ারী মাসে ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর জনগণের কোন ধরনের মতামতের তোয়াক্কা না করে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়াচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বাংলা আউটলুক