ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক দুই প্রভাবশালী পরিচালক রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদারের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিরুদ্ধে ব্যাংকটির ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বিদেশে ৭১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ব্যয় ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রয়াত জয়নুল হক সিকদারের এ দুই সন্তান ছাড়াও মামলায় বেসরকারি ব্যাংকটির সাবেক তিন ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) পাঁচ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। দুদকের পরিচালক মো. বেনজীর আহম্মদ বাদী হয়ে রোববার মামলা দুটি দায়ের করেন।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক এমডি শাহ সৈয়দ আব্দুল বারী, এএসএম বুলবুল, চৌধুরী মোশতাক আহমেদ, সাবেক এএমডি এমএ ওয়াদুদ ও কার্ড ডিভিশনের সাবেক প্রধান মো. মাহফুজুর রহমান।
মামলার এজাহারে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী যেকোনো বাংলাদেশীর বছরে বিদেশে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ডলার ব্যয় করার সুযোগ রয়েছে। সে হিসাবে রন হক সিকদারের পাঁচ বছরে বৈধভাবে সর্বোচ্চ ব্যয় করার কথা ৬০ হাজার ডলার। কিন্তু রন হক সিকদার এ পাঁচ বছরে বিদেশে ব্যয় করেছেন ৬১ লাখ ৫২ হাজার ২২৫ ডলার। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ন্যাশনাল ব্যাংকের সাতটি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে এ অর্থ ব্যয় করা হয়। অর্থাৎ এ সময়ে রন হক সিকদার বিদেশে ৬০ লাখ ৯২ হাজার ২২৫ ডলার সীমার অতিরিক্ত ব্যয় করেছেন। তৎকালীন বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় এ অর্থের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা।
বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদিত দর অনুযায়ী প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকা। সে অনুযায়ী রন হক সিকদার বিদেশে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অতিরিক্ত ব্যয় করেছেন ৬৭ কোটি টাকার বেশি।
দায়েরকৃত অন্য মামলার এজাহারে বলা হয়, রিক হক সিকদার ন্যাশনাল ব্যাংকের ছয়টি ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বিদেশে সীমাতিরিক্ত ব্যয় করেছেন ২৬ লাখ ২২ হাজার ৪৯৯ ডলার। তৎকালীন বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ২১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। সে অনুযায়ী, ওই সময়ের বিনিময় হারের হিসাবেই দুজনে বিদেশে সীমাতিরিক্ত ব্যয় করেছেন ৭১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
ক্রেডিট কার্ড ছাড়াও ন্যাশনাল ব্যাংকের হিসাব থেকে থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হয়েছে বলে দুদকের মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়। এতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) অনুসন্ধান প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, থাইল্যান্ডে রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদারের নিজ নামে এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে অন্তত ২০টি ব্যাংক হিসাব পরিচালিত হচ্ছে। এসব ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন সময়ে ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে। আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ড, চীন, ভিয়েনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন ও রাশিয়া থেকে হিসাবগুলোয় অর্থ স্থানান্তরের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ দুই ভাই ন্যাশনাল ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিদেশে ডলার ব্যয় করে পরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার করে তা দিয়ে কার্ডের ঋণ পরিশোধ করেছেন। পাচারকৃত অর্থ স্থানান্তর, রূপান্তর ও গোপনের মাধ্যমে বৈধতা দানের চেষ্টা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। এজাহারে বলা হয়, তারা দুর্নীতিবিরোধী আইন-১৯৪৭-এর ৫ (২) ধারা, দণ্ডবিধির ১০৯ ধারা ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২-এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদী ও দুদকের পরিচালক মো. বেনজীর আহম্মদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দীর্ঘ অনুসন্ধান ও তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই মামলা দুটি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে পুরো ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংকের আরো অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। পর্যায়ক্রমে সেগুলোর বিষয়েও আইনি পদক্ষেপ আসবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলোর কোনো ক্রেডিট কার্ডের অনুকূলে জামানতবিহীন সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা ও জামানতসহ সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার ঋণসীমার সুযোগ রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সিকদার পরিবারের এ দুই সদস্য দেশের সব আইন ও রীতিনীতিই ভঙ্গ করেছেন। ব্যাংকটির এমডিসহ কর্মকর্তারা এক্ষেত্রে সহযোগীর ভূমিকায় ছিলেন।
ন্যাশনাল ব্যাংকের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে গতকাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত ১৫ বছর ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি পদে দায়িত্ব পালনকারী সবাই ছিলেন সিকদার পরিবারের অনুগত। জয়নুল হক সিকদার ও তার সন্তানদের যেকোনো অন্যায় দাবি তারা অবলীলায় পালন করেছেন। ব্যাংকের ঋণ বিতরণের নামে তারা ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন নিয়েছেন। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিতরণকৃত অন্তত ৫০টি বড় ঋণের বিষয়ে বর্তমানে দুদক তদন্ত করছে।’
প্রসঙ্গত, এক যুগের বেশি সময় ধরে সিকদার পরিবারের একচ্ছত্র কর্তৃত্বে পরিচালিত হয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। প্রয়াত জয়নুল হক সিকদারের হাত ধরে সৃষ্টি হওয়া সে কর্তৃত্বের অবসান হয় গত বছরের শেষের দিকে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে সাত সদস্যের পর্ষদ গঠন করে দেয়া হয়।
পর্ষদ ভেঙে দেয়ায় প্রয়াত জয়নুল হক সিকদারের স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে ছিটকে যান। একই সঙ্গে জয়নুল হক সিকদারের ছেলে রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার ব্যাংকটির পরিচালক পদ হারান। ওই পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে কেবল পারভীন হক সিকদার ব্যাংকটির নতুন পর্ষদে স্থান পান। তিনি জয়নুল হক সিকদারের কন্যা।
সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার স্বাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়, বিধিবিধান লঙ্ঘন করে ঋণ অনুমোদন করা, পরিচালনা পর্ষদের ক্ষমতার অপব্যবহার, পরিচালক নির্বাচনে জটিলতা সৃষ্টি, আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকায় ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা হলো। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সুপারিশের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আদেশে উল্লেখ করা হয়।
ন্যাশনাল ব্যাংকে সিকদার পরিবারের পূর্ণ কর্তৃত্বের শুরুটা ২০০৯ সালে। ওই সময় ব্যাংকটির কর্তৃত্ব সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের হাতে চলে যায়। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন ও মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিকে ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদে যুক্ত করেন তিনি। ব্যাংক কোম্পানি আইনে একই পরিবারের সর্বোচ্চ চারজন সদস্য পর্ষদে থাকার বিধান থাকলেও সিকদার পরিবারের পাঁচ সদস্য ছিলেন ন্যাশনাল ব্যাংক পর্ষদে। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা অন্য উদ্যোক্তারা গত এক যুগে তেমন কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেননি। বেশির ভাগ উদ্যোক্তা পরিচালক ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ থেকেও ছিটকে পড়েন।
প্রয়াত জয়নুল হক সিকদার ন্যাশনাল ব্যাংকের ১১ সদস্যের পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ওই দিন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এরপর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হন তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। মূলত এ দম্পতির সন্তানদের বিরোধের কারণেই মনোয়ারা সিকদার ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তবে মনোয়ারা সিকদার চেয়ারম্যান হলেও ব্যাংক পরিচালনায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদারের হাতে। বিষয়টি নিয়ে ভাইদের সঙ্গে বিরোধে জড়ান পারভীন হক সিকদার।
জয়নুল হক সিকদারের মৃত্যুর পর ন্যাশনাল ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে কিছুটা কঠোর হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতেই ব্যাংকটির নড়বড়ে আর্থিক পরিস্থিতি সামনে আসতে শুরু করে। ২০২২ সালে ব্যাংকটির নিট লোকসান দাঁড়ায় ৩ হাজার ২৬১ কোটি টাকায়। আর গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি শুধু পরিচালন লোকসানই দিয়েছে ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকার বেশি। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর), ঋণ-আমানত অনুপাত (এডি রেশিও), মূলধন, সঞ্চিতিসহ কোনো শর্তই পূরণ করতে পারছে না ব্যাংকটি।
ন্যাশনাল ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশ থেকে বর্তমানে কোনো আয় নেই। ন্যাশনাল ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি গত সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ৪২ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এর মধ্যে খেলাপির খাতায় উঠেছে ১৩ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। মামলায় আটকা পড়েছে ৭ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। বাকি টাকা খেলাপি না হলেও মেয়াদোত্তীর্ণ। আদায় অযোগ্য হওয়ায় অবলোপন করা হয়েছে আরো ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকার ঋণ।
bonik barta