বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা কম থাকলেও আন্তর্জাতিক দায়দেনা পরিশোধে বেশ স্বস্তিতে ছিল বাংলাদেশ। যথাসময়ে বিদেশী ঋণ ও ঋণপত্রের (এলসি) দায় পরিশোধ নিয়েও বেশ সুনামও অর্জন হয়েছিল। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রিজার্ভ কমে আসার পাশাপাশি দুর্বল হয়েছে বিদেশী ঋণ পরিশোধের সামর্থ্যও। ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহার করে বিদেশী ঋণের প্রায় ৭৪ শতাংশ পরিশোধের সক্ষমতা ছিল বাংলাদেশের। এখন এ সক্ষমতা নেমে এসেছে এক-চতুর্থাংশেরও নিচে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে দেশের মোট বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১১৭ কোটি বা ৪১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এক্ষেত্রে বিদেশী ঋণের তুলনায় রিজার্ভের অনুপাত ছিল ৭৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের রিজার্ভ দিয়েই ওই সময় বিদেশী ঋণের ৭৩ দশমিক ৭০ শতাংশ পরিশোধ করা সম্ভব ছিল। এর পর থেকে রিজার্ভ বাড়লেও বিদেশী ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা ক্রমাগত দুর্বল হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে বিদেশী ঋণ ও রিজার্ভের অনুপাত মাত্র ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের হাতে যে রিজার্ভ ছিল তা দিয়ে বিদেশী ঋণের মাত্র ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ পরিশোধ সম্ভব হতো।
গত অর্থবছর শেষে দেশের মোট বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে দেশের গ্রস রিজার্ভ মাত্র ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এ পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরেই বাংলাদেশের বিদেশী ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। যদিও এ সময়ে দেশের রিজার্ভ অস্বাভাবিক ক্ষয় হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী, গত ২৯ নভেম্বর দেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল মাত্র ২৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) রিজার্ভ ছিল ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ ছিল ১৬ বিলিয়ন ডলারেরও কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ। চলতি বছরে এরই মধ্যে বেসরকারি খাতের প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। তার পরও সরকারি-বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ স্থিতি দাঁড়ায় প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলারে। তবে বিদেশী কোম্পানিগুলোর বকেয়া জ্বালানি তেলের দাম, আমদানির বিলম্বিত এলসি দায়, প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় থাকা বিদেশী কোম্পানিগুলোর মুনাফা, বিদেশী এয়ারলাইনসগুলোর টিকিট বিক্রির অর্থসহ অন্যান্য দায় যুক্ত হলে স্বল্প সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে—এমন দায়ের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। দেশের বিদ্যমান রিজার্ভের পুরোটা ব্যয় করেও এসব দায় পরিশোধ সম্ভব হবে না বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন।
প্রায় একই কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরও। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এ নির্বাহী পরিচালক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কোনো দেশের স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ নিট রিজার্ভের চেয়ে বেশি হয়ে গেলে সেটি বিপজ্জনক। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ ও অন্যান্য দায় এ রিজার্ভের চেয়ে বেশি। সে হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। আগামী বছর থেকে দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপও বাড়তে থাকবে। ডলারের জোগান না বাড়লে পরিস্থিতি খুবই খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে।’
এ বিষয়ে তার ভাষ্য হলো, ‘বিভিন্ন সময়েই দেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত তুলে ধরে বলা হয়, বাংলাদেশের এখনো আরো অনেক বেশি বিদেশী ঋণ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের মতো দেশে বিদেশী ঋণ-জিডিপির অনুপাত হিসাব করাই অর্থহীন। কারণ বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৮ শতাংশ। এর অর্থ হলো সরকার নিজস্ব আয় দিয়ে ঋণ পরিশোধে সক্ষম নয়। এজন্য এখানে জিডিপির সঙ্গে ঋণের অনুপাত হিসাব করে কোনো লাভ নেই। বাংলাদেশে ঋণের অনুপাত তুলনা করতে হবে সরকারের রাজস্ব আয়ের সঙ্গে। কোনো দেশের ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ২০০-২৫০ শতাংশ পর্যন্ত মেনে নেয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ৪০০ শতাংশের বেশি। সে হিসাবে দেশের ঋণ অনেক আগেই বিপজ্জনক মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরেই দেশের বিদেশী ঋণের স্থিতি ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে সরকার ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর ঋণ ৭৯ বিলিয়ন ডলার। বাকি ২১ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত। বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া ঋণের প্রায় ৮৪ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি। বাকি ১৬ শতাংশ বা ১৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ স্বল্পমেয়াদি।
বিদেশী ঋণসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে দেশের স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণের স্থিতি ছিল রিজার্ভের মাত্র ২৩ শতাংশ। এর পর থেকে ক্রমাগতভাবে রিজার্ভের তুলনায় স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণের অনুপাত বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে এ অনুপাত ৫০ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে রিজার্ভের তুলনায় স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণের অনুপাত দাঁড়ায় ৬৫ দশমিক ৪০ শতাংশে। অর্থাৎ গত অর্থবছরে স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধে ব্যবহার হলেই রিজার্ভের ৬৫ শতাংশের বেশি ব্যয় হয়ে যেত। চলতি অর্থবছরে এসে রিজার্ভ ক্রমাগত ক্ষয় হলেও বিদেশী ঋণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের মোট বিদেশী ঋণের সিংহভাগই নেয়া হয়েছে গত ১০ বছরে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষেও বিদেশী উৎস থেকে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মোট ঋণ স্থিতি ছিল ৪১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৩৪ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার ছিল দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। বাকি ৬ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছিল স্বল্পমেয়াদি। ওই সময় বিদেশী ঋণ ছিল দেশের মোট জিডিপির ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এর পর থেকে বিদেশী ঋণ ক্রমাগত বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে এ ঋণের স্থিতি ৫৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৬২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারে।
বিদেশী ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ২০১৮ সালের পর। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি ৬৮ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ওই অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৮১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশী ঋণের প্রবৃদ্ধি হয় ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থবছর শেষে এ ঋণের স্থিতি ৯৫ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রত্যাহার করে নেয়। এতে বিদেশী ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধিও কমে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি ৯৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে তথা সেপ্টেম্বরে এসে বিদেশী ঋণের স্থিতি ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।
গত ১০ বছরে বিদেশী ঋণ যে হারে বেড়েছে, সেভাবে রিজার্ভের প্রবৃদ্ধি হয়নি। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত রিজার্ভের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৩৩ বিলিয়নে উন্নীত হয়। এরপর কভিড-১৯ সৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে রিজার্ভ ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যায়। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ২০২১ সালের আগস্টে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী, ওই সময় রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এর পর থেকেই রিজার্ভের ক্ষয় শুরু হয়। গত দুই বছরে প্রতি মাসে গড়ে এক বিলিয়ন ডলার করে রিজার্ভ কমেছে।
দেশের অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় সাম্প্রতিক সময়ে টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়েছে। গত বছরের জানুয়ারিতেও দেশের ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত দর অনুযায়ী প্রতি ডলারের আনুষ্ঠানিক বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ১১০ টাকা ২৫ পয়সায়। যদিও দেশের ব্যাংকগুলোয় ঘোষিত দরে ডলার মিলছে না। আমদানিকারকদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো ডলারপ্রতি ১২৫-১২৭ টাকাও আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সে হিসাবে এ সময়ে ডলারের বিনিময় হার প্রায় ৪৮ শতাংশ বেড়েছে। আর কার্ব মার্কেটে (খুচরা বাজার) তা ১৩০ টাকা পর্যন্তও উঠেছে।
দেশের একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানিয়েছেন, গতকাল মধ্যপ্রাচ্যের মানি এক্সচেঞ্জগুলো রেমিট্যান্সের প্রতি ডলার ১২৪ টাকা ৯০ পয়সা পর্যন্ত দরে বিক্রি করেছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের মানি এক্সচেঞ্জগুলো প্রতি ডলার ১৩১ টাকা ৩০ পয়সা পর্যন্ত প্রস্তাব করেছে। ব্যাংকগুলো এ দরে রেমিট্যান্স না কিনলে সেটি হুন্ডিতে চলে যাচ্ছে। দেশের কিছু ব্যাংক বাধ্য হয়ে এখন এ দরেও রেমিট্যান্স কিনেছে।
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কোনো দেশেরই অর্থনৈতিক সংকট অনন্তকাল চলতে পারে না। দেশে যে সংকট চলছে, সেটি এরই মধ্যে দেড় বছর অতিক্রম করেছে। আশা করছি, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে খুব বেশি সময় নেবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ডলার সংকট কাটাতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সেসব পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বিদেশী ঋণ নিয়ে আমরা এখনই উদ্বিগ্ন হতে চাই না। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বিদেশী ঋণের অনুপাত বাংলাদেশের চেয়ে বহুগুণ বেশি।’
বনিক বার্তা