বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো কতটা প্রয়োজনীয়– তা পর্যালোচনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে অনেক প্রকল্প বাদ পড়ছে। আবার কিছু প্রকল্পের বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে সরকার পরিবর্তন এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির ধাক্কা লেগেছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন চিত্রে তা বেশ স্পষ্ট।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম প্রান্তিকে এডিপি বাস্তবায়নের হার গত অর্থবছরের একই সময়ের প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। মাত্র ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। গত ১৩ অর্থছরে যা একই সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই হারে বাস্তবায়ন হলে অর্থবছর শেষে এডিপির একটা বড় অংশই অব্যয়িত থাকবে। এই বাস্তবতায় এডিপিতে বড় অঙ্কের কাটছাঁট আসছে। সরকারি অংশের পাশাপাশি বড় অঙ্কে উন্নয়ন সহযোগীদের দেওয়া ঋণের অর্থ বরাদ্দও কমানো হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, শেষ পর্যন্ত বিদেশি ঋণ বরাদ্দে অর্ধেকেরও বেশি কাটছাঁট করা হতে পারে।
চলতি অর্থবছরের এডিপির আকার ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ধরা হয় ১ লাখ কোটি টাকা। আর জিওবি বা সরকারি তহবিল থেকে রয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাকিটা বাস্তবায়নকারী বিভিন্ন সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন।
সূত্র জানায়, আগামী মাসে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) বিদেশি ঋণের বরাদ্দ নির্ধারণ করা হবে। এর আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলোর কাছে বরাদ্দ চাহিদা-সংক্রান্ত তথ্য চেয়েছে ইআরডি। চলতি অর্থবছর বিদেশি ঋণ সহায়তার প্রকল্প রয়েছে, এমন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ ৫৬টি। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে ইআরডির চিঠিতে প্রকল্পভিত্তিক হালনাগাদ বাস্তবায়ন চিত্র, প্রকল্পে অনুমোদিত মোট বরাদ্দ এবং বরাদ্দের মধ্যে সরকারের নিজস্ব ও বিদেশি ঋণের অংশ, উন্নয়ন সহযোগীর নাম, এ পর্যন্ত অর্থছাড়ের পরিমাণ ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার নামসহ প্রকল্পের বিভিন্ন তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। এসব তথ্য পূরণে কিছু সতর্কতা অনুসরণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে রয়েছে– প্রশাসনিক অনুমোদন নেই, এমন কোনো নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত না করা, প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি দেখা, এ পর্যন্ত ব্যয়ের ভিত্তিতে চাহিদা নির্ধারণ, প্রতিটি ব্যয় বিভাজন সুস্পস্ট করা ইত্যাদি।
ইআরডির সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, চলতি অর্থবছর সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়নের রেকর্ড হতে পারে। অনেকগুলো কারণে এবার এরকম হতে পারে। এর মধ্যে বিদেশি অর্থায়নের বিভিন্ন প্রকল্পে যেসব বিদেশি কর্মী, ঠিকাদার প্রতিনিধি ও পরামর্শক কাজ করতেন, তারা রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বাংলাদেশ ছেড়ে যান। তাদের বড় একটি অংশ এখনও ফেরেননি। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যক্রম কার্যত স্থগিত রয়েছে। এ ছাড়া এডিপিভুক্ত সব প্রকল্প পর্যালোচনা করছে সরকার। কিছু প্রকল্প বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। চলমান অনেক প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবও আটকে গেছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা শতাধিক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ফেরত দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে এডিপির বড় একটা অংশই এবার অব্যয়িত থেকে যাবে।
এ ছাড়া সরকারের একনেকের প্রথম বৈঠকেই এডিপিভুক্ত সব উন্নয়ন প্রকল্প যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকার মনে করছে, প্রয়োজনীয়তার দিক থেকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় এসব প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এডিপিতে এমন অনেক প্রকল্প আছে, যেগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এলাকার নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে নেওয়া হয়েছে। কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব ও ঠিকাদারদের স্বার্থে। সক্ষমতা প্রদর্শনে সামর্থ্যের বাইরেও উচ্চাভিলাষী কিছু ‘প্রেস্টিজ’ প্রকল্পও নেওয়া হয়। অত্যন্ত বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে এডিপিভুক্ত প্রকল্পগুলো। এ কারণে প্রতিটি প্রকল্প যাচাই-বাছাই করা জরুরি। মূল্যায়ন শেষে মান উত্তীর্ণ নয়– এমন প্রকল্প বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এডিপির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদেশি ঋণের বড় অংশ অব্যয়িত থাকার অন্য কারণের মধ্যে রয়েছে চলতি এডিপিতে এই উৎসে বড় বরাদ্দ রাখা। এবারের এডিপিতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ধরা হয় গত অর্থবছরের আরএডিপির চেয়ে ১৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বেশি। ওই অর্থবছর আরএডিপিতে বিদেশি ঋণের অংশ ছিল ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছর সংশোধনের পর এডিপির আকার দাঁড়ায় ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতি ধীর হওয়ায় উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থছাড় এবং নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতি কমিয়েছে। ইআরডির হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, এই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড় কমেছে ৪৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। মোট অর্থছাড় হয়েছে ৮৪ কোটি ৬১ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১২৮ কোটি ১৭ লাখ ডলার। নতুন করে ঋণ প্রতিশ্রুতিও কমেছে ৯৯ শতাংশ। মাত্র ২ কোটি ৭৪ লাখ ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ২৮৮ কোটি ডলার।
যা বলছেন অর্থনীতিবিদ
প্রকল্প বাস্তবায়নের বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমে যাওয়ার পরিণাম ভালো কী মন্দ– জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, বিগত দিনে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। নেতার ইচ্ছা এবং ঠিকাদারদের তুষ্টির জন্যও কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। জনগণের প্রয়োজন আছে কী নেই, প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে কতটা লাভজনক হতে পারে কিংবা পরিবেশ-প্রতিবেশের গুরুত্ব বিবেচনা না করে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ কারণে প্রকল্পের নির্মাণকাজ ব্যবহার উপযোগী পর্যায়ে আসছে না। অথচ ঋণ পরিশোধের সময় এসে গেছে।
তিনি আরও বলেন, এ ধরনের প্রকল্প শুধু জনগণের মাথার ওপর ঋণের বোঝাই চাপিয়েছে। এখন সরকার যদি বিচক্ষণতার সঙ্গে পর্যালোচনা করে পুরোনো এসব জঞ্জাল বাদ দেয়, সেটা অবশ্যই দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। এতে অর্থনীতির ওপর ঋণের যে বোঝা রয়েছে, তা কিছুটা কমবে। তবে প্রয়োজনীয় প্রকল্প যাতে বাদ না পড়ে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
samakal