ফারুক ওয়াসিফ
স্পষ্টতই ভারতের ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাচ্ছে বিজেপি। সঙ্গে হারাচ্ছে ভারতকে শতভাগ ‘হিন্দু নেশন’ বানানোর ইউটোপিয়া বা খোয়াব। ‘৪০০ আসন পার’ স্লোগান ঠেকে যাচ্ছে ৩০০-এরও নিচে। সংবিধানকে বদলে ফেলা, কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা থেকে সরাবার পর ‘রাজ্য’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়াও সম্ভবত ঠেকে গেল। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যেখানে থাকছে না, সেখানে সংবিধান বদলে ফেলা তো দূর অস্ত। দিল্লির মসনদে মোদি বসবেন বটে, কিন্তু রাজদরবারের খিলান দরজা দিয়ে বুক চিতিয়ে নয়, কিছুটা খাটো হয়ে ঢুকতে হবে এবার। এবার তাঁকে শুধু বিজেপির প্রধানমন্ত্রী বলা যাবে না। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হতে হবে এনডিএ জোটের শরিকদের সমর্থনের ঋণ নিয়ে। সেটাতেও না কুলালে ভিন্ন দল থেকে এমপি কেনাবেচায় নামতে হবে। সুতরাং ঋণ করে ঘি খাওয়ার চাপে থাকবেন তিনি ও তাঁর দল। পুনরুজ্জীবিত বিরোধী দল কংগ্রেস ও তাদের শক্তিশালী জোট ‘ইন্ডিয়া’-কেও এবার সমঝে চলতে হবে তাঁকে। ভারতের পার্লামেন্টে আর একচেটিয়া ক্ষমতার দম্ভ দেখানোর জায়গা থাকবে না। শরিকদের মন জুগিয়ে চলার ঠ্যাকা বিজেপি কীভাবে সামলায়, তা এখন দেখার অপেক্ষা।
‘ঘরের ছেলের’ কাছে হার ‘ডাবল ইঞ্জিনে’র
বলা হয়, উত্তরপ্রদেশ যার, দিল্লির সিংহাসন তার। সেই উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী দল ও কংগ্রেসের দুই চাকার সাইকেলের কাছে হেরে গিয়েছে মোদি-অমিত-যোগীর ত্রিশূলধারী রথ। ভারতীয় একটি গণমাধ্যমের ভাষায় বললে, ‘ঘরের ছেলে’ (আপকা লাড়কে) হারিয়ে দিয়েছে ‘মোদি-যোগী’ ডাবল ইঞ্জিনকে। প্রদেশটিতে কংগ্রেস ও সমাজবাদী দল মুসলিম, দলিত এবং নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠীর ভোট সংহত করতে পেরেছে। অন্যদিকে দলিতরাও পেয়ে গেছে নতুন নেতা চন্দ্রশেখর আজাদকে। শুধু উত্তরপ্রদেশ নয়; হিন্দিবলয় বলে পরিচিত রাজ্যগুলোতে, ৩০০ আসনধারী মূল যে পাঁচটি রাজ্য ছিল বিজেপির দুর্গ, সেখানেও সম্মান টেকে কিনা সন্দেহ। এভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপির আসন ১৯ থেকে ১৫-তে নেমেছে। নির্বাচনের আসল থ্রিলার ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে। গেরুয়া জোয়ারের আশঙ্কাকে ঘুরিয়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিত করেছেন তৃণমূলের সবুজের শক্তি। প্রতিবেশী বাংলাদেশের জন্য এটা একটা স্বস্তির খবর বটে।
রামমন্দিরের বাজি বুমেরাং হয়েছে?
বিজেপি এবং মোদি-শাহ জুটির বড় বাজি ছিল ধ্বংস করা বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ। বাজি ছিল সাম্প্রদায়িক নাগরিকত্ব আইন। বাজি ছিল উন্নয়নের রূপকথা। কিন্তু দেখা গেল খোদ অযোধ্যার রামমন্দির আসনেই (ফৈজাবাদ) হেরেছেন বিজেপি প্রার্থী। ঐতিহাসিকভাবে অযোধ্যা নগরী ছিল হিন্দু-মুসলিমের সম্প্রীতির শহর। মুসলমান মালির বাগানে ফোটানো গোলাপ সেখানে নিবেদিত হতো দেবতা রামের সিংহাসনের নিচে, যে সিংহাসনটা আবার বানানো হতো মুসলিম দারুশিল্পীদের হাতে। সেই অযোধ্যা জবাব দিয়ে দিয়েছে। যে উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ২০১৯ সালের নির্বাচনে একচেটিয়া বিজয় পেয়েছিল, এবার সেখানেও তাদের অর্ধেক আসন পেতেই হয়রান হতে হচ্ছে।
দুই কারাবন্দির বিজয়ের চমক
চমকে দিয়েছেন কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের দুই প্রার্থী। দু’জনকেই ভারতের শাসকমহল ‘বিদ্রোহী’ বলে দাগিয়ে দিয়েছে। একজন হলেন কাশ্মীরের সাবেক এমপি শেখ আবদুল রশিদ। সন্ত্রাসবাদী অভিযোগ মাথায় নিয়ে তিনি পাঁচ বছর ধরে জেলবাসী। গণমানুষের কাছে ইঞ্জিনিয়ার নামে পরিচিত রশিদ ২০১৯ সাল থেকে সন্ত্রাসী অর্থায়নের মামলায় তিহারের কারাগারে রয়েছেন। এবারে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে শুধু নির্বাচনই নামেননি, বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ীও হয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে এক লাখ ভোটে পেছনে ফেলে নিজের জয় নিশ্চিত করেছেন তিনি। অন্যদিকে পাঞ্জাবের স্বাধীনতাকামী খালিস্তান আন্দোলনের নেতা অমৃতপাল সিং ভোট গণনায় এগিয়ে আছেন (এই লেখার সময় পর্যন্ত)।
মোদি ম্যাজিক ফুরাবার কারণ কী
স্পষ্টতই ভারতের ভোটারদের বড় একটা অংশ বিক্ষুব্ধ। বিজেপি ‘হিন্দু জাতি’ বানাতে চায়, কিন্তু মানুষ দেখছে যে চাকরি নাই, মূল্যস্ফীতি বেশি। মানুষ দেখেছে কভিডকালীন অসহায়ত্ব। গরিব মানুষ শোধ নিয়েছে উত্তরপ্রদেশে। সেনাবাহিনীর ‘অগ্নিবীর স্কিম’ হিন্দিবলয়কে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে। ভারতের সেনাবাহিনীর মূল অংশটাই আসত হিন্দিবলয় থেকে। এ স্কিমের কারণে তারা বঞ্চিত বোধ করেছে। মোদি হাওয়া ক্ষুধার্ত ভারতের মন মজাতে চাইলেও পাকস্থলী ভরাতে পারেনি। তারা মনে রেখেছে ডিমনিটাইজেশনের ধাক্কা, আয় কমে যাওয়ার কষ্ট। যতই দেবদেবীর কথা বলা হোক না কেন, জনতা দেখেছে আদানি-আম্বানি-জিন্দালদের শান-শওকতের বিস্ময়কর বৃদ্ধি। সম্ভবত ভারতজুড়ে মুসলিম-খ্রিষ্টান-দলিত ও নিম্নবর্ণের ভোটও বিজেপির বিরুদ্ধে চলে গেছে। মোদি ম্যাজিক কাজ করেনি, কাজ করেছে বাস্তববোধ। সেই বাস্তববোধের কাছে নৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয় ঘটেছে ভারতের পরাক্রমশালী প্রধানমন্ত্রীর। নিজেকে যে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রে তিনি দেখাতে অভ্যস্ত ছিলেন, সেটা এখন সত্যিকার চেহারায় দেখা দিয়েছে।
মোদি জিতলেও, গদি মিডিয়া ধরাশায়ী
একদলীয়, একধর্মীয় উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং আগ্রাসী পুঁজিবাদী শক্তির কাছে ভারতের সমর্পণ ঠেকাবার শেষ লড়াই ছিল এই সংসদীয় নির্বাচন। ভারতের জনগণ সেই অগ্নিপরীক্ষায় পুরোপুরি উত্তীর্ণ না হলেও বিপর্যয় ঠেকিয়ে দিয়েছে। যে মন্ত্রে অতীতে বৈতরণী পার হওয়া গিয়েছিল, সেই মন্ত্র যে সবখানেই একই রকম কাজে দেবে– ইতিহাস তা বলে না। ইতিহাস কখনোই ভারতীয় সমাজের বহুত্ববাদী চরিত্রের সাম্প্রদায়িক গড়ন সমর্থন করে না। মনে রাখা দরকার, পেন্ডুলাম একদিকে যত বেশি ঝুঁকে যাবে, দোলার নিয়মে বিপরীত দিকে ঝুঁকবার সম্ভাবনা ততই বাড়বে। সেই দোল-বদল এবং দল-বদলের লক্ষণ ফুটে উঠেছে এবারের ভোটের ব্যাকরণে।
পাশাপাশি এটাও সত্য যে, তরুণেরা আর বাহারি বুলিতে ভুলতে রাজি ছিল না। ধ্রুব রাঠি নামে যে তরুণ কোটি কোটি ভারতবাসীকে মোদিবিরোধী প্রচারণায় মাতিয়ে দিয়েছেন, তিনি তো একা নন; তাঁর মতো আরও ছোট ছোট ধ্রুব রাঠি ইউটিউবার গণতন্ত্রের জন্য লড়েছেন। সে জন্যই বলা হচ্ছে, এই নির্বাচন ইউটিউবার বনাম গদি মিডিয়ার নির্বাচন।
অথচ সরকারি মদদপুষ্ট ভারতের গদি মিডিয়া বুথফেরত জরিপের দোহাই দিয়ে গদিনশিনদের বিপুল বিজয়ের আভাস দিয়েছিল। দিন শেষে দেখা যাচ্ছে, মোদি জিতলেও গদি মিডিয়ার মুখ দেখাবার উপায় নাই। তাদের কোনো দাবিই ভোটে টেকেনি। এবার যে শুধু মোদি ম্যাজিকই ফেল মেরেছে তাই না, বিজেপির মোদি-কেন্দ্রিক নির্বাচনী কৌশলটাই বুমেরাং হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। এই ঘটনা নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য একটা ধাক্কা। কারণ, ইতোমধ্যে বিজেপির সঙ্গে তাদের আদর্শিক কেন্দ্র আরএসএসের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আরএসএস নির্বাচনী ফলের সুবাদে মোদির নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাই অবাক হবার কিছু থাকবে না।
গণতন্ত্রের কাছে পর্বতও নত হয়
২০২৪-এর নির্বাচনের বিশেষ দিক তাহলে এটাই যে, বিজেপির জোট এনডিএ কমজোরি হলেও শক্তি ফিরে পেল ভারতের বহুদলীয় গণতন্ত্র। বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের পিছু হঠার এই কালে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে দল নয়, বরং জিতল গণতন্ত্র। শাসক ও শাসিতের মধ্যে ক্ষমতার যে ভারসাম্য ছাড়া গণতন্ত্র অকেজো, সেই ভারসাম্য ফিরে আসার সুযোগ পেল। জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে দেশকে একচেটিয়াতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাওয়ার খেলাও হোঁচট খেল।
ভারতের এই নির্বাচন প্রমাণ করেছে, যতই অজেয় ও চতুর হোক না কেন কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা, দল-মত ভুলে একসঙ্গে দাঁড়ালে পর্বতও ঢিবিতে পরিণত হতে পারে। আর রাহুল গান্ধীর মতো তরুণ নেতাও দাঁড়িয়ে যেতে পারেন অতিকায় গোলিয়াথের বিপরীতে তরুণতর ডেভিডের ভূমিকায়।
samakal