নিজস্ব প্রতিনিধি
সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক গুলি করে বাংলাদেশীদের খুন এবং ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। এমনকি সীমান্তে চোরা চালানীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সময় র্যাবের দুই সদস্যকেও বিএসএফ কর্র্তৃক ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ১০ নভেম্বর ২ র্যাব সদস্যের পর গত সোমবারও এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ । গত শনিবার (২১শে নভেম্বর) কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার খাটিয়ামারী সীমান্তে হাসিনুর রহমান ওরফে ফকিরজান (৩০) নামে এক তরুণকে গুলি করে হত্যা করেছে ভারতের এই খুনি বাহিনী। নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর ২৩শে নভেম্বর ভোররাতে কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার দক্ষিণ বাঁশজানী সীমান্তে বাংলাদেশের ভেতর থেকে জহুরুল ইসলাম নামে অপর এক তরুণকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ সদস্যরা।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ২২ ব্যাটালিয়নের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ জামাল হোসেন বাংলাদেশী তরুণকে ধরে নিয়ে যাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেন।
এর আগে ১০ই নভেম্বর র্যাবের দুই সদস্যকে প্রথমে মারধর এবং পরে জামাকাপড় ছিঁড়ে টেনে ভারতে নিয়ে যায় বিএসএফ। দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার বি-আমতলী স্বরসতীপুর সীমান্ত থেকে দুপুর ২টার দিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী (বিএসএফ) র্যাব-১৩ দিনাজপুর সিপিসি-১ এর সহ-অধিনায়ক (এএসপি) শ্যামল চং ও কনস্টেবল আবু বকর সিদ্দিককে পাকড়াও করে।
র্যাবের একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশে বিএসএফ এর সহায়তায় মাদক পাচারের বিরুদ্ধে অভিযানে গিয়ে এমন পরিস্থিতির শিকার হন তারা। ৫ সদস্যের এই দলটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে অভিযান পরিচালানা করছিলেন।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়নে ‘পাখিউড়া’ সীমান্তে গত ৩ সেপ্টেম্বর পাখির মতোই গুলি করে ছবিল উদ্দিন নামের এক বাংলাদেশী তরুণকে হত্যা করে বিএসএফ।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ এর হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনে সব সময় আতঙ্কে থাকেন সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষেরা। কিন্তু, এসবে মোটেই বিচলিত নয় বাংলাদেশ সরকার এবং বিজিবি। অথচ ২০১৭ সালের মার্চ মাসে গোবিন্দ নামের নেপালী এক যুবককে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা হত্যা করলে পুরো নেপাল জুড়ে বিক্ষোভ হয়েছিল। গোবিন্দকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ কৃত্য অনুষ্ঠান করেছিল নেপালীরা। অব্যাহত বিক্ষোভের কারণে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রকাশ্যে দু:খ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর বাংলাদেশী নাগরিকদের প্রতিনিয়ত হত্যা ও ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায়ও বিরোধী দলের রাজনীতিকরা নির্বিকার। অপর দিকে সরকার ভারতের প্রতি সর্বদাই নতজানু।
সীমান্তের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলামকে প্রতিবাদের পরিবর্তে বিভিন্ন সময় নজতানু ভূমিকায় দেখা গেছে। বাংলাদেশীদের হত্যার প্রতিবাদ বা দেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে অবস্থান নেয়া তো দূরের কথা ভারতের পক্ষেই সাফাই গাইতে শোনা গেছে তাঁকে।
“সন্ত্রাসীরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। সে কারণে বিএসএফ-এর গুলিতে বাংলাদেশী হত্যার ঘটনা ঘটছে”- এরকম বক্তব্য দিয়ে বিএসএফের খুনের বৈধতা দেয়ার চেষ্টাই বরং করেছেন এই বিজিবি প্রধান।
এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবুল মোমেন তো আরেক ধাপ এগিয়ে ভারতের কাছে নিজের সম্মানও বিকিয়ে দিতে কার্পণ্য করেন নি।
চলতি বছরের জুলাই মাসে এক বিবৃতিতে সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ঘটনাগুলোকে শুধু নতজানু সুরে ‘দুঃখজনক’ বলেই দায় সেরেছেন তিনি।
এই সেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি মোদী-হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বলেও অভিহিত করেছিলেন। আর সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তো দুই দেশের সম্পর্ককে রক্তের রাখিবন্ধন বলে মন্তব্য করে হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব নিজের করে নিয়েছেন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসেবে মতে, গত ২ বছরে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যার ঘটনা ৩ গুণ বেড়েছে। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর আর কোনো সীমান্তে প্রতিবেশী দ্বারা এত মানুষ হত্যার ঘটনার নজির নেই। এমনকি চির বৈরী ইসরাইল-ফিলিস্তিন সীমান্তেও এত মানুষ খুন হয় না প্রতিবছরে।
২০১০ সালে ফেলানী নামক এক কিশোরীকে গুলি করে হত্যার পর লাশ সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এনিয়ে তখন জনগণ ফুঁসে উঠলেও তৎকালীন শেখ হাসিনার নবগঠিত সরকার জনমতের তোয়াক্কা করেনি। এমনকি ফেলানীর পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা করতে যাওয়া একটি সংগঠনকে সরকার তাড়িয়ে দেয় কুড়িগ্রাম থেকে। পরবর্তীতে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সে অর্থ ফেলানীর দরিদ্র পিতার হাতে তুলে দেয়া হয়। আমার দেশ পত্রিকাও সেদিন প্রেসক্লাবে অপর একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফেলানীর পিতাকে সহায়তা প্রদান করে।
আওয়ামী সমর্থক মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের পুরো সময়টায় ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ’র হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৪৩ জন বাংলাদেশী। যাদের মধ্যে ৩৭ জন নিহত হন গুলিতে, আর বাকি ৬ জনকে নির্যাতন করে মারা হয়।
২০২০ সালের প্রথম ছয়মাসেই সীমান্তে বিএসএফ ২৫ জন নিরস্ত্র বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। চলতি বছরে সবচেয়ে বেশি সীমান্ত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোয়। গত বছরের প্রথম ছয়মাসের তুলনায় সীমান্তে চলতি বছরে বিএসএসফ বেশি বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে।
এদিকে সরকারি হিসাবেই শেখ হাসিনা সরকারের দশ বছরে সীমান্তে ২৯৪ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগের পরম ইন্ডিয়া। ২০১৯ সালের ১১ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে এ তথ্য জানিয়েছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত ১০ বছরে ভারতীয় বিএসএফ সীমান্তে ২৯৪ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে।
মন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সালে ৬৬ জন, ২০১০ সালে ৫৫ জন, ২০১১ সালে ২৪ জন, ২০১২ সালে ২৪ জন, ২০১৩ সালে ১৮ জন, ২০১৪ সালে ২৪ জন, ২০১৫ সালে ৩৮ জন, ২০১৬ সালে ২৫ জন, ২০১৭ সালে ১৭ জন এবং ২০১৮ সালে ৩ জনের মৃত্যুর হিসাব দেওয়া হয় সংসদে।
তবে মানবাধিকার সংগঠন গুলোর হিসাব মতে এই সংখ্যা আরো বেশি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবেই দেখা যায় ২০১৮ সালে ১৪ জন বাংলাদেশীকে বিএসএফ হত্যা করেছে। যদিও সরকারি হিসাবে বলা হয়েছে ৩ জন মাত্র।
সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিএসএফের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় তা ‘শূন্যে নামিয়ে আনা’র প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও হত্যাকাণ্ড বেড়েই চলেছে।
সম্প্রতি রাজধানীর পিলখানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদর দপ্তরে বিজিবি ও বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন শেষে বিএসএফ এর মহাপরিচালক রাকেশ আস্থানা সাংবাদিকদের কাছে বলেন
যে, সীমান্তে পরিস্থিতি চরমে পৌঁছলে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে তাদের।
অপরদিকে বিজিবি কর্তৃক সরাসরি গুলি করার অনুমোদন নেই বলে জানা গেছে। বিজিবি অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বা আক্রান্ত হলেও ওপরের অনুমতি ছাড়া গুলি ছুড়তে মানা। গুলি ছুড়তে হলে ওপর মহলের অনুমতি নিতে হয় বিজিবিকে। ফলে বিএসএফ-এর আগ্রাসন প্রতিরোধের পরিবর্তে বিজিবিকে তাদের সহযোগিরূপে দেখা যাচ্ছে।