সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বেড়েছে। তবে দল দুটির মধ্যে সম্পর্ক যে খুব ঘনিষ্ঠ হয়েছে, তা মনে করছেন না নেতারা। গত সপ্তাহে বিএনপি ও জামায়াত—দুই দলের নেতারা একে অপরের ইফতারে অংশ নেন, যা গত বছর পর্যন্ত হয়নি। এরপর দল দুটির সম্পর্ক নতুন করে আলোচনায় আসে। ২০০১ সালে জামায়াতে ইসলামীসহ চারদলীয় জোট গঠন করে ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি। তবে দীর্ঘদিন থেকে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে স্বাধীনতাযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দল জামায়াতকে এড়িয়ে চলছিল বিএনপি।
বিএনপির এমন অবস্থানের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রতিবেশী দেশ ভারতকে ‘আস্থায়’ আনার একটা লক্ষ্য ছিল। এ লক্ষ্যে নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতকে এড়াতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ভেঙে দেওয়া হয়। এই জোটের অন্যতম শরিক দল ছিল জামায়াত। পরে ভেঙে দেওয়া ২০ দলের অন্য শরিকেরা জামায়াতকে বাদ দিয়ে নতুন জোট করে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হয়। এ দলগুলোর সঙ্গে বিএনপি সময়–সময় দ্বিপক্ষীয় সভা-মতবিনিময় করে সম্পর্ক রক্ষা করে চললেও জামায়াতকে এড়িয়ে চলছিল।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এরপরও জামায়াত শুরুর দিকে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের কয়েকটি কর্মসূচি পৃথকভাবে পালন করে। কিন্তু বিএনপির এড়িয়ে চলার মনোভাব টের পেয়ে একপর্যায়ে জামায়াত নিজস্ব কর্মসূচি শুরু করে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে প্রতিবেশী দেশের সমর্থন না পাওয়ায় বিএনপির নেতৃত্ব যুগপৎ আন্দোলনের সময় আবার জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ায়। বিশেষ করে, গত বছরের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনের মহাসমাবেশ থেকে বিএনপিকে অনুসরণ করে কর্মসূচি দেয় জামায়াত। তবে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর বিএনপি ও জামায়াত—দুই দলই নীরব হয়ে যায়।
আগ্রহ দুই দলেই
এই রমজানে ইফতার অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে যোগাযোগ কিছুটা বাড়ে। গত ২৮ মার্চ বিএনপির ইফতারে জামায়াতের আমির, সেক্রেটারি জেনারেলসহ চারজনকে দাওয়াত করা হয়। এরপর ৩০ মার্চ জামায়াত তাদের ইফতারে বিএনপির মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সব সদস্য ছাড়াও দলের ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা ও যুগ্ম মহাসচিবসহ প্রায় অর্ধশত নেতাকে আমন্ত্রণ জানায়। ইফতারে দলটির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাসসহ ১৮ জন নেতা অংশ নেন। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যাননি।
পুরোনো দ্বন্দ্বের জের বিএনপি-জামায়াতে
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বলতে পারেন বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কটা বেড়েছে, খুব ঘনিষ্ঠতা হয়েছে মনে করি না। আমরা জাতীয় স্বার্থে শুধু বিএনপি নয়, যেকোনো দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা রাখতে চাই। এ ক্ষেত্রে বিএনপির পলিসি (নীতি) কী হবে, তা তো আমরা জানি না।’
বিএনপি ও জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই দলের সম্পর্কে এখনো দূরত্ব রয়ে গেছে। তবে বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে একধরনের উপলব্ধি হয়েছে যে সরকারের আগ্রাসী মনোভাব ও দমন-পীড়নের মধ্যে একটি সংগঠিত বিরোধী দল জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলাটা এখন আর সঠিক রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে না। আবার জামায়াতের দিক থেকেও বিএনপির সঙ্গে আগের মতো বোঝাপড়ার মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেই রাজনৈতিক পথচলার আগ্রহ রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং ক্ষমতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারতের ‘একমুখী’ নীতি দল দুটিকে আবার ঘনিষ্ঠ করার ক্ষেত্র তৈরি করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
অবশ্য এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মূল্যায়ন একটু ভিন্ন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে জামায়াত-বিএনপির কোনো ব্যাপার নেই। যারা জামায়াত-বিএনপি সম্পর্ক আলাদা করে দেখতে চায়, তারা এটাকে ইস্যু করতে চায়। সরকারবিরোধী ৬২-৬৩টি দল আছে, তাদের নিয়ে তো কথা নেই। শুধু জামায়াত-বিএনপি নিয়ে কথা আসে কেন। ঘরে আগুন লেগেছে। যারাই আগুন নেভাতে আসবে, আমরা তাদের স্বাগত জানাব।’
বিরোধিতাও আছে
জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়লেও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার ক্ষেত্রে বিএনপির ভেতরে-বাইরে এর বিরুদ্ধেও অবস্থান আছে। বিএনপির ইফতারে জামায়াতকে দাওয়াত করায় যুগপৎ আন্দোলনের অন্যতম শরিক জোট গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম যাননি। আবার জামায়াতের ইফতারে বিএনপির মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সব সদস্যকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও অনেকে নানা কারণ দেখিয়ে এড়িয়ে গেছেন বলে মনে করছেন জামায়াতের নেতারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একজন নেতার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সময় এবং প্রেক্ষাপট বিএনপি ও জামায়াতকে আলাদা করেছে। আবার সময়ই বলে দেবে ভবিষ্যতে রাজনীতির মাঠে দুই দলের সম্পর্ক কেমন হবে। তবে তিনি মনে করেন, যোগাযোগ যতই বৃদ্ধি পাক, ঘনিষ্ঠতা খুব গভীর হবে না। কারণ, দুটি দলই সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশ হিসাবি এবং কৌশলী।
prothom alo