ঢাকা
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন এবং রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কোম্পানির চুক্তি বাতিল করবে তারা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সার্বিক অবস্থা নিয়ে আজ শনিবার দুপুরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমাদের আশার বাণী হচ্ছে, আমরা বিদ্যুতের এই সমস্যার সমাধান করব। আমরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল করব। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কোম্পানির সঙ্গে সব চুক্তি বাতিল করা হবে। স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও অন্যান্য কাজ সম্পাদন করা হবে।’
বিএনপির ভিশন-২০৩০–এ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নের কর্মসূচি তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব। তাতে চাহিদা অনুযায়ী পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা, উৎপাদন ও চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দ্রুত প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে। জ্বালানির উৎস সন্ধানে বাপেক্স ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার মাধ্যমে দেশীয় খনিজ ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ, বঙ্গোপসাগরে সম্ভাবনাময় গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ উত্তোলনে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা কমিয়ে ক্রমান্বয়ে মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তিনির্ভর জ্বালানি নীতি গ্রহণ, বেস লোড পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন গড়ে তোলার বলা হয়। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।
কুইক রেন্টালের নামে কুইক লুটপাট
মির্জা ফখরুল বলেন, বিদ্যুতের চাহিদা সঠিকভাবে নির্ধারণ না করে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়ার প্ল্যান্টের সঙ্গে চুক্তি করে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীদের অর্থ লুট করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনি বলেন, সামিট গ্রুপ, এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল, এরদা পাওয়ার হোল্ডিং, ইউনাইটেড গ্রুপ, কেপিসিএল, বাংলা ক্যাট, ওরিয়ন গ্রুপ, হোসাফ গ্রুপ, মোহাম্মদী গ্রুপ, ম্যাক্স গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ ও এপিআর এনার্জি—এই কোম্পানিগুলো কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের মাধ্যমে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির মহাসচিব বলেন, এ ছিল কুইক রেন্টালের নামে কুইক লুটপাট।
১৯টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট চালুর দুই-তিন বছর পরই বন্ধ হওয়ার কথা ছিল বলে জানান মির্জা ফখরুল ইসলাম। কিন্তু সেগুলো প্রয়োজন ছাড়াই এখনো চালু আছে। বেশ কিছু রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি ট্যাক্স বাবদ বিপুল অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। সরকারকে এ পর্যন্ত ৯০ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব ব্যবসায়ীদের পকেটেই গেছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত ১২ বছরে ক্যাপাসিটি ট্যাক্স বাবদ গেছে প্রায় ৮ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। গত তিন বছরেই গেছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জকে তিনি অযৌক্তিক, অনৈতিক, জনস্বার্থবিরোধী এবং অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেন।
বর্তমানে দেশে মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাত্র ৪৩ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। অবশিষ্ট ৫৭ শতাংশকে অলস বসিয়ে রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া দেওয়া হচ্ছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্যাসভিত্তিক। গ্যাস–সংকটের কারণে এখনই প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আগামী চার বছরে আরও ১৩ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে অলস বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়বে। সব মিলে বিদ্যুৎ না কিনেও অতিরিক্ত টাকা পরিশোধের অঙ্ক অনেক গুণ বেড়ে যাবে। আর বসিয়ে বসিয়ে তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করে যাচ্ছে। এ অর্থ জনগণের অর্থ। এই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে গিয়ে বিদ্যুৎ খাত দেউলিয়া হচ্ছে।
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি অযৌক্তিক
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ভারত থেকে বর্তমানে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এ জন্য গত তিন অর্থবছরে প্রায় ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। আদানি গ্রুপ থেকে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির কথা রয়েছে। বাংলাদেশে যখন প্রায় ৬০ শতাংশ ওভার ক্যাপাসিটি রয়েছে, ঠিক সে সময় ভারত থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আমদানি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের আদানি গোড্ডা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১১ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে। এই বিদ্যুৎ আমদানির ৪০ শতাংশ যায় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে। বিদ্যুৎ কম এলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। চুক্তির ২৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে আদানি গ্রুপকে এক লাখ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করতে হবে, যা তিনটি পদ্মা সেতু বা নয়টি কর্ণফুলী টানেল কিংবা দুটি মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য যথেষ্ট।
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘আদানির এই কোম্পানিকে প্রায় ৩ বছরে মোট ভাড়া দেওয়া হয়েছে ৫৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। আর পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতিসহ খরচ পড়েছে ৩০ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এ কেন্দ্রটি থেকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হচ্ছে না, হবে না। তাই এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বিরাট বোঝা হয়ে আছে, যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রশ্ন
মির্জা ফখরুল বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০২০ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে গেলেও সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ শেষ না হওয়ায় কেন্দ্রটি সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। কিন্তু কোনো বিদ্যুৎ না দিলেও এ পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে চীনের ঋণে বাস্তবায়নাধীন পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, সঞ্চালন লাইনের কাজটি সম্পন্ন করা হলো না কেন? বিদ্যুৎ না কিনেও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা কেন পরিশোধ করা হলো? অনেকেই মনে করেন, এখানে ইচ্ছাকৃতভাবে অর্থ লুটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
ব্যর্থতার জন্য সরকারের পদত্যাগের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎ খাতের এই বিপর্যয়, রিজার্ভের সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক নৈরাজ্য ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাসের দায় নিয়ে বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকারকে অনতিবিলম্বে পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি। তা না হলে দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণই এ সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করবে।’
বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটারে প্রযুক্তি দিয়ে মানুষের অর্থ লুট করছে বলে অভিযোগ করেন সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ।