বিএনপি কেন যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝতে ভুল করেছে

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন আপাত দৃষ্টিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের ওপর গত বছর ২৪ মে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেন। এ নীতির লক্ষ্য ছিল যারা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা দেবে, তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া। এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর র‍্যাবের সাতজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর জানায়, গণতন্ত্র ও নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া দেশটি শুরু করেছে।

নির্বাচনী কার্যক্রম সামনে রেখে ২০২৩ সালে বছরজুড়েই সরকারি উচ্চপদস্থ বিভিন্ন মার্কিন প্রতিনিধি দলকে বাংলাদেশ সফর করতে দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এসব পদক্ষেপ বিএনপিসহ যারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিল, তাদের প্রচণ্ড আশাবাদী করে তোলে। তারা ধরেই নিয়েছিল– যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ ক্রমান্বয়ে কঠিন পদক্ষেপ নেবে এবং সরকার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত তা চালিয়ে যাবে। সিভিল সোসাইটির কিছু ব্যক্তিও বিশ্বাস করেন, সারাবিশ্বে গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। তারাও ধরে নিয়েছিলেন– উদার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় থাকবে।

বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থকদের মধ্যে যারা যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে লিখেছেন, তাদের বিষয়টাকে নির্মোহভাবে না দেখে, দলীয় সমর্থকরা যেটা শুনতে পছন্দ করবে, সেভাবে কথা বলে তাদের উজ্জীবিত রাখতে এবং জনপ্রিয় থাকতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির জাতীয়, আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক– এ তিন মাত্রাকে সার্বিকভাবে বিশ্লেষণের চেয়ে খণ্ডিতভাবে বোঝার দিকে ঝোঁক ছিল প্রবল।

এই বুঝতে না পারা বা না চাওয়া থেকেই মার্কিন ভূমিকা নিয়ে অতিরিক্ত আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। যদিও তারা কেউই পরিষ্কার ছিলেন না– যুক্তরাষ্ট্রের  নিষেধাজ্ঞা কীভাবে সরকারকে পরিবর্তন করবে। কঠোর স্যাংশন দিয়ে যেখানে ইরান, সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া, কিউবা, ভেনেজুয়েলাসহ দুনিয়ার কোনো দেশেই সরকার পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি; সেখানে বাংলাদেশে কীভাবে তা সম্ভব হবে।

বিএনপির মাঠ পর্যায়ের অনেকে ভেবেছিলেন, কঠিন স্যাংশন আরোপ করলে দেশ খুব খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থায় পতিত হবে। এর ফলে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর পক্ষে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সরকার পতন। বাস্তবে অন্য কোনো দেশে স্যাংশন-জাত অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল গণআন্দোলন এবং সরকার পতনের নজির নেই। বরং দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকার এ অবস্থায় তাদের ব্যর্থতার দায়ভার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দিয়ে জনমতকে পশ্চিমাবিরোধী করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র সেসব দেশের  সরকারকেই পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে, যেসব দেশে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া এর উদাহরণ। প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়রের সময় থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের দীর্ঘ ধারা থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারিভাবে বেরিয়ে আসে। সম্প্রতি বার্মা অ্যাক্টের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এ নীতিও গ্রহণ করেছে– কোনো দেশের সামরিক সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র আর কখনও সমর্থন করবে না। এ নীতি গ্রহণ করার পর এর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারবদ্ধতাও প্রতীয়মান।

পাকিস্তানের ইমরান খান সরকারের পতন এবং এর সঙ্গে ডোনাল্ড লুর ভূমিকা নিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী শিবিরে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা বোঝার চেষ্টা না করে, এর পেছনে মার্কিন ভূমিকাই মুখ্য ভাবার ভুল করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, ইমরান খানকে পছন্দ না করলেও তাঁর পতনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই– এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বারংবার পরিষ্কার করা হলেও সরকারবিরোধী নানা বিশ্লেষক তা উপেক্ষা করেছেন।

এ ছাড়া পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনবাহিনীর ভূমিকার ভিন্নতার বিষয়ও তারা বুঝে উঠতে পারেননি। ফলে অনেককে অলীক আশাবাদে পেয়ে বসেছিল। সরকার পরিবর্তন নিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলের অনেকেই ইরান, উত্তর কোরিয়া, কিউবা, ভেনেজুয়েলা, সিরিয়ার ক্ষমতাসীনদের মতো আওয়ামী লীগকে মার্কিনবিরোধী দল ভাবতে শুরু করেছিলেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞাসহ নানা পদক্ষেপ নেবে– এমন চিন্তায় অনেকে আছন্ন ছিলেন। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী গার্মেন্ট সেক্টরে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যে ৮-৯ বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্ট সামগ্রী যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর রপ্তানি হয়, সেটা বন্ধ হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রকে অধিক মূল্যে তা গণচীন থেকেই আমদানি করতে হবে। মার্কিন নীতির মূল উদ্দেশ্যই যেখানে বিশ্বব্যাপী গণচীনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রভাব খর্ব করা; সেখানে তারা কেন বাংলাদেশে এমন পদক্ষেপ নেবে, যা তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করবে?

ওপরে উল্লিখিত দেশসহ আরও কিছু দেশের মার্কিন বিরোধিতা হচ্ছে পররাষ্ট্র এবং জাতীয় রাজনীতির মূল ভিত্তি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের বিদেশনীতিতে ভারতের পরেই মূল অগ্রাধিকার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান আমল থেকেই আওয়ামী লীগ ‘মার্কিনপন্থি’ দল হিসেবে পরিচিত। যেসব কারণে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যান, তার মূল কারণ ছিল দলটির আমেরিকার দিকে বেশি ঝুঁকে যাওয়া। স্বাধীনতার পর সামান্য কিছু সময়ের জন্য তৎকালীন নানা বাস্তবতায় দলটি সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকলেও, পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে দলটি আবার ‘মার্কিন ব্লকে’ ফিরে আসে। বাস্তব চর্চার ক্ষেত্রে যা-ই হোক; তাত্ত্বিক জায়গা থেকে মার্কিন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতাদর্শ– গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম, মুক্তবাজার অর্থনীতি– এসবের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো বিরোধ নেই। যেসব রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতাদর্শিক মিল রয়েছে, সেসব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নজির দেশটির নেই।

আওয়ামী লীগ থেকে বারবার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে– তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্র এমন কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নেয়নি, যারা তার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায়। শুধু মার্কিনবিরোধী রাষ্ট্রগুলোই যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মুখ পড়েছে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে– নির্বাচনের আগে ভিসা নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত হাল্কা স্যাংশন আরোপের কথা কেন বলা হয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ধারা অনুসরণ করলে দেখা যাবে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি কথা চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে বলা হয়। কোনো বিশেষ রাষ্ট্র ঘিরে জাতীয় ‘ভূরাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক’ স্বার্থ হাসিলের কৌশল হিসেবে। কোনো রাষ্ট্র সে স্বার্থ পূরণে সম্মত হলে এ ধরনের চাপ কমে আসে।

বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থবিষয়ক নানা ধরনের আনুমানিক সিদ্ধান্ত রয়েছে। এগুলো হলো– বাংলাদেশের গণচীনের দিকে বেশি হেলে না পড়া; মার্কিন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি নেওয়া; বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে সুযোগ দেওয়া ইত্যাদি। এসব বিষয় ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো সমঝোতা হয়েছে কিনা বা ওবায়দুল কাদের যেটা বলেছিলেন, ‘তলে তলে আপস হয়ে গেছে’– বিষয়টা এ রকম কিনা বোঝা না গেলেও এটা অনুমেয়, কিছু বিষয় নিয়ে নির্বাচন-পূর্ব সমঝোতা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা ওবায়দুল কাদেরের কথাকে মাঠের বক্তৃতা ধরে নিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারা বুঝতে চাচ্ছিলেন না– মার্কিন পক্ষ থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অংশগ্রহণমূলকের মাঝে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টা রয়েছে– এটাও অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন। অন্তর্ভুক্তির বিষয়টা না বলে প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে কাজ করার পথ যে খোলা রাখা রয়েছে– সেটা অনেকেই তখন বুঝতে পারেননি। তবে তাদের সবার চিন্তার জায়গা ছিল ভারতের ভূমিকা নিয়ে।

বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা বুঝতে গিয়ে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বিপরীত এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক হচ্ছে দ্বান্দ্বিক– এভাবে বোঝা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক সে অর্থে দ্বান্দ্বিক কখনোই ছিল না; এমনকি শীতল যুদ্ধের সময়েও নয়, যেভাবে রাশিয়া, চীন, ইরান, কিউবা, উত্তর কোরিয়া এসব দেশের সঙ্গে রয়েছে। এসব রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতাদর্শগত পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র একই অর্থনৈতিক নীতি ও মতাদর্শ ধারণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। শীতল যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ব্লকে থাকার সময় ভারতের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতভিন্নতা হলেও ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র শত্রুজ্ঞান করেনি, যেভাবে নিক্সনের চীন সফর-পূর্ববর্তী মাও সে তুংয়ের গণচীনকে করেছে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্টসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পদে অনেক ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনি রয়েছেন। তারা দেশটির অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, কারিগরি, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তারা একে অন্যের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদারও। বর্তমান সময়ে দেশ দুটির মাঝে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে সামরিক এবং নানাবিধ বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক যোগাযোগ। ফলে শুধু গণচীনের বিরোধিতার জায়গা থেকে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক– বিষয়টি এমন নয়। বরং যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের গভীর যোগাযোগ যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী নীতি এগিয়ে নিতে সহায়ক হচ্ছে।

চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্বকে বোঝার ক্ষেত্রেও অনেকটা পাকিস্তান-ভারত দ্বন্দ্বের মতো করে বোঝা হয়েছে। গণচীন হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। দুটি রাষ্ট্রই ব্রিকস এবং সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের সদস্য। দুটি রাষ্ট্রের সঙ্গেই রাশিয়ার রয়েছে গভীর সম্পর্ক এবং ভারতের মতো করে চীনও তুলনামূলক বিচারে রাশিয়াকে নির্ভরযোগ্য মিত্র মনে করে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনেক বিষয়েই ভারত এবং চীন একই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রেও দেশ দুটির দৃষ্টিভঙ্গি এক জায়গায় এসে মিলেছে। দুটি রাষ্ট্রই মনে করেছে, বাংলাদেশে তাদের যে বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ, তা অব্যাহত থাকবে না– যদি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পরিবর্তন ঘটে। এ পরিবর্তন ইসলাম পন্থার রাজনীতির উত্থান ঘটাতে পারে বলেও দেশ দুটি উদ্বিগ্ন ছিল। তবে সবচেয়ে আগ্রহ উদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ ঘিরে ভারত-চীনের স্বার্থের সঙ্গে মার্কিন স্বার্থ মিলে যাওয়া।

বর্তমান বিশ্ব-পরিস্থিতিতে ভারত-চীনের মতো যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশে ইসলাম পন্থার রাজনীতির বিকাশ দেখতে চায় না। পাশাপাশি ভারতবিরোধী কোনো সরকারকেও যুক্তরাষ্ট্র  বাংলাদেশে দেখতে চায় না। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে চীনকে বাড়তি সুবিধা দেবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে তাদের যে অর্থনৈতিক স্বার্থ, সেটি আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই পূরণ করা সম্ভব। বস্তুত এ উপলব্ধি থেকেই নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা করলেও, বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার কথা যুক্তরাষ্ট্র কয়েকবার মনে করিয়ে দিয়েছে। এমনকি খোদ প্রেসিডেন্ট বাইডেনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়ে বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। ফলে যারা মনে করছেন, বাংলাদেশ ঘিরে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থ হয়েছে বা আমেরিকা ‘আধা-খেঁচড়া’ কাজ করেছে, তাদের ধারণা ভুল। তারা কোনো কারণ ছাড়াই কল্পনাবশত ধরে নিয়েছিলেন, সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র।

এ ধরনের বিশ্লেষণের আরেকটি ভুল ছিল, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখবে কিনা– এ ধরনের ভাবনা। অন্য দেশের চোখ দিয়ে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের নজির যুক্তরাষ্ট্রের নেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে সেটা হলো, আঞ্চলিক রাজনীতির সমীকরণে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ এক জায়গায় মিলে যাওয়া। বিশ্বের অনেক দেশে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থ হলেও বাংলাদেশে সেটি হয়নি। কারণ এমন কোনো লক্ষ্য বাংলাদেশের ব্যাপারে তারা নির্ধারণ করেনি। এ ধরনের কল্পনানির্ভর বিশ্লেষণ বিএনপি নেতাকর্মীর মাঝে অতিমাত্রায় মার্কিন-নির্ভরতার জন্ম দিয়েছিল।

এ ছাড়া মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো নারী সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানকে ক্ষমতাচ্যুত করা অথবা কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার নজির নেই। বিশেষত মুসলিম বিশ্বের নারী শাসকদের নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের রোল মডেল হিসেবে উপাস্থাপন করতে চায় মার্কিন প্রশাসন। এ বিষয়টাও অনেকের নজর এড়িয়ে গেছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারির ক্ষেত্রে একক বৈশ্বিক মানদণ্ড না থাকলেও কোনো রাষ্ট্রের ওপর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময় তাকে অন্য রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপট মাথায় রাখতে হয়। ফলে বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে মিসর এবং পাকিস্তানের ওপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয় সামনে চলে আসবে।

মার্কিন রাজনীতি এবং সংস্কৃতির অনেক কিছুই বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের জন্য অস্বস্তিকর। ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ফিলিস্তিনে অনুসৃত মার্কিন নীতিকে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হিসেবে দেখতে তারা রাজি নয়। তাদের এ মনস্ত্বাত্ত্বিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তোলে গাজায় চলমান সংকট নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বের বিবৃতি দেওয়া থেকে বিরত থাকা– যদি সেটা মার্কিন অবস্থানের বিপক্ষে চলে যায়– এ শঙ্কায়।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণ বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মী বুঝতে না পারার ফলে এতদিন ধরে চলে আসা ভারত-বিরোধিতার সঙ্গে তারা চীন-বিরোধিতাও শুরু করেছে; যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, চীনের সঙ্গে সুসম্পর্কের যাত্রা শুরু হয়েছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় থেকে।

দক্ষিণ এশিয়ার সেসব রাষ্ট্রেই ভারতবিরোধী সরকার ক্ষমতাসীন হতে পেরেছে, যাদের পেছনে গণচীনের সমর্থন রয়েছে। এখন বিএনপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জটি হলো, বর্তমান বাস্তবতায় ভারত-চীন-মার্কিন সমীকরণে বিএনপি কোন ভূমিকা পালন করবে, সেটি সঠিকভাবে নির্ধারণ করা। আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণ বুঝতে ব্যর্থ হলে আগামী দিনগুলোতে বিএনপিকে আরও কঠিন সংকট মোকাবিলা করতে হতে পারে।

ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ: শিক্ষক, আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেম, যুক্তরাষ্ট্র

samakal