বিএনপি এখন কী করবে

গত প্রায় মাস ছয়েক ধরে আরো অনেক মানুষের মতো আমিও ভাবছি যে, শেষ পর্যন্ত বিএনপির কী হবে। আওয়ামী লীগ একটি নির্বাচন করে ফেলবে এবং সেটি কেউ ঠেকাতে পারবে না এটি বিএনপি যেমন জানত তদ্রুপ আওয়ামী লীগ করেন না এমন লোকজনও জানতেন। কেবল আওয়ামী লীগের বুদ্ধিমান লোকগুলো এবং ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্রদূতরা ভাবতেন যে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হবে না। কেউ কেউ আরো একটু এগিয়ে বলার চেষ্টা করতেন যে, যদিও বা নির্বাচন হয় সে ক্ষেত্রে সরকার বড়জোর মাসখানেক টিকবে।

নির্বাচন নিয়ে আমি বা বিএনপির লোকজন যা ভেবেছিল বাস্তবে তার চেয়েও খারাপ কিছু ঘটেছে। আমার আশঙ্কা ছিল, এবারের নির্বাচন ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো হবে না। ডামি প্রার্থী-ডামি ভোটার-ডামি ফলাফল নিয়ে আমি গত ছয় মাস ধরে যেমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলাম বাস্তবে এসে তা এতটা লেজেগোবরে হয়ে পড়বে এবং সারা দুনিয়ায় ডামির দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে তা আমার চিন্তার মধ্যে ছিল না। আমি মনে মনে উগান্ডার কথা ভাবতাম। সেখানে ১৯৮৬ সাল থেকে একজন স্বৈরশাসক বারবার ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে আজ অবধি ক্ষমতায় টিকে আছেন। প্রায় একই অবস্থা কঙ্গো এবং তানজানিয়ায় ঘটে চলেছে। আফ্রিকার যে দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদে স্বৈরশাসন চলছে সেখানে আমেরিকা-ইউরোপ শত চেষ্টা করেও স্বৈরশাসকদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি। উল্টো ওসব দেশের সরকার দ্বারা পশ্চিমারা নানাভাবে নাজেহাল ও নিগৃহীত হয়ে আসছে যুগের পর যুগ ধরে।

উল্লিখিত বিষয় নিয়ে যে চিন্তাভাবনা করছিলাম তা আমি অথবা আমার আশপাশের লোকজন টের না পেলেও সামাজিক মাধ্যমগুলোর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি ঠিকই টের পেয়ে যায়। ফলে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ঢুঁ মারতে গেলেই আফ্রিকার তামাম স্বৈরশাসকের ভিডিও এবং তাদের কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি আমার কাছে চলে আসে। ওগুলো দেখতে দেখতে আমি যেমন স্বৈরশাসক বিশেষজ্ঞ হয়ে যাচ্ছি তদ্রুপ স্বৈরশাসনের কবলে পড়লে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কী অবস্থা হয় তা তথ্যপ্রমাণসহ বিলক্ষণ বুঝতে পারছি, আর সেই বোধ-বুদ্ধি থেকেই বিএনপির করণীয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনার সুযোগ পাচ্ছি।

আজকের শিরোনাম নিয়ে যখন লিখছি তখন বাংলাদেশে বেলা ২টা বেজে গেছে। ২০২৪ সালের ১৬ জানুয়ারি মঙ্গলবার বাংলাদেশে বসে বিএনপির করণীয় নিয়ে কোনো কিছু লিখা সত্যিকার অর্থেই কঠিন ও দুরূহ বিষয়। কারণ প্রাকৃতিক নিয়মে ৯৯ শতাংশ মানুষ গোলআলু বা পটোল মার্কা চিন্তা করে থাকে, ইংরেজিতে বলা হয় ভেজিটেবল থিংকিং। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যে দর্শন রয়েছে সেখানে ভেজিটেবল পিউপিল বা সবজি মার্কা লোকজন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ওরা জন্ম নেয় কেবল মরে যাওয়ার জন্য। বেঁচে থাকে খাওয়ার জন্য এবং মরে যাওয়ার পর দুনিয়া থেকে এতটা রিক্ত নিঃস্ব ও কৃপণ অবস্থায় কবরে চলে যায় যে, নিজেদের নামটি পর্যন্ত দাফন হয়ে যায়। ফলে কবর চাপা খাওয়ার পর ওই নামে যে পৃথিবীতে কোনো মানুষ ছিল তা নিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশের কোনো আগ্রহই থাকে না।

আলু-পটোল মার্কা লোকজনের বাইরে ১ শতাংশ লোক আছেন যারা নিজেদের বাইরে গিয়ে অন্যের কথা চিন্তা করেন এবং নিজেরা না খেয়ে অন্যদের খাওয়ানোর চেষ্টা করেন আর এই লোকগুলোকেই বলা হয় নেতা। সারা বাংলাদেশের ৩৫ শতাংশ মানুষ বিএনপির সমর্থক হলেও প্রকৃতপক্ষে নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মে খুবই অল্প। বিরূপ পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে মহব্বত বাড়ে, সম্প্রীতি সৃষ্টি হয় এবং প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে গিয়ে আলু-পটোল মার্কা লোকের মধ্যে নেতৃত্বের গুণ সৃষ্টি হয়ে যায় যা ক্ষেত্রবিশেষে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক পর্যন্ত হয়ে থাকে। গত সেই ২০০৭ সাল থেকে আজ অবধি বিএনপির ওপর যে জুলুম নির্যাতন চলছে তাতে করে বিএনপির আলু-পটোলের ৪৯ শতাংশ মানুষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করেছে। অন্য দিকে তাদের প্রতিপক্ষের অবস্থা সমানুপাতে বেহাল হয়ে পড়েছে। লোভ-লালসা, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, অলসতা ও মেদভুঁড়ির কবলে পড়ে অনেক নেতা আলু-পটোলে পরিণত হয়েছেন।

গত ৭ জানুয়ারিতে যে ডামি মামী-স্বামীর ত্রিমাত্রিক সার্কাস হয়ে গেল সেখানে বিএনপি নেতাকর্মীরা যেভাবে সাধারণ মানুষকে সার্কাস থেকে দূরে রাখতে পেরেছে তা রীতিমতো নজিরবিহীন। সাধারণত দীর্ঘদিন কোনো দেশে স্বৈরশাসন চললে জনগণের মধ্যে দুই ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। স্বৈরশাসন যদি খুবই স্মার্টভাবে চলে তবে জনগণের মধ্যে প্যাথলজিক্যাল বিবর্তন ঘটে যায়। অর্থাৎ জনগণের রক্ত-মাংস থেকে গণতন্ত্রের কিছু উপাদান তিরোহিত হয়ে যায় এবং তারা স্বৈরশাসক ও স্বৈরশাসনের অনুরক্ত হয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার কথা বলা যেতে পারে। ওসব দেশে পশ্চিমা ফর্মুলার গণতন্ত্র নেই বটে কিন্তু জবাবদিহিতা-সুশাসন-ন্যায়বিচার প্রভৃতি ক্ষেত্রে তারা পশ্চিমাদেরও ছাড়িয়ে গেছে। ভোগবাদী সমাজ-বন্ধনহীন পরিবার, আনন্দ-স্ফূর্তির অবাধ আয়োজন এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে যোগ্যতা অনুযায়ী আয়-রোজগার এবং খরচ করার অবাধ স্বাধীনতা থাকার কারণে নির্বাচন রাজনীতি নিয়ে মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরের বেশির ভাগ লোক মাথা ঘামায় না।

দ্বিতীয়ত, যেসব স্বৈরশাসক মোটা মাথার অধিকারী এবং কলহপ্রিয় হিংসুটে প্রকৃতির হয় সেখানে গেরিলা যুদ্ধ-সামরিক অভ্যুত্থান এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশী আক্রমণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ফিলিপাইনের মার্কোস, রুমানিয়ার চসেস্কু, ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো থেকে শুরু করে মিসরের হোসনী মোবারকের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ তারা দীর্ঘদিন শাসন করার পরও মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুর তুরস্ক কিংবা স্পেন ভেনিজুয়েলা, কিউবা, চিলির মতো দেশের জনগণের রক্ত-মাংসের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। ফলে সময়ের বিবর্তনে তাদের নির্মম পতন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।

যেসব দেশের স্বৈরশাসন জনগণের রক্ত-মাংসে পরিবর্তন আনতে পারে না সেসব দেশের প্রধান উপসর্গ হলো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সবাই হররোজ দিনরাত উঠতে বসতে মিথ্যা কথা বলে। তারা অহঙ্কারি এবং ভণ্ড। তারা দুইভাবে দুর্নীতি করে এবং ১০ হাতে দুর্নীতির অর্থ অপচয় করে। ছলচাতুরী জুলুম অত্যাচার গুম খুনের কোনো নীতিমালা থাকে না। যখন তখন যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই স্বৈরশাসকরা তাদের অত্যাচার আপন পর, দল বিদল সবার উপর সমানতালে চালাতে থাকে। ফলে তাদের চরিত্র সবার কাছে বিষধর সাপের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় একান্ত নিজস্ব লোকের মধ্যে তাদের শত্রু তৈরি হয়ে যায় এবং নির্মম পতন অনিবার্য করে তোলে।

আফ্রিকার কয়েকটি দেশের উল্লিখিত প্রকৃতির স্বৈরশাসন চলছে যেখানে গেরিলা যুদ্ধ সামরিক অভ্যুত্থান, পার্শ্ববর্তী দেশের আক্রমণ ইত্যাদির কারণে ঘনঘন স্বৈরশাসকের পতন ঘটছে এবং নতুন স্বৈরশাসকের উত্থান হচ্ছে। অন্য দিকে তানজানিয়া, জিম্বাবুয়ে, উগান্ডা প্রভৃতি দেশে স্বৈরশাসন চললেও একটি প্যান আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে এবং স্বৈরশাসক সাধারণ জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্রে পরিণত হয়েছেন। উগান্ডার মুসোভেনি, তানজানিয়ার সামিয়া সুলুহু হাসান, রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামের মতো নেতারা সকাল বিকাল ইউরোপ আমেরিকাকে টেক্কা দিয়ে নিজ দেশে সম্মান ও মর্যাদার সাথে টিকে রয়েছেন। কারণ তারা মোটা মাথার স্বৈরশাসকদের মতো আচরণ করেননি।

উল্লিখিত আলোচনার প্রেক্ষাপট এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের মানুষ তাদের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার জায়গাগুলোতে বিএনপিকে যেভাবে স্থান দিয়েছে অমনটি অতীতকালে কোনো রাজনৈতিক দলকে দেয়নি। দ্বিতীয়ত, বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বীরা শত চেষ্টা করেও জনগণের প্যাথলজিক্যাল বিবর্তন ঘটাতে পারেনি। অধিকন্তু কোটি কোটি মানুষের দীর্ঘশ্বাস বদদোয়া এবং ঘৃণার ফলে টাউট বাটপাড়ির রাজনীতি হালে পানি পাচ্ছে না। ফলে রাজনীতির অঙ্গনে স্বৈরাচার ক্রমে অবস হচ্ছে এবং গণতন্ত্রের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। যা অনাগত দিনে বিএনপির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে চলেছে।

আমরা আজকের আলোচনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে কিছু বলি। চলমান পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে বিএনপির কী করা উচিত এমন প্রশ্নের জবাবে বলব, বিএনপির উচিত বিএনপির মতো কাজ করে যাওয়া। কোনোমতেই আওয়ামী ফাঁদে পা না দেয়া, আওয়ামী লীগকে অনুসরণ না করা এবং নরম মনের অনভিজ্ঞ শুভার্থীদের পরামর্শ পরিহার করা। আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডের দিকে যত কম নজর দেয়া যায় ততই বিএনপির জন্য কল্যাণকর এমন মতবাদ দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রচার করা। দলের নীতি-আদর্শ লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকা এবং মারাত্মক কিছু না হলে- সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করা। বিএনপির সে্লাগান হওয়া উচিত দেশকে ভালোবাস- বিএনপি করো। নইলে আওয়ামী লীগ করো। অতীত ভুলভ্রান্তি খুঁজে বের করা এবং দল যখন ক্ষমতায় ছিল তখন সেসব ভুলভ্রান্তি অপরাধ দুর্নাম বদনাম মানুষকে আহত করেছিল সেসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করে জনগণকে আশ্বস্ত করা যে, অনাগত দিনে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে অতীতের ভুলগুলো সংশোধন করা হবে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বিএনপিকে অবশ্যই লোক হাসানো কর্মকাণ্ড পরিহার করতে হবে। দলীয় নেতৃত্বে শিক্ষিত সজ্জন এবং সাহসী লোকদেরকে স্থান করে দিতে হবে। মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পাওয়ার উপযুক্ত লোককে উপযুক্ত পদে মনোনয়ন না দিলে সাধারণ নেতাকর্মীদেরকে অনুপ্রাণিত করে দলের পক্ষে ধরে রাখা যাবে না। অর্থনীতি কূটনীতি এবং মাঠের রাজনীতি আলাদা করতে হবে। প্রশাসন পেশাজীবী এবং ধর্মীয় নেতাদের সাথে দলের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত লোকদের নিয়োগ না দিলে কাক্সিক্ষত সফলতা আসবে না। সর্বোপরি বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যেসব ভালো কাজ করছে সেগুলোর তুলনায় অধিকতর ভালো কাজ করার জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকদেরকে দায়িত্ব দিতে হবে। প্রবল গতিতে জনসংযোগ এবং প্রচার প্রপাগান্ডায় ঝড়ের গতি আনতে হবে। গুজব, মিথ্যা স্বপ্ন এবং তৃতীয় ও চতুর্থ পক্ষের উপর নির্ভরতা পরিহার করে কাক্সিক্ষত সুযোগের অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

নয়াদিগন্ত