গত ছয় দিনে বিএনপির মহাসচিবসহ ১২ জন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এত অল্প সময়ে এত নেতার গ্রেপ্তার নিকট অতীতে হয়নি। পরিস্থিতির গতি-প্রকৃতি দেখে দলটির নেতা-কর্মীরা বলছেন, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে হামলা ও পণ্ড করার ঘটনা ছিল পরিকল্পিত। এখন নেতাদের যে গ্রেপ্তার চলছে, সেটিও ওই পরিকল্পনারই অংশ।
দলীয় সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন ধরে বিএনপিকে ভাঙার নানা তৎপরতা চলছিল। এখন ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে সহিংসতার ঘটনায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১২ জন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তারের পর নেতা-কর্মীদের মধ্যে দল ভাঙার বিষয়টি বলাবলি হচ্ছে। ২৯ অক্টোবর প্রথম মির্জা ফখরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর গত ছয় দিনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, তিন ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর, আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও শামসুজ্জামান, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন ও খায়রুল কবির, সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার ও বিলকিস জাহান এবং কেন্দ্রীয় নেতা জহির উদ্দিন স্বপনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার এড়াতে সব নেতাই আত্মগোপনে রয়েছেন।
বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলছেন, দল ভাঙার তৎপরতার অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এর সঙ্গে অনেকে ২০০৭ সালের এক-এগারোর সময়কার দলের সংস্কারপন্থী অংশটির তৎপরতাকে মেলানোর চেষ্টা করছেন। তবে এ ব্যাপারে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ওয়াকিবহাল।
যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা তো (দল ভাঙা) আজকের খেলা নয়। এক-এগারোর সময়েও হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেছে, ভাঙতে পারেনি, এখনো পারবে না, এটা আমার বিশ্বাস। এসব নিয়ে আমরা চিন্তিত নই।’
সম্প্রতি তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেন বিএনপির সাবেক দুই নেতা সমশের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকার। তাঁরা বলেছেন, আরও অনেকে এই দলে যোগ দেবেন।
নির্বাচন সামনে রেখে গত আগস্ট মাসে নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) নামে দুটি দলকে নিবন্ধন দিয়েছে। যদিও দল দুটিকে অনেকে দেখছেন ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে। বিএনএমের মূল নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপির সাবেক দুই নেতা।
বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও দলটি থেকে নেতারা নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে মনে করেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ। বার্তা সংস্থা বাসস জানায়, গতকাল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘বিএনপির অবরোধ-নৈরাজ্যের প্রতিবাদে শান্তি সমাবেশে’ হাছান মাহমুদ বলেন, ‘অনেকেই লাইন ধরে আছে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার জন্য। আর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজের নেতৃত্বে আরেকটি দল হতে যাচ্ছে।’
হাছান মাহমুদের বক্তব্যের বিষয়ে গত রাতে মেজর (অব.) হাফিজের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
অবশ্য বিএনপির কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের নেতাদের গণগ্রেপ্তারে ভিন্ন ফলও দেখছেন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকার পরিকল্পিতভাবে রাজপথে প্রধান বিরোধী দলের ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে দিচ্ছে। তবে এর ফলে তৃণমূলে বিরোধী দলের তাৎক্ষণিকভাবে নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে।
আবার দুই দিনের অবরোধ
একদিকে নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, আরেক দিকে মাঠে কর্মসূচিতে দমন-পীড়ন—এর মধ্যেই সরকারের পদত্যাগসহ এক দফা দাবিতে এবং মহাসমাবেশে হামলা ও নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে মাঠের কর্মসূচিতে রয়েছে বিএনপি। দুই দফায় পাঁচ দিনের অবরোধ শেষে গতকাল সোমবার আবারও সারা দেশে দুই দিনের সড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। আগামী বুধবার ভোর ছয়টা থেকে শুরু হয়ে শুক্রবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ চলবে। আজ মঙ্গলবার কোনো কর্মসূচি নেই।
বিএনপির পাশাপাশি গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২–দলীয় জোট, এলডিপিসহ অন্যান্য দল ও জোটও যুগপৎভাবে একই কর্মসূচি ঘোষণা করে। জামায়াতে ইসলামীও পৃথকভাবে বুধ ও বৃহস্পতিবার ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ দিয়েছে।
গত কয়েক দিনে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা আগামী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত শক্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। এরপর পরিস্থিতির আলোকে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা হবে। যদিও চলমান হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি আর কত দিন চলবে এবং এর পরিণতি নিয়ে বিএনপির ভেতরে-বাইরে নানা কথা আছে। বিশেষ করে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের কেউ কেউ বিএনপিকে হরতাল-অবরোধ থেকে রাজপথের সভা-সমাবেশের কর্মসূচিতে ফেরা উচিত বলে মনে করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুগপৎ আন্দোলনের একটি শরিক দলের নেতার মূল্যায়ন হচ্ছে, ২৯ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ মিলে ছয় দিনের কর্মসূচি ভালো হয়েছে। এ সময়ে কার্যত ঢাকা বিচ্ছিন্ন ছিল। তবে তাঁর আশঙ্কা, যেভাবে দমন-নিপীড়ন চলছে, তাতে সামনের অবরোধের কর্মসূচি ভোঁতা হয়ে গেলে তখন পুরো আন্দোলনই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। তাই বিএনপিকে এখন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় খোলা, নেতা-কর্মীদের স্বাভাবিক করে আবার সভা-সমাবেশের কর্মসূচিতে ফেরা উচিত। এ ব্যাপারে বিএনপির নেতৃত্বকে অনেকে পরামর্শ দিয়েছেন।
অবশ্য এর পাল্টা যুক্তিও আছে আন্দোলনে শরিক অন্যদের। তাঁরা বলছেন, তফসিল পর্যন্ত শক্তভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে। এর মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টাবে। এখন বিএনপি স্বাভাবিক হতে চাইলেও সরকার হতে দেবে না। সভা-সমাবেশ করারও অনুমতি দেবে না। আবার কারও কারও মূল্যায়ন হচ্ছে, বিএনপি এ পর্যন্ত ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ, ২৯ জুলাই ঢাকার চার প্রবেশমুখে অবরোধ এবং ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ—তিনটি বড় কর্মসূচিতে সফল হতে পারেনি। এখন নতুন করে বড় সভা-সমাবেশ করে আর কী ফল পাবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে তাদের এজেন্ট দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাস তৈরি করেছে। আবার এটাকে পুঁজি করে এখন সর্বাত্মক দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। জনগণ সরকারের এই ছলচাতুরী বুঝে গেছে। আমরা সরকারের এই নৈরাজ্য মোকাবিলা করেই আন্দোলনকে এগিয়ে নেব এবং বিজয় লাভ করব।’
সূত্র : প্রথম আলো