মাহমুদুর রহমান
২০১৬ সালের নভেম্বরের শেষে দ্বিতীয় দফার জেলমুক্তির পর বিএনপি’র নেতাদের সাথে আলাপ আলোচনা করে বুঝতে পারছিলাম যে, আমার বেশ দীর্ঘ জেল জীবনের মধ্যবর্তী সময়কালে জাতীয়তাবাদী দলটির ভারত নীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। দিল্লির সঙ্গে “অধীনতামূলক মিত্রতা” ব্যতীত রাষ্ট্রক্ষমতা মিলবে না, এমন একটি ধারনা বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব তো বটেই, এমনকি মধ্যম সারির নেতাদের মধ্যেও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে। জেল থেকে বের হওয়ার পর আমি আগের মতই ভারতীয় আধিপত্যবাদ এবং হিন্দুত্ববাদ সম্পর্কে বয়ান দিতে থাকলে বিএনপির সঙ্গে আমার দূরত্ব তৈরী হয়। ততদিনে টুকু-খসরু-হুমায়ুন-শামা-মিন্টুরা দলটির নীতিনির্ধারনে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলে আমি বিএনপিতে রীতিমত অচ্ছুৎ হয়ে পড়লাম। আমাকে তারা জামাতপন্থী, ইসলামিস্ট, ভারতবিদ্বেষী, হঠকারী, রাজনীতিতে অর্বাচীন, ইত্যাকার বিশেষণ দিয়ে বিএনপির ক্ষমতায় আরোহনে অন্যতম বাধা হিসেবে চিহ্নিত করলেন। এতে অবশ্য আমার কাজে কোন সমস্যা হয় নাই। কারণ, কোন বিশেষ দলের কর্মী অথবা নেতা হওয়ার জন্য আমি হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করি নাই। বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয় অশুভ পরিকল্পনা সম্পর্কে দেশের জনগণকে অবহিত ও জাগ্রত করবার ইচ্ছা থেকেই এক-এগারো পরবর্তী প্রতিকূল সময়ে ইসলামিক ধর্মীয় বিশ্বাস, বাঙ্গালী মুসলমানের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে ময়দানে নেমেছিলাম। যেহেতু আমি রাজনৈতিক নেতা নই, তাই সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি এবং বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে সামগ্রিক সচেতনতা সৃষ্টি করাকেই বাকী জীবনের লক্ষ্য স্থির করেছিলাম। বিএনপি নেতাদের বিরাগ আমাকে বিন্দুমাত্র আদর্শচ্যূত করতে পারে নাই।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির একটি ক্ষুদ্র দল (প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, খসরু, মিন্টু এবং হুমায়ুন) দিল্লির রাস্তায় যথেষ্ট ঘোরাঘুরি করলেও মোদি কিংবা বিজেপির কোন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ পেতে ব্যর্থ হয়। দিল্লির ব্যর্থ মিশনের পরও বিএনপির উল্লিখিত ভারততোষণকারী গং হতোদ্যম না হয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের উপর তাদের প্রভাব অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয় এবং ড: কামাল, কাদের সিদ্দিকী জাতীয় প্রমাণিত ভারতীয় দালালদের ভাড়া করে এনে নির্বাচনী জোটের নেতৃত্বে বসিয়ে বিএনপিকে একটি নব্য, সেক্যুলার দলরূপে তুলে ধরার মাধ্যমে ভারতীয় “ডিপ স্টেটের” মন পাওয়ার সর্বাত্বক চেষ্টা করে। এতে অবশ্য কাজের কাজ কিছুই হয় নাই। ভারতের সক্রিয় সমর্থনে শেখ হাসিনা ২৯ ডিসেম্বর রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে নির্বাচনী তামাশা সমাপ্ত করে ফেলে। বিএনপি প্রথমে সংসদ বর্জনের ঘোষণা দিলেও দলটির সুবিধাবাদি পাঁচ-ছয়জন কথিত সংসদ সদস্য হাসিনার সংসদ নামক অশ্লীল খোঁয়াড়েও যোগ দেয়। এই দালালদের মধ্যে উকিল আবদুস সাত্তার অন্যতম ছিল।
২০১৮ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও আশ্চর্যজনকভাবে, বিএনপি নেতৃত্বের ভারত বিভ্রমের অবসান ঘটে নাই। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত দলটি নির্বোধের মত দিল্লির সমর্থনের আশায় থেকেছে। সেই পাকিস্তানী আমল থেকে শেখ পরিবারের সাথে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার গভীর সংযোগের ইতিহাস বারে বারে স্মরণ করিয়ে দিলেও বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সম্বিত ফেরানো যায় নাই। দিল্লিকে খুশী করতে বিএনপি একদিকে যেমন জামাতে ইসলামসহ অন্যান্য ইসলামিক দলসমূহের সাথে দূরত্ব বজায় রেখেছে, অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে কুক্ষিগত করে নিলেও তার বিরুদ্ধে কোনরকম প্রতিবাদ করে নাই। পনেরো বছরে ভারত বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে করিডোর বানিয়ে ফেলেছে, সমুদ্র বন্দরগুলো দখলে নিয়েছে, উজানে বাঁধ দিয়ে নদনদীর প্রবাহ আটকে দিয়েছে, ক্যান্টনমেন্টসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় গোয়েন্দাদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে, অথচ বিএনপি নীরব থাকার কৌশল অব্যাহত রেখেছে। অবশেষে গত বছরের একেবারে শেষের দিকে অতি বিলম্বে দলটির প্রায় দশক ব্যাপী অনুসৃত, আত্মঘাতী নীতি পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেছে। রিজভী আহমেদের কয়েক দফা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ভারতের যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে মৃদু প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু, ততদিনে বড় বেশি দেরী হয়ে গেছে।
২০২১ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বিএনপি কয়েক শত বিশাল সমাবেশ করেছে যেখানে প্রতিবার লক্ষ, লক্ষ নেতা, কর্মী, ও সাধারণ জনগণ ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের যাবতীয় বাধা অতিক্রম করে সমবেত হয়েছে। সমাবেশে অংশ নিতে গিয়েও দেশের জনগণকে পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছে। সেই সমস্ত সমাবেশে বিএনপি নেতৃবৃন্দ ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী বক্তব্য দিলেও বাংলাদেশের জনগণ ও স্বাধীনতার মূল শত্রু ভারত সম্পর্কে নীরব থেকেছেন। সভায় নেতারা জনগণকে কেবল ভোটের অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েছেন। ভারত কর্তৃক লুন্ঠিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার কিংবা হিন্দুত্ববাদের থাবা থেকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর মুক্তির জন্য ডাক দেন নাই। রাষ্ট্রের স্বাধীনতা না থাকলে জনগণের ভোটাধিকারের যে কোন মূল্য নাই, এই মূল বিষয়টি বিএনপি’র নীতিনির্ধারকরা হয় বুঝতে পারেন নাই, অথবা দিল্লিকে সন্তুষ্ট রাখতে এড়িয়ে গেছেন। এই ভ্রান্ত নীতির ফলেই শেখ হাসিনা আপামর জনগণের প্রত্যাখ্যান স্বত্ত্বেও ৭ জানুয়ারী একটি “ডামি নির্বাচন” করতে পেরেছে। ওই দিন ফ্যাসিস্ট শাসন থেকে মুক্তির আরো একটি সুযোগ আমরা হয়তো হারিয়েছি।
কোন ফ্যাসিস্ট সরকারকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা গেছে বলে আমার জানা নাই। কেউ কেউ হয়ত স্পেনের ফ্যাসিস্ট শাসক ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকোর (১৯৩৯-১৯৭৫) উদাহরণ টানতে পারেন। স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, ফ্রাংকোর আসলে পতন হয় নাই কিংবা তিনি ক্ষমতা থেকে অপসারিতও হন নাই। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ১৯৬৯ সালে ফ্রাংকো নিজেই হুয়ান কার্লোসকে রাজা ঘোষণা করে তাকেই ক্ষমতার উত্তরাধিকারী বানিয়ে গেছিলেন। রাজা হুয়ান কার্লোস ফ্যাসিস্ট ফ্রাংকোর ৮৩ বছর বয়সে মৃত্যুর পর স্পেনে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন। বাংলাদেশেও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সৃষ্ট, ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনাকেও কোন প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচন অথবা অন্য কোন শান্তিপূর্ণ উপায়ে অপসারণের সুযোগ নাই। শেখ হাসিনা নিজেও একাধিকবার বলেছেন যে, তিনি একচ্ছত্র ক্ষমতা চান এবং প্রাণ থাকতে ক্ষমতা ছাড়বেন না। অতএব, সভাসমাবেশে অহিংস আন্দোলনের বিরক্তিকর ভাঙ্গা রেকর্ড বাজিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে অপসারণ করা সম্ভব নয়। জনগণকে সংগঠিত করে, জীবন বাজি রেখে সর্বাত্বক সংগ্রামে নামানো গেলেই কেবল পৈশাচিক সরকারের পতন সম্ভব। প্রশ্ন হলো, কেবল ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কি জনগণ জীবন দেওয়ার জন্য তৈরী হবে? ৭ জানুয়ারী আমরা তার জবাব পেয়ে গেছি। জনগণ অবশ্যই ঘরে থেকে “ডামি নির্বাচন” বর্জন করেছে। কিন্তু, তারা সেই নির্বাচন প্রতিহত করতে রাস্তায় নামে নাই। বিএনপির পক্ষ থেকেও ৭ জানুয়ারী শুধু পরিবারকে সময় দেওয়ার আহ্বান ছিল, সরকার পতন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক ছিল না।
আমি মনে করি, ২০২১ সাল থেকে বিএনপির নেতৃবৃন্দ যদি কেবল ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার সীমিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য খন্ডিত সংগ্রামের বয়ান না দিয়ে বাংলাদেশকে ভারত এবং হিন্দুত্ববাদের দখল থেকে বৃহত্তর মুক্তির লক্ষ্যে লড়াই করার অনুপ্রেরণা দিতেন, তাহলে জনগণ ৭ জানুয়ারী “ডামি ভোট” বর্জনের সঙ্গে দেশের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে জীবন দিতেও এগিয়ে আসতেন। “ডামি নির্বাচন” হয়ে যাওয়ার পর এখন বিএনপিকে পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। আজ যদি আমরা দেশের পরাধীনতা মোচনের লড়াইয়ে সম্পৃক্ত থাকতাম, তাহলে নেতাদের কর্মসূচি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হতো না, দফায়, দফায় মিটিং করতে হতো না। ৭ জানুয়ারী রাজপথেই যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায় নির্ধারিত হয়ে যেত। “ডামি ভোট” বর্জন করে কেবল পরিবারকে সময় দেয়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচি হতে পারে না। নানারকম ভয়, ভীতি, লোভ অতিক্রম করে যে জনগণ “ডামি নির্বাচন” বর্জনের সাহস দেখিয়েছে, একটি মহৎ লক্ষ্য সামনে থাকলে, তারাই বাংলাদেশকে ভারতীয় দালাল এবং হিন্দুত্ববাদ থেকে মুক্ত করার মহান সংগ্রামে জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকতো। দিল্লির নির্দেশে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর যে অস্ত্র জনগণের দিকে তাক করা আছে সেই অস্ত্র ক্ষমতাসীনদের দিকে ঘুরে যাওয়াও হয়ত সম্ভব ছিল।
আমরা আশা করতে চাই যে, ৭ জানুয়ারীর পর দেরীতে হলেও বিএনপি নেতৃত্বের ভারত বিভ্রম কেটে গেছে। বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ নাগরিক মুসলমান। কাজেই, রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে ইসলাম নিয়ে কোনরকম দ্বিধা অথবা হীনমন্যতা থাকলে সেটি হিন্দুত্ববাদকে মোকাবেলায় আমাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের মহান সংগ্রামকে হীনবল করবে। দুর্বল ঈমান নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে বিজয় লাভ করা যাবে না। মালদ্বীপের দিকে তাকান। মাত্র পাঁচ লাখ জনসংখ্যার একটি দেশের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু, আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের সেনাবাহিনীকে ১৫ মার্চের মধ্যে তার দেশ থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়ার সাহস দেখিয়েছেন। এটাই ঈমানের শক্তি। বাংলাদেশের নাগরিকের সংখ্যা অন্তত: ১৮ কোটি যার মধ্যে সাড়ে ষোল কোটি মুসলমান। বাঙ্গালী মুসলমানের গর্বিত আত্মপরিচয় নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েই দেখুন না, হিন্দুত্ববাদিরা লেজ গুটিয়ে পালাবে। বিএনপির সামনে এক ঐতিহাসিক সময় আবির্ভূত হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের ডাক দিন। দেশ স্বাধীন হলে, জনগণ মুক্ত হলে, তবেই না ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। পরাধীন জনগণের আবার ভোটাধিকার কি? গত এক দশকের ভারত বিভ্রম থেকে শিক্ষা নিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার ভারতীয় হিন্দুত্ববাদি প্রভুর বিরুদ্ধে বৃহত্তর লড়াইয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে অবিচল ও সাহসী নেতৃত্বের প্রমাণ দিলে মহান আল্লাহতায়ালা নিশ্চয়ই আমাদের সহায় হবেন।
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ