বিএনপির কাছে জনগণের প্রত্যাশা

আবদুল লতিফ মাসুম

রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যকলাপ সামাজিক বিজ্ঞানে ‘রাষ্ট্র গঠন’ বা ‘জাতি গঠন’ প্রক্রিয়া বলে অভিহিত। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রত্যাশিত রাষ্ট্র বা জাতি গঠনে জনপ্রিয় দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পাদভূমিতে দাঁড়িয়ে সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পুনঃ অনুরণন অনুভূত হচ্ছে বিপ্লব–পরবর্তী বাংলাদেশে।

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠনের পর প্রায় ৫০ বছর ধরে সরকার ও বিরোধী দল উভয় ক্ষেত্রে বিএনপি তার উদ্দিষ্ট সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বানসি কুবুথা (ইন্টারনেট ২০১৬) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দলের পাঁচটি করণীয় নির্ধারণ করেছেন: ১. সমাবেশের স্বাধীনতার অগ্রায়ণ, ২. গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন, ৩. নাগরিক সাধারণকে সরকারি ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিতকরণ, ৪. ব্যক্তিস্বাধীনতা বিকাশ এবং ৫. ক্ষমতাসীন দলের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ।

প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিএনপি গণতান্ত্রিক সমাজের লক্ষ্যে উল্লিখিত কার্যক্রম দায়িত্বশীলতার সঙ্গে অব্যাহত রেখেছে। সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সব পর্যায়ে বিএনপি পালন করেছে নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা। বন্দুকের নল থেকে বিএনপির জন্ম বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বিএনপি তার দীর্ঘ পথপরিক্রমায় প্রকৃত গণভিত্তিক দলে পরিণত হয়েছে।

দেশের বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহানের মন্তব্যে এর স্বীকৃতি রয়েছে। সফল বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির উত্থানে খালেদা জিয়ার ভূমিকাকে মুখ্য মনে করেন তিনি। তাঁর ভাষায়, ‘শি (খালেদা জিয়া) সাকসিডেড ইন ট্রান্সফরমিং দ্য বিএনপি ফ্রম এ স্টেট স্পনসরেড সরকারি পার্টি টু এন অপোজিশন পার্টি’। (রওনক জাহান; ২০১৫: ৩১)

স্বাধীনতার পরপর যে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তা রাষ্ট্র বা জাতি গঠন প্রক্রিয়ার বদলে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধন করে। এ ক্ষেত্রে ‘জাতীয় সরকার’ অগ্রাহ্যকরণ ও পরবর্তী সময়ে ‘বাকশাল’ গঠন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে যে সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, স্বাভাবিকভাবে তা রাষ্ট্রিক লক্ষ্য ও গণতন্ত্রের জন্য অনুকূল ছিল না। সামরিক কর্তৃত্বের পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক শূন্যতায় রাষ্ট্রিক সংকট দেখা দেয়। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমান ক্ষমতার পাদপীঠে স্থাপিত হন। ইতিহাস প্রমাণ করে, ‘বাংলাদেশকে সুস্থ, স্বাভাবিক, স্বাধীন, সার্বভৌম, শক্তিমান, সমৃদ্ধিশালী ও প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার’ যথার্থ কর্মসূচি কোনো রাজনৈতিক দলই গ্রহণ করেনি। (আবুল কাশেম ফজলুল হক: ২০০৮) সৈনিক রাজনীতিবিদ জিয়াউর রহমান উদ্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজনৈতিক দল গঠন করেন।

বিএনপির গঠনতন্ত্রে দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অংশের ২(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদভিত্তিক ইস্পাতকঠিন গণ-ঐক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও গণতন্ত্র সুরক্ষিত ও সুসংহত করা’ তাদের রাষ্ট্রিক গন্তব্য। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে গঠনতন্ত্রের একই অংশের (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এমন এক সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে গণতন্ত্রের শিকড় সমাজের মৌলিক স্তরে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়।’

জিয়া যেমন কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন, ঠিক তেমনি জাতির আস্থা, বিশ্বাস ও লালিত মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নিয়েছেন। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের জন্য নাগরিক পরিচয় সুনির্দিষ্ট করেছেন। সংবিধানের মৌলনীতির পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাষ্ট্রীয়করণ করেছেন। পাশ্চাত্যমুখী উন্নয়ন কৌশল অনুসরণ করে শিল্পায়ন ও বিনিয়োগের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। (সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম: ১৯৮৬)। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনে সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন। এ সময়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মান ও মর্যাদা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের আসন লাভ উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

গতানুগতিক রাজনৈতিক কর্মসূচির পরিবর্তে গোটা জাতিকে উদ্বেলিত করার জন্য জিয়াউর রহমান দেশপ্রেমমূলক গণমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেন। খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নেন। খাল কাটার কর্মসূচি গ্রহণ করেন। নিজের সস্তা জনপ্রিয়তার কথা না ভেবে রক্ষণশীল বাংলাদেশ সমাজে জন্মনিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানান। নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করেন। যুবকদের কর্মমুখী করার জন্য কার্যক্রমে তাদের সম্পৃক্ত করেন। জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকে ‘গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী’ গঠন করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামান এ পদক্ষেপকে সম্ভাব্য ‘সিটিজেন আর্মি’ বা নাগরিক সেনাবাহিনীর প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে করেন।

জিয়াউর রহমানের ভাষায়, ‘জাতির মুক্তি ও উন্নয়ন’–এর জন্য ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। গঠিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর রাষ্ট্রিক তথা সার্বিক লক্ষ্য হিসেবে এই ১৯ দফা কর্মসূচিকে গ্রহণ করা হয়।

বিএনপি নিশ্চিতভাবেই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। বিগত কয়েক দশকে যেসব গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। ২০১৪–এর ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০১৮–এর নিশীথ নির্বাচন এবং ২০২৪–এর ‘ডামি’ নির্বাচন এর প্রমাণ। সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, তথা জুলাই বিপ্লবের পর আশাবাদ এ রকম যে বিএনপি আগামী নির্বাচনে বিজয় অর্জন করবে।

বিগত দেড় যুগে গুম, খুন, হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়ন সত্ত্বেও বিএনপির প্রতিবাদী  অবস্থান সুদৃঢ় রয়েছে। শুধু ক্ষমতায় আরোহণ একটি রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হতে পারে না। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির যে বদনাম ছিল, দীর্ঘ এক যুগের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তা বদলে দিয়েছে। শত শত মানুষের রক্তঋণের মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছে নতুন অধ্যায়।

হামলা-মামলা, জেল-জুলুম ও অন্যায়-অত্যাচার বিএনপিকে এসিড টেস্টের মাধ্যমে খাঁটি সোনায় পরিণত করেছে। বিএনপির বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ এই যে তারা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার অনুকূলে গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে এতে কারও দ্বিমত নেই যে বিএনপি তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনের ভিত্তিভূমি নির্মাণ করেছে।

দেশ আজ অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। দুঃসময়ের দিনগুলোতে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, শক্ত সংগঠন ও কর্মী বাহিনীর আত্মত্যাগ বিএনপিকে রক্ষা করেছে। তাই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। সেই সঙ্গে বিএনপি নেতৃত্ব ও সংগঠন রাষ্ট্র সংস্কারের গণদাবিকে এগিয়ে নিতে ইতিমধ্যেই ভিশন–২০৩০ গ্রহণ করেছে।

দীর্ঘ দেড় দশকের দুঃশাসনের ফলে যে রাষ্ট্রিক সংস্কার অনুভূত হচ্ছে, তা বিএনপি অনুমোদন করে। সেই লক্ষ্যে প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘যৌক্তিক’ সময় দিতে প্রস্তুত আছে বিএনপি। তবে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংস্কার কর্মসূচি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছেন। এক নদী রক্ত পেরিয়ে যে গণবিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার অনিবার্য লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার গঠন।

প্রায় ৫ দশক আগে জিয়াউর রহমান যে গণমুখী ১৯ দফা কর্মসূচি দিয়েছিলেন, তার ভিত্তিতে এবং গণদাবিকে সমন্বিত করে ভবিষ্যৎ নির্বাচিত বিএনপি সরকার নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করবে। বর্তমান সময়-সমস্যা, পরিবেশ-পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে সবকিছু। ক্ষমতা লক্ষ্য কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিই যেন মুখ্য না হয়ে দাঁড়ায়। পতিত শাসক দলের বিপরীতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে একটি সুশাসন, ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজের একটি রূপকল্প উপস্থাপিত হতে হবে বিএনপির কার্যক্রমে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর আর খানের একটি গ্রন্থের শিরোনাম হচ্ছে ‘বাংলাদেশ: ক্রাইসিস টু ক্রাইসিস’। সত্যিই আমাদের সংকটকাল যেন শেষ হয় না। বিপ্লব–উত্তর বাংলাদেশ আরেক সংকটময় সময় অতিক্রম করছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর  পাদভূমিতে দাঁড়িয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জনগণকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আবেদন জানিয়েছেন। গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় দেশে জবাবদিহির গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দিয়েছেন।

শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, রাষ্ট্র ও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন নিশ্চিত করাই এখন বিএনপির মূল লক্ষ্য বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিএনপি নেতৃত্ব।  বিএনপির সামনে যে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ তৈরি হয়েছে তার লালন-পালন, সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নে বিএনপি যথার্থ ভূমিকা পালন করবে বলে জনগণের  প্রত্যাশা।

  • ড. আবদুল লতিফ মাসুম অধ্যাপক (অব), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
  • PROTHOM ALO