বিএনপির এখন বড় ‘দুর্দিন’


গণতান্ত্রিক দেশেই রাজনৈতিক অঙ্গনে পক্ষ-প্রতিপক্ষের মধ্যে পাল্টা বক্তব্য দেয়া হর হামেশাই ঘটে যেসব বক্তব্যে দলের নীতি কার্যক্রম নিয়ে কথা থাকে। সেখানে গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার ও শৈলীর কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। আমাদের এখনো পাল্টাপাল্টি কথা হয়, কিন্তু সেখানে গণতান্ত্রিক ‘নর্মস’ বা চেতনা এতটাই লঙ্ঘিত হয়, বহু ক্ষেত্রেই তা শালীনতা ভব্যতার সীমা অতিক্রম করে যায়। ফলে রাজনীতির অঙ্গনে সব সময়ই বিরাজ করে তিক্ততা ও সাধারণ সৌজন্যের সীমাহীন ঘাটতি। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেন, দলটির এখন বড় ‘দুর্দিন’, এটা বিএনপির প্রতি সহানুভ‚তি প্রকাশের লক্ষ্যে বলা হয়নি। বক্তব্যের মূল সুরটি হচ্ছে তীর্যক; দলটিকে নিছক হেয় প্রতিপন্ন করা। এটাই সবাই বোঝেন। দেশের দলগুলো কখনোই সত্যিকার অর্থে তাদের প্রতিপক্ষের প্রতি সহানুভ‚তি দেখানোর মতো এমন উদারতার এখনো উন্মেষ তাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারেনি। সৌজন্য সহমর্মিতার প্রকাশের মানসিকতা এখনো তারা লালন করেন না। বরং এটাই দেখা যায়, ক্ষমতাসীনরা তাদের প্রধান প্রতিপক্ষকে ঠেলতে ঠেলতে খাদে ফেলার আয়োজনেই ব্যস্ত থাকে।

বিএনপির প্রতি যে নেতা ‘দুর্দিনে’ থাকার কথা যে উদ্দেশ্যেই বলে থাকুন না কেন, তাতে কিন্তু সত্যতা আছে। কেননা ক্ষমতাসীন দলের সব পর্যায়ের নেতাগণ অহর্নিশভাবে বিএনপিকে বাক্যবাণে জর্জরিত করছেন। তাতে তাদের ভালো থাকা জো’টা কোথায়? বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের কোনো ভুল নীতি, সিদ্ধান্ত, দুর্বলতার সমালোচনা করে কিছু বললে, তা বিবেচনায় নেয়া তো দূরের কথা; তা যেন মৌচাকে ঢিল ছোড়ার মতো হয়ে যায়। চতুর্দিক থেকে এই দলটি ওপর বাক্যে গোলা ছোড়া শুরু হয়ে যায়। কোনো অভিযোগ তোলা অন্যায় হবে না যদি তথ্য-উপাত্ত হাজির করে তোলা হয়। কিন্তু কোনো তথ্য-উপাত্ত পেশ না করে বিএনপিকে যা ইচ্ছা তাই বলে মজলুম বানানো হচ্ছে। শুধু বিএনপি নয়, আরো কিছু দল এভাবে জুলুমের শিকার হচ্ছে। এতে ক্ষমতাসীনের প্রতি এসব সংগঠনগুলোর কর্মী-সমর্থক শুভাকাক্সক্ষীদের মনে ভীষণ নেতিবাচক ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছে। সরকারের জন্য তা জনবিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করবে। সুষ্ঠু ভোটের পর প্রকৃত বিজয়ীরা শুধু কোনো দলগোষ্ঠী বিশেষের সরকার থাকে না, সবার সরকার হয়ে উঠতে হয়, উদারচিত্তের পরিচয় দিতে হয়। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে অনাবিল মমতার দৃষ্টিতে দেখতে হয়। সবার প্রশ্ন সেভাবে দেখা হচ্ছে।

এটা আমরা বিশ্বাস করিÑ অকারণ ছিদ্রান্বেষণ, উদ্দেশ্যমূলক কিছু বলা হলে তার জবাব দেয়ার অধিকার সবার আছে। আবার এটাও যথার্থ বলে মেনে নিতে হবে, গণতান্ত্রিক সমাজে সরকারে দুর্বলতাকে রঙ না চড়িয়ে তুলে ধরার অধিকার সবারই সংরক্ষিত থাকে। এটা সহ্য না করে, গালমন্দ করা কুরুচির পরিচায়ক তো বটেই; সে সাথে অগণতান্ত্রিক হীন উদ্দেশ্যেই বলতে হবে।

রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতা-নেত্রীদের সবাই অভিন্ন ধ্যান-ধারণা পোষণ করবেন বিশেষ করে যেখানে গণতন্ত্রের অস্তিত্বের কথা বলা হয়। তবে হ্যাঁ, যেখানে স্বৈরতন্ত্র বহাল সেখানে সবাইকে এক কাতারে চলতে হয় বা চলতে বাধ্য করা হয়। সত্য কথা বলাটারও অধিকারও থাকে না। নির্দিষ্ট করে দেয়া সরল রেখার বাইরে যে যতটুকু বেরিয়ে আসবে, সেটা কারো হাতই হোক আর পা’ই হোক ছেঁটে দেয়া হবে। তাতে সে বাঁচুক বা মরুক অথবা বিকলাঙ্গ হোক ‘কুছ পরওয়া’ নেই। আমাদের এখানেও কি কেউ সে রকম কথা ভাবেন? প্রশ্নটা মনে উদয় হলো এ জন্য যে, ক্ষমতাসীন দলের সেই শীর্ষ নেতা সম্প্রতি বিএনপির আন্দোলনকে ‘দূষণ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাকে যদি তিনি দূষণই মনে করেন তবে সেটা দূর করা, ক্লিন করা জরুরি! অথচ বিএনপি তো নাগরিকদের তেমন সমস্যা সঙ্কটে ফেলে দেয়নি। তারা মিছিল-মিটিং করছে। কিন্তু প্রতিদিন তো নয়। বিশেষ কোনো অকেশনে বা উপলক্ষে তা করে। তা ছাড়া বাংলাদেশে তো এটা কোনো নতুন ‘ফেনোমেনা’ নয়। আর সমাবেশ শোভাযাত্রা করা তো ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সংগঠনের সাংবিধানিক অধিকার। দেশের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে রয়েছে ‘….শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ গণতন্ত্রের চেতনাকে সংবিধানে এভাবেই উচ্চকিত করা হয়েছে। তাকে যদি দূষণ ভাবা হয়, তবে সেটা তো গণতন্ত্র ও সংবিধানের পরিপন্থী। অথচ গণতন্ত্রের সৌরভ সৌন্দর্য হচ্ছে ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। শ্রদ্ধা করা না জানলে শ্রদ্ধা পাওয়াও যায় না। ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রতি গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার যারা অনুশীলন করেন, তাদের প্রাত্যহিক জীবনে চলনে বলনে পরিস্ফুট হয় তা।

দেশে লিখিতভাবে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত থাকলেও নিত্যদিনে কার্যক্রমের মধ্যে তার প্রতিফলন নেই। সংসদীয় গণতন্ত্র যেভাবে চর্চা হয় ‘মাদার পার্লামেন্টে’ তথা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কার্যক্রমে, তার ধারে কাছে আমরা নেই। এ নিয়ে ক্ষমতাসীনরা সোচ্চার; কিন্তু সে গণতন্ত্র চর্চায় তারা ‘ব্যাক বেঞ্চার’। গত ৫০ তার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বটে; কিন্তু দলের পূর্বসূরিদের আচার-আচরণ ‘এটিকেট’ থেকে এখন আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের ‘ব্রæটলি মেজোরিটি’ থাকা সত্তে¡ও তারা যোজন দূরে অবস্থান করছে। এ কোনো অসত্য ‘এলজাম’ নয়। অতীতে আওয়ামী লীগে প্রশংসিত ভ‚মিকার কথা বলব। দিনে দিনে ব্যক্তি কিংবা সংগঠন গুণে আচরণে আরো পরিশীলিত হয়। তাতে সমাজ আলোকোজ্জ্বল হয়। কিন্তু আজ তো অসহিষ্ণুতা দেশকে গ্রাস করছে।

ফিরে যাই দূষণ ছড়ানোর প্রসঙ্গে; তবে তো দূষণ দূর করতে হবে, ক্লিন করা জরুরি! কথা আছে ‘যারে দেখতে নারি, তার চরণ বাঁকা।’ বিএনপি ডানে বামে যে দিকে ঘুরতে গেলেও কি দূষণ বিচ্ছুরিত হয়? তারা বললেও দোষ, না বলেও দোষ। বেচারারা পাতালে যাবে, না ঊর্ধ্ব আকাশে উঠে যাবে নাকি ‘ভ্যানিশ’ হয়ে গেলে সবাই খুশি হয়! ভুলে যাই কেন বিএনপির ভোটপ্রাপ্তির হিসাব। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রæয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল পঞ্চম জাতীয় সংসদের নির্বাচন। বিএনপির ভোট লাভের অঙ্কটি ছিল এক কোটি পাঁচ লাখ সাত হাজার ৫৪৯। সপ্তম সংসদ নির্বাচনে তার ভোট দুই কোটি ২৮ লাখ ৩১ হাজার ৯৭৮। মনে হয় ক্ষমতাসীনদের স্বস্তির জন্য বিএনপিকে তার সমর্থকদের দেশান্তরিত, গ্রহান্তরিত হতে হবে। আসলে এটা কেন স্মরণ রাখা হচ্ছে না বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশের প্রাচীনতম এবং বড় দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক থিম এর বিপরীতে যে, নতুন রাজনৈতিক ধারণা পেশ করেন। এ দেশ লাখ কোটি মানুষ তাদের মনের মণিকোঠায় স্থান তাকে দিয়েছে। তার জন্য অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা কর্মীরা সহ্য করেও চলেছে। প্রকৃত পক্ষে বিএনপি এ দেশের গণমানুষের দলে পরিণত হয়েছে। আর একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিএনপিতে শামিল হলে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে একটি গুণগত দিক পরিলক্ষিত হয়। সেটা দেশ ও দশের প্রতি দায়িত্বানুভ‚তির সৃষ্টি; তারা নীরবভাবেই দেশের এতটুকু স্বার্থের হানি হলে মরমে মরে যায়, সরব সোচ্চার হয়ে ওঠে। দেশে মানুষের ধর্মীয় এবং দেশজ শুদ্ধ সংস্কৃতিকে হৃদয়ে লালন করে আবেগে আপ্লুত। তাদের মনে গেঁথে গেছে ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ।’

ফিরে যাওয়া যাক পূর্ব প্রসঙ্গে, বিএনপির দুর্দিনের কথায়। দেশের সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাই এখানে বহুমত পথের মানুষ তাদের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বসবাসের এবং নিজস্ব চিন্তা-চেতনার আলোকে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠন করার অধিকার সংরক্ষণ করেন। সে বিবেচনায় এসব সংগঠন নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে পরস্পর সহযোগী। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টিও সে বিবেচনায় পরস্পরের সহযোগী। তাই এক সহযোগীর দুর্দিনে অপর সহযোগীর এগিয়ে আসাটা তো সাধারণ সহমর্মিতা ও সৌজন্য। আর গণতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তা আরো জরুরি। কেননা গণতন্ত্র মানেই একাধিক দলের অস্তিত্ব বজায় থাকা জরুরি। এক হাতে যেমন তালি বাজে না তেমনি একাধিক দল না থাকলে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব বজায় থাকতে পারে না। মেষ পাল থেকে কোনো একটি মেষ বিচ্ছিন্ন হলে নির্ঘাত তার স্থান হবে নেকড়ের উদরে! বিএনপি না থাকলে বহু বিপদই হতে পারে ক্ষমতাসীনদের। আজকে বিএনপির বড় বিপদ যা আমাদের নজরে পড়ছে তা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে যথেচ্ছ কুৎসা ছড়ানো আর দলের অগণিত নেতাকর্মীদের আসামি করে গায়েবি মামলায় জড়িয়ে কারাবাসে নেয়া। এসব থেকে সরে এলেই শুধু বিএনপির মদদ করা হতে পারে। শুধু তাই নয়, সুস্থ ধারার রাজনীতির বিকাশ ঘটবেÑ এটা মানুষ কি আশা করতে পারে না?

তবে এটা বুঝি, বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা মানসিক অশান্তি ও শূন্যতা বিরাজ করছে। দলের চেয়ারপারসন বন্দী অবস্থায় রয়েছেন। তিনি মারাত্মকভাবে অসুস্থ। তার সুষ্ঠু চিকিৎসা নিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীরা সন্তুষ্ট নন। দেশে যতটুকু চিকিৎসা হওয়া তা হচ্ছে বটে। কিন্তু রোগমুক্ত হতে পারছেন না তিনি। তার আরো উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন; এটা অতীব জরুরি। তা পূরণের জন্য তাকে বিদেশে নেয়া অত্যন্ত জরুরি বলে সংগঠনের নেতাকর্মীরা দাবি করে যাচ্ছেন। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো নিয়ে বিএনপির দাবি অগ্রাহ্য করা হচ্ছে আইনের নানা প্রশ্ন তুলে। এটা তো সাধারণ প্রশ্ন জীবন নিয়ে। বেগম খালেদা জিয়ার জীবন রক্ষার সাথে আইনের মারপ্যাঁচ কতটা মানবিক? আইন তো মানুষের কল্যাণের জন্য; সে বিবেচনাটা কি করা হচ্ছে? আর তা ছাড়া প্রতি নাগরিকের সুচিকিৎসার অধিকার আইনের মারপ্যাঁচের কাছে পরাজিত হবে। এটা অবশ্যই উত্তম দৃষ্টান্ত হবে না। তিনি একাধিকবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি দেশকে সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের তার যে অবদান তাকে কি মূল্যায়ন করা হবে না?

তা ছাড়া তার জেলজীবন নিয়ে প্রশ্ন আছে। তিনি প্রতিহিংসার শিকার কি না তা কে বলবে? তৎকালীন যে সরকার ছিল তাদের বৈধতার প্রশ্ন নাইবা তুললাম। কিন্তু বেগম খালেদার প্রতি সেই সরকারের চরম প্রতিহিংসাপরায়ণতা এবং তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংসের জন্য তার প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত বহু ভুয়া মামলা দায়ের করে তারা। সেসব মামলার জের টেনে তিনি জেল জীবনযাপন করছেন আর শত দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাকে। সেই সরকারের ভুয়া মামলা থেকে আরো অনেককেই অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সেই সব ভুয়া মামলা তুলে নিয়েছে পরবর্তী সরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বেগম জিয়ার মামলাগুলো তোলা হয়নি। এটা অবশ্যই আইনের ব্যত্যয়, বৈষম্যমূলক আর রাজনৈতিক কারণ এর পেছনে রয়েছে কি, এখানে সংবিধানের দুটি অনুচ্ছেদ তুলে ধরছি। সংবিধানে ২৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত রয়েছে ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার।’ ২৮(১) অনুচ্ছেদে রয়েছে ‘… কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ এসব ন্যায়ানুগ সুযোগ তিনি পাচ্ছেন না কেন!

দেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়। বিশেষ করে প্রতিপক্ষ দল ও নেতা-নেত্রীদের নিয়ে। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা অবশ্যই থাকতে পারে, কিন্তু প্রতিহিংসা পরশ্রীকাতর অত্যন্ত গর্হিত ব্যাপার, নিন্দনীয় বিষয়। তা সত্তে¡ও আমাদের দেশে তা শতভাগ বিরাজ করছে। এর কারণ হচ্ছে ক্ষমতা কর্তৃত্ব পাওয়ার অদম্য আকাক্সক্ষা; তা ছলে বলে কৌশলে কব্জা করতে রাজনীতিকরা মরিয়া হয়ে ওঠেন। তাই আমাদের সুষ্ঠু ধারার রাজনীতির বিকাশ ঘটছে না। ক্ষমতা কর্তৃত্ব পাওয়ার চাবিকাঠিটা যদি জনগণের হাতে স্থায়ী করা যেত, তথা আমাদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজনটা যদি স্বচ্ছ করা যেত, জনগণের ভোটাধিকারটা যদি সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো তা হলে ভোট হাতিয়ে নেয়ার বিষবৃক্ষটা শুকিয়ে যেত। বিএনপির ধারণা, নব্বই পূর্ববর্তী সময়ে মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার যে আন্দোলন হয়েছিল, তাতে বেগম জিয়ার যে অবদান তো ভুলে যাওয়া যায় না। বেগম জিয়া বাইরে থাকলে তেমন কিছু হতে পারে সে ভয় থেকেই কি তাকে আটক রাখা হয়েছে? প্রশ্ন হতে পারে তার কি এখন শারীরিক সক্ষমতা রয়েছে? তার উত্তর, তিনি বাইরে থাকলে মুক্ত মানুষের মতো কথা বললে পারলেই চলত। তিনি আন্দোলনে প্রতীক হয়ে থাকতে পারতেন। মুক্ত থাকলে এতটা অসুস্থ হতেন কিনা সন্দেহ আছে। তা ছাড়া বাইরে গিয়ে উন্নত চিকিৎসারও সুযোগ নিতে পারতেন। বেগম জিয়ার প্রতি একটা বিশেষ আবেগও কর্মীদের রয়েছে।

তা ছাড়া আরো সমস্যা হলো, বিএনপিতে নেতৃত্বের শূন্যতাও রয়েছে। দলের মহাসচিবসহ হাতেগোনা জনাকয়েক নেতাকেই আমরা সক্রিয় দেখছি। এতবড় দল, বিপুল তার কর্মী-সমর্থক শুভাকাক্সক্ষী, তারা নেতাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। অবশ্য বিএনপির নেতৃত্বে আসা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। কেননা তাতে জেল জুলুমের ভয় থাকে। তাই এই ঝুঁকি নিতে অনেকেই সাহসী হন না। এ জন্য সংগঠনটির এগিয়ে যাওয়া থমকে আছে।

এদিকে, তাত্তি¡কদের কথা হচ্ছে ‘নেতৃত্ব হলো মানুষের জন্য একটি পথ খুলে দেয়া, যাতে তারা কোনো অসাধারণ ঘটনা ঘটানোর ক্ষেত্রে নিজেদের অবদান রাখতে পারেন।’ যে দলের নেতাদের চিন্তাচেতনা অগ্রসরমুখী, ইতিবাচক হয়ে থাকে; নেতারা আবেগ সঞ্চারিত করে তাদের কর্মীদের ওপর চাপিয়ে দেন না বরং এই মুহূর্তের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দেন তখন দলের কর্মীদের ভেতর স্বতঃস্ফ‚র্ততা আসে। তাছাড়া এমন কৌশলের মাধ্যমে সহজাত দক্ষতাসম্পন্ন নেতারা অনুগামীদের প্রভাবিত করতে পারেন। দেশের সার্বিক পরিবেশ দলের কার্যকলাপকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে থাকে। এখন বিএনপির পক্ষে সাধারণ রাজনৈতিক কার্যক্রমই পরিচালনা করা কঠিন বটে। সেটা উপরে কিছুটা উল্লেখ করেছি। তার পরও এ কথা স্বীকার করতে হবে, দলে বহু নেতাকর্মী বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। প্রতিক‚লতা মোকাবেলার পরিবর্তে তারা এখন প্রায় নিষ্ক্রিয়।

সরকারের পূর্বসূরিরা অতীতে বিরোধী দলের প্রতি যে ধৈর্য সহ্য আর সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করতেন তা কল্পনা করা যায় না। ‘টলারেন্স’ বা সহ্য করার অনুশীলন বস্তুত গণতান্ত্রিক রাজনীতির একান্ত অপরিহার্য একটি অনুষঙ্গ। আজ তার ঘাটতি আমরা এখন লক্ষ করি। বঙ্গবন্ধুর সরকারের ‘টলারেন্স’ ছিল এক অনুপম অনুষঙ্গ। আজকে বিএনপি ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে যে আচরণ পাচ্ছে তা সবার কাছে পরিষ্কার। বঙ্গবন্ধুর আমলে তৎকালীন বিরোধীদল জাসদের পক্ষ থেকে সরকারের নীতি আদর্শের নিন্দা সমালোচনা তো ছিলই, তাদের বাহ্যিক আচরণ ছিল মারমুখী যুদ্ধংদেহী। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিরোধী দলের এমন আচরণ কোনোভাবে অনুমোদন দেয়া যায় না। এমন আচরণের পরও তৎকালীন সরকার অপরিসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে সেই কথা ভাবলে অভিভ‚ত হতে হয়। সম্ভবত সদ্য স্বাধীন দেশে নতুন গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের স্বার্থে সরকার এমন ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিল। তৎকালীন বিরোধী দল জাসদের নেতারা ও তাদের অঙ্গ ছাত্র সংগঠন সরকারের বিরুদ্ধে তো বটে এমনকি খোদ ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যে অশালীন অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ করেছেন, তা এতটা অরুচিকর যা উচ্চারণ করা লজ্জাকর। ভাবতে অবাক লাগে একটি নির্বাচিত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে সে দলের নেতারাসহ কর্মীরা হামলা চালান। সম্প্রতি সংসদে জাতীয় পার্টি এমপি কাজী ফিরোজ রশিদের একটি বক্তব্য অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে উদ্ধৃতি করছি। তিনি সংসদে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভ‚মি তৈরি করেছিল ‘জাসদ’। জাসদের সেই সব নেতারা আজ আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগী, এমনকি কেউ কেউ মন্ত্রীও ছিলেন। তৎকালীন একটি ছাত্র সংগঠনের নেত্রী পরে সরকারের প্রতিপক্ষ দলের সাথে সংশ্লিষ্ট হন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে এমন সেøাগান তুলেছিলেন যা কি না ফৌজদারি আইনে অপরাধযোগ্য ছিল। হাসি পায়, তিনিও বর্তমান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন, ‘সেলুকাস রাজনীতি কী বিচিত্র; ততোধিক বিচিত্র এই দেশ’।

একটা বিষয় এখন ভাবার সময় হয়েছে যে, গত ৫০ বছরেও কোনো ক্ষেত্রেই আমরা সুষ্ঠু ধারা সৃষ্টি করতে পারিনি এবং একই কথা প্রযোজ্য যে, ৫০ বছরেও রাজনৈতিক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যন্ত গড়ে তুলতে পারিনি। পারিনি রাজনীতির সুন্দর শৈলী রচনা করতে। কোনো দল ক্ষমতায় এসে তার ওয়াদা অঙ্গীকার সব কিছু ভুলে যায়। বিরোধিতাকে বিকল্প ভাবার মতো উদারতা দেখাতে পারিনি। সংসদীয় গণতন্ত্রের মাতৃভ‚মি ব্রিটেনে সংসদে প্রধান বিরোধী দলে ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ রয়েছে। আদৌ সেখানে পৌঁছার কোনো সদিচ্ছা কি আমাদের আছে?

বিরোধী দলের প্রতি গুরুত্বের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর যে উপলব্ধি তার একটা চিত্র তুলে ধরছি ২০১৮ সালে প্রকাশিত আনিসুল হকের রচিত ‘বিরোধী দল ছাড়া কি গণতন্ত্র হয়?’ শীর্ষক একটি জাতীয় দৈনিকের এক নিবন্ধ থেকে। ‘বিরোধী দলের গুরুত্ব সম্পর্কে লিখে গেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের পর শেখ মুজিব গিয়েছিলেন করাচিতে, দেখা করেছিলেন তখনকার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে। শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘আমি বললাম যে, আওয়ামী লীগ বিরোধী পার্টি। তাকে কাজ করতে সুযোগ দেয়া উচিত। বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না। আপনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তা আমি জানি।’
বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না, এটা বঙ্গবন্ধুর উক্তি। সারা পৃথিবীতে সবাই এটা একবাক্যে স্বীকার করেন বিরোধী দলের কাজ সরকারকে পাহারা দিয়ে রাখা। সরকারের সমালোচনা করা। ছায়া-সরকারের ভূমিকা পালন করা। শক্তিশালী বিরোধী দল গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেয়। বিরোধী দল দুর্বল হলে জনগণের কপালে দুঃখ নেমে আসে।

বিরোধী দলকে যদি মূল্যায়ন করা না হয়, তাদের গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড করতে দেয়া না হয়, তাদের সমালোচনা বিষবৎ ঠেকে। ক্ষমতাসীনরা যদি কেবল একচ্ছত্র ক্ষমতার চর্চা করে, তবে এটা মনে রাখা উচিত মানুষের প্রকৃতি দুর্বল আর সীমাবদ্ধ। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপচর্চার ঘটনা নির্ঘাত ঘটবেই। মানুষ যখন দেখে তার কাজের বাদ প্রতিবাদ করার কেউ নেই, তখন সে উদ্ধত, উন্নাসিক, আর দাম্ভিক হয়ে ওঠে, বেপরোয়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা শত ভাগ। মানুষ তার নিজের মুখ দেখতে যেমন প্রয়োজন আয়নার, সরকারের কাজের ধরন, কার্যকারিতা কতটা তা যাচাই করার একমাত্র পথ তার প্রতিপক্ষের আলোচনা সমালোচনা আর মূল্যায়ন থেকে। ‘ইফেক্টিভ’ বিরোধী, ইফেক্টিভ সরকারের পূর্বশর্ত। যে দেশে সরকার জনগণকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে পেরে সফল প্রশংসিত, তার বিরোধী দলের অবদান কিছুমাত্র খাটো করে দেখার উপায় নেই। আজ দেশে যে দুর্নীতির প্রসার, সুশাসনের ঘাটতি, আইনের শাসনে অবক্ষয়, তা প্রশাসনের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতেই হোক, তার ষোলো আনা দায় তাদেরই নিতে হবে। এর একমাত্র রিমেডি-সলিউশন জবাবদিহিতাকে জাগ্রত করতে হবে, একে দমিয়ে রাখলে দেশ অপকর্মের তলায় তলিয়ে যাবে।

বর্তমান সরকার দীর্ঘ দিন টানা ক্ষমতাসীন রয়েছে, তাদের ক্ষমতায় আসীন হওয়া এবং এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাটা যে ‘মানের’ নির্বাচনের মাধ্যমেই হোক সে কথা এখন তুলতে চাই না, কেননা দেশের মানুষের চোখ থাকতে তারা অন্ধ নয় আর স্মৃতিটাও এত খাটো নয় যে, সব ভুলে গেছে। দীর্ঘ সময় থাকার সুযোগ ঘটায় তাদের দেশের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে প্রকৃত পক্ষে একটি ‘গ্রেট অপরচ্যুনিটি’, সেই সুযোগটার যদি নির্মোহ মূল্যায়ন করা হয়, তবে যতটুকু ইতিবাচক দিক বেরিয়ে আসবে, সেই তুলনায় নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তিটা সন্দেহ নেই যে, সেটা নাতিদীর্ঘ হবে।

সামগ্রিক বিবেচনায় প্রশাসনে নেতিবাচক দিকগুলো বিবেচনায় নিলে যে উপসর্গ নিয়ে যে কথা বলতে হবে তাতে দেশে দুর্নীতির হাল হকিকতের বিষয় উল্লেখ করতে হয়। দেশের সংবাদপত্রগুলো প্রকৃতপক্ষে সমাজের দর্পণ। হেন দিন নেই যে, দেশের প্রধান দৈনিকগুলোতে নানা অনিয়ম দুর্নীতির খবর থাকে না। এসব খবরাখবর প্রমাণ করে, দেশে কী পরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছে। সেই সাথে অনিয়ম অব্যবস্থা আর বেআইনি যত কার্যকলাপ।

প্রতিদিন দেখছি, বেআইনিভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটায় ফসলি জমির মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে। লোকালয়ে, বিদ্যালয়ের পাশে গড়ে ওঠা ইটভাটার এলাকায় সীমাহীন দূষণের কবলে পড়ছে, বনখেকো আর পাহাড় খেকোরা বন উজাড় করছে, পাহাড় কেটে ফেলা হচ্ছে, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে, তাছাড়া আরো কত অনিয়ম ও বেআইনি কাজ হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে কেঁচো খুঁজতে গেলে সাপ বেরিয়ে আসবে। মানবিকতা, মানবাধিকার, নীতি নৈতিকতার যত অবক্ষয়। এসবের কোনো প্রতিকার হবে না! এভাবেই দিন যাবে?
প্রশাসনের নানা অপকর্ম, অমানবিকতাসহ নানা বিষয়ে মার্কিন শেং সানারে কথা শুনে সরমে মরে যাই একথা ভেবে যে, দেশের ভাবমর্যাদা কোথায় গিয়ে ঠেকবে? প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বশীলদের শিথিলতা, অদক্ষতা, শাসনব্যবস্থার জবাবদিহিতার ও মানবাধিকার অভাবই প্রকৃত অর্থে দেশের জন্যই দুর্দিন ঘনিয়ে আনছে। বিএনপির দুর্দিন যেমন, তেমনি দেশের দুর্দিন। বোদ্ধা সমাজকে তা গভীর চিন্তায় ফেলছে। ইতিবাচক রাজনীতি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। আর সুস্থ স্বচ্ছ নির্বাচনই ইতিবাচক রাজনীতির প্রথম সোপান।
[email protected]