- আবুল কালাম মানিক
- ১২ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:২৪
কর্তৃত্ববাদ শাসন লুটপাটের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট দেশের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক বিরোধ ও অসন্তোষকে বেগবান করছে। সামনের দিনগুলোতে জনদুর্ভোগ ও রাজনৈতিক অসন্তোষ শ্রীলঙ্কার মতো প্রচণ্ড গণবিক্ষোভে বিস্ফোরিত হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। দিন দিন নির্যাতিত-নিপীড়িত ও অভাবগ্রস্ত মানুষের সমর্থন বাড়ছে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির প্রতি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির গণসমাবেশগুলোতে বিক্ষুব্ধ মানুষের ঢল নামছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে এই গণবিক্ষোভ গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হতে পারে।
সব কিছুই নির্ভর করছে দাবি আদায়ে দলগুলোর আন্তরিক প্রচেষ্টা, নিষ্ঠা ও সদিচ্ছার ওপর। সব দল, মত ও পথের মানুষকে বিশেষ করে ইসলামী দলগুলোকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এ ক্ষেত্রে বিএনপি নেতৃত্বের দৃঢ়তা, প্রজ্ঞা, দক্ষতা ও উদারতার ওপরই নির্ভর করবে চলমান আন্দোলনের ভবিষ্যৎ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শত বাধাবিপত্তি, উসকানি ও হামলা-মামলা করেও বিএনপির বিগত চার মাসের আন্দোলনকে সহিংসতা ও সন্ত্রাসের চোরাবালিতে ঠেলে দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। সন্ত্রাস কিংবা উগ্রবাদের তকমা লাগিয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার ষড়যন্ত্রও আপাতত ব্যর্থ হয়েছে। তবে গায়েবি নাশকতার মাধ্যমে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বরাবরের মতো বল প্রয়োগ ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে বিক্ষোভ দমনের পথে অগ্রসর হলে এ দফায় তাকে ঘরে বাইরে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, সরকার ইতিহাসের এক গভীর সঙ্কটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। তারা ন্যূনতম জবাবদিহিতায়ও বিশ্বাসী নয়। ব্যাপক দলীয়করণে রাষ্ট্রের কাঠামো বা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে। অর্থনীতি আজ পুরোপুরি বিপর্যস্ত। গণতন্ত্র নির্বাসিত। সুশাসন তিরোহিত। সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের পথও রুদ্ধ হয়ে গেছে। জনগণের আস্থা ও সমর্থন ছাড়াই একটানা তিন মেয়াদে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে গিয়ে পুরো দেশকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি ভীতিকর। সরকারকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে দেশে-বিদেশে বৈধতার সঙ্কট, জনবিচ্ছিন্নতা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত চাপ। অপর দিকে বিরোধী দল ও ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে অস্তিÍত্বের সঙ্কট, বিশেষ করে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাসহ নাগরিক, মানবিক ও ভোটাধিকার সংরক্ষণের চ্যালেঞ্জ। এই দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে জন-অসন্তোষ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। দেশের আপামর জনগণ এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তির প্রহর গুনছে।
বিগত দুই দশকের রাজনৈতিক সহিংসতায় লিপ্ত হওয়ার অপবাদ ঘুচিয়ে বিএনপি তার চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনকে অনন্য গুণগতমাত্রায় উন্নীত করতে সমর্থ হয়েছে। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও দলের আট নেতাকর্মী হত্যার প্রতিবাদ, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীন সংসদ নির্বাচন দাবিতে আন্দোলন করছে দলটি। বিএনপি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে, সরকারের দাবিমতে- ‘সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি’ তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নয়। অথচ আওয়ামী লীগ অতীতের নীতি ও কৌশল কাজে লাগিয়ে শুরু থেকেই বিএনপির আন্দোলনে এমন কালিমা লেপনে সচেষ্ট রয়েছে।
বিএনপি হাই কমান্ডের সতর্কতায় আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। আন্দোলনে নবতর কর্মকৌশলের সফলতায় গত আগস্ট মাস থেকে বিএনপি গণমাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এ সময়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদগুলো বিএনপির ভাবমর্যাদা যথেষ্ট উজ্জ্বল করেছে। একই সাথে রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার সাথে জনগণের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার ইস্যুগুলোর সম্মিলন ঘটায় আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও বেড়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি ফরিদপুর ও জাতীয় পার্টির প্রধান দুর্গখ্যাত রংপুরে সমসাময়িক ইতিহাসের সর্ববৃহৎ গণসমাবেশে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিএনপি সব মহলের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। জনগণ বিএনপির আন্দোলনে নিজেদের মুক্তির পথ অন্বেষণ করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগ আবারো সংবিধানের দোহাই দিয়ে দলীয় সরকারের অধীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। দলটি একচুলও ছাড় দেয়ার নীতিতে বিশ্বাসী নয়। বিএনপির জন্য দুর্ভাগ্য কিংবা পরিতাপের বিষয় এই, ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন বর্জন করে তারা ভুল করেছিল। পরবর্তীতে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ২০১৮ সালের প্রহসনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আরো বড় ধরনের ভুল করেছে। তবে বিএনপি নেতারা এবার অতীত আন্দোলনের ভুলভ্রান্তি এবং সরকারের পাতানো ফাঁদ ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন রয়েছে। আন্দোলনকে উসকানি দিয়ে বিপথগামী করার আওয়ামী কৌশল এবার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বিএনপির নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলছে সঠিক ধারায়। চলমান আন্দোলনের ব্যাপারে দেশে ও বিদেশে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। সমাবেশে স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের ঢল দেখে বিদেশী কূটনৈতিকদের আগ্রহ ও কৌতূহল যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর দূতরা বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা সৃষ্টি না করার জন্য বারবার আহ্বান জানাচ্ছেন।
সঙ্কট নিরসনে সমঝোতার পথে না হেঁটে সরকার অতীতের মতো দমন-পীড়নের আশ্রয় গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে গায়েবি হামলায়-গায়েবি মামলার মহড়া। পাশাপাশি চলছে গণগ্রেফতার। এমনকি তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলায় তাদের কথাবার্তায়ও বেসামাল হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় বলেছেন, ‘অগ্নিসন্ত্রাস, খুন ও জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত বিএনপির লোকজনকে ধরতে হবে। তাদের ছাড় দেয়া হবে না। যারা খুন, অগ্নিসন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত, তারা অনেকেই লুকিয়ে ছিল, এখন বিএনপি মাঠে নেমেছে, তারাও মাঠে নামবে। এসব আসামিকে ধরতে হবে। তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পরপরই দেশজুড়ে মামলা দায়ের ও গ্রেফতারের ঘটনা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিএনপি হাই কমান্ড রাজনৈতিক আন্দোলনকে প্রথাগত জ্বালাও-পোড়াও সংস্কৃতির বাইরে নিয়ে এসে একটি সফল গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তাদের এই প্রয়াস এখন পর্যন্ত সঠিক পথেই এগোচ্ছে। বিএনপি নেতৃত্বের অতীতের ‘অনুজ্জ্বল’ ভাবমর্যাদা ক্রমেই আলোকিত হচ্ছে। আন্দোলনের নামে বিএনপি লাশ ফেলতে চায়- আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এমন দাবি ইতোমধ্যেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দিয়েছে দলটি। গণমাধ্যমে বিএনপির কর্মসূচির বলিষ্ঠ ও ইতিবাচক প্রচারণা এবং সব বাধাবিপত্তি ব্যর্থ করে দিয়ে সমাবেশে মানুষের উপচেপড়া ভিড় আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা আতঙ্কে ভুগছে এই ভেবে যে, বিএনপির ডাকে যেকোনো সময় মানুষ রাস্তায় নেমে আসতে পারে। চাপে পড়ে আওয়ামী লীগ এখন দল গোছাতে চেষ্টা করছে। দলটির তৃণমূলে সৃষ্টি হয়েছে দারুণ অস্বস্তি ও চাপ। অনেকের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে ভীতির সঞ্চার। তাই পাল্টা ‘মহাসমাবেশ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
ইদানীং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে এমন আভাস মিলছে, তারা যথেষ্ট মানসিক চাপে রয়েছেন। বিএনপির পূর্বঘোষিত বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে জনতার ঢল তাদের সব হিসাব-নিকাশ উলটপালট করে দিয়েছে। প্রথাগত দলীয় প্রতিনিধি সম্মেলনকে বিএনপির মোকাবেলায় গণসমাবেশে পরিণত করছে। দলের নেতাকর্মীদের মনোবল ধরে রাখতে বাধ্য হয়েই আওয়ামী লীগ এই নজিরবিহীন কাণ্ড ঘটিয়েছে। সরকারি দলের অঘোষিত কারফিউ ও পরিবহন ধর্মঘট পণ্ড করে দিয়ে প্রতিটি সমাবেশ সফল করছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। বাড়ি থেকে চিঁড়া-মুড়ি ও কম্বল হাতে দুই দিন আগে এসেই অবস্থান নিচ্ছে সমাবেশস্থলের আশপাশে। বাংলাদেশের নিকট রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতৃত্বের মতে, ‘মাজাভাঙা’ বিএনপি নেতাকর্মীদের এমন উদ্যম ও জীবন-মরণ পণ হতাশা সৃষ্টি করেছে বিরোধী শিবিরে। হামলা ও উসকানির মাধ্যমে সহিংসতা সৃষ্টির পুরনো কৌশল এবার সম্পূর্ণ অকেজো করে দিয়েছে বিএনপি। ফলে পাল্টা বড় সমাবেশ আয়োজনের মাধ্যমেই মাঠের রাজনীতি মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। তারই অংশ হিসেবে চলতি ডিসেম্বর মাসে সিরিজ কর্মসূচি পালন করবে দলটি।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, চলমান আন্দোলনে বিএনপির ত্যাগ-তিতিক্ষা জনগণকে নতুনভাবে উদ্দীপ্ত করেছে। ইতোমধ্যে গণদাবিতে রাজপথে রক্ত দিয়ে দলটি নিজেকে আন্দোলনের মাঠে চালকের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিএনপির আন্দোলন এখন দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। এ আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক রচিত হয়েছে দেশের আপামর জনসাধারণের অস্তিÍত্বের। এটি হলো বাংলাদেশের মানুষের বাঁচা-মরার লড়াই, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই, সত্যের বিরুদ্ধে মিথ্যার লড়াই, ন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্যায়ের লড়াই, জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই। বৈশিষ্ট্যগত কারণেই আন্দোলনটি জাতীয় লড়াইয়ে রূপলাভ করবে। এ আন্দোলনকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিএনপি হাই কমান্ডকে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতন অসম্ভব, তাই রাজপথেই গণদাবির ফায়সালা করতে হবে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী সব রাজনৈতিক দল ও মতের মানুষের সমন্বয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক আন্দোলন গড়ে তোলার যে প্রয়াস বিএনপি গ্রহণ করেছে তা জোরদার করতে হবে।
নির্বাচনী ফাঁদের রাজনীতির ব্যাপারে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন না করলে বিএনপি নেতৃত্বকে আবার কঠিন মাশুল গুনতে হবে। দেশী-বিদেশী খেলোয়াড়দের প্ররোচনায় ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক তীব্র আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ওয়াকওভার দিয়ে এবং ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রতযোগিতায় অংশগ্রহণ করে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে তা এবার কাজে লাগাতে হবে। ২০১৪ সালে সরকার ওয়াদা করেছিল, সহসাই অরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, কিন্তু তা রক্ষা করেনি। অনুরূপভাবে ২০১৮ সালে সত্যিকারের সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওয়াদাও ভঙ্গ করেছে। কিন্তু বিশ্ব মাতবররা উপর্যুপরি দুবার প্রহসনের নির্বাচনে গঠিত সরকারের সাথে সহযোগিতা বজায় রেখে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে অপমানিত করেছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক চালচিত্র এমন ধারণার জন্ম দিয়েছিল, এককভাবে বিএনপি মাঠের রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু দলটি সেই প্রচলিত ধারণা চুরমার করে দিয়েছে। এবারের আন্দোলন শুরুর আগে যারা বিএনপিকে অবহেলা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত তাদের অনেকেরই এখন চোখ ছানাবড়া। বিরোধী শিবিরের অনেকেই এখন আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছেন। সরকারি দলের নেতাদের হুমকি-ধমকি ও গলার স্বর নরম হতে শুরু করেছে। কূটনীতিকরা যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
বিরাজমান সঙ্কটের গভীরতা উপলব্ধি করে বিদেশী খেলোয়াড়দের ব্যাপারে বিএনপির আগের শতভাগ নির্ভরশীলতার নীতি পরিবর্তন করতে হবে। অভ্যন্তরীণ শক্তির ওপর গুরুত্বারোপ করে বিদেশীদের লুকানো অ্যাজেন্ডার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের বাঁচা-মরা বিদেশীদের অগ্রাধিকারের বিষয় নয়। তাদের ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সুযোগ দেয়া হলে জনগণের প্রত্যাশা কখনোই পূরণ হবে না।
ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী তিনটি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। উল্লিখিত সবকটি নির্বাচনই বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনকে গলাটিপে হত্যা করেছে এবং স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদকে সুদৃঢ় করেছে। বিদেশীদের প্রলোভনে মাঠের আন্দোলনের ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হলে বাংলাদেশ আবারো পথ হারাবে। ২০১৪ সালে নিয়মরক্ষার নির্বাচনের পর শিগগিরই আরেকটি নির্বাচনের আশ্বাসে প্রতারিত হয়েছিল বিএনপি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন তদানিন্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে তখন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় একাধিক বিএনপি প্রতিনিধি দল ভারত সফর করেছিল। তার সবই বিফল প্রমাণিত হয়েছে।
ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেই মনে করেন, বিএনপি নেতৃত্ব দক্ষতার সাথে এবারের আন্দোলনে জনগণের সামনে একটি সহজ সরল সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। সেই সিদ্ধান্তটি হলো স্বৈরতন্ত্রের পতন হলে দেশ বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে; অন্যথায় মুক্তির সব পথই রুদ্ধ। ফলে গণতন্ত্রকামী নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আন্দোলনে সাড়া দেবে। এই আন্দোলনকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য অপরিহার্য পূর্বশর্ত হলো- স্বেচ্ছাচারবিরোধী জাতীয় ঐকমত্যে প্রতিষ্ঠা ও যুগপৎ কিংবা বৃহত্তর জোটগত আন্দোলনের পথ রচনা করা। বিএনপিকে এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে, বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটটি কোনো দলীয় ইস্যু নয়, বরং জাতীয় সমস্যা যা তার একার পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। তাই ডান-বাম ছোট-বড় সব দলকেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে হবে। নির্যাতিত ইসলামী দলগুলোকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। অন্য দিকে ছোট দলগুলোর বড় নেতাদের এটি স্বীকৃতি দিতে হবে যে, দীর্ঘ দেড় দশকের সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ত্যাগ স্বীকার করেছে। বিএনপি এখন দেশের শীর্ষ জনপ্রিয় ও শক্তিশালী দল। সুতরাং জনতার মুক্ত চাইলে বিএনপির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবাইকে লড়তে হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক