গুলশানের একটি নৈশভোজ নিয়ে অন্তহীন আলোচনা, কৌতূহল। বিশেষ করে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক অঙ্গনে। বুধবার সন্ধ্যার নৈশভোজ নিয়ে নেট দুনিয়াও সরগরম। মানবজমিনের অনুসন্ধানে নৈশভোজটির সত্যতা মিলেছে। তবে এর উদ্দেশ্য এবং অনানুষ্ঠানিক আলোচনার বিস্তারিত তাৎক্ষণিক জানা সম্ভব হয়নি। দায়িত্বশীল সূত্র রাতে মানবজমিনকে জানায়, দেশের প্রতিষ্ঠিত বীমা কোম্পানী প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ডিরেক্টর (ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) সৈয়দ আলতাফ হোসেন ছিলেন সেই ভোজের আয়োজক। গুলশান-২ এর ১১৫ নম্বর সড়কস্থ তার নিজ বাড়িতেই ছিল আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনটি। ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের সম্মানে আয়োজিত ওই ভোজে আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকা ছিল বেশ দীর্ঘ। এতে সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা ছাড়াও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরা অংশ নিয়েছিলেন। নৈশভোজ কাম প্রাণবন্ত ওই আড্ডায় অংশ নেয়া রাজনীতি সচেতন অতিথিদের মধ্যকার অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বহুল আলোচিত ২৮ শে অক্টোবর ছিল মুখ্য আলোচ্য।
তবে সমসাময়িক রাজনীতির অন্যান্য প্রসঙ্গও স্থান পায়। একটি সূত্র জানায়, ওই দিনকে ঘিরে রাজনীতিতে কি ঘটতে চলেছে? পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকা রাজনীতিবিদদের কাছে পেয়ে তা জানা-বোঝার চেষ্টা করেছেন বিদেশি কূটনীতিকরা।
দায়িত্বশীল সূত্রে প্রাপ্ত অনুষ্ঠানের ছবি, ভিডিও চিত্র এবং ভোজে অংশগ্রহণকারী একাধিক ব্যক্তিত্বের ভাষ্য মতে, বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সৈয়দ আলতাফ হোসেনের ওই আয়োজনে সঙ্গত কারণেই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সরব উপস্থিতি ছিল। তবে সেখানে সরকারের প্রভাবশালী দু’জন মন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির (সরকার দলীয়) একজন এমপিরও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিলো। ফলে অরাজনৈতিক আয়োজনটি ক্রমেই রাজনীতির আলাপে জমজমাট হয়ে ওঠে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস যে টেবিলে বসেছিলেন তাঁর ঠিক বামের আসনে বসে আহার গ্রহণ করেন সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, আর ঠিক ডানের আসনে ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টু। প্রগতি লাইফ ইন্সুরেন্সের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকও বটে। গুরুত্বপূর্ণ অতিথি সম্বলিত ওই টেবিলে (ভূমিমন্ত্রীর পাশের আসনে বসে) আহার গ্রহণ করেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য সাবেক এমপি এম নাসের রহমান, বিএনপি নেতা সাবেক এমপি জি এম সিরাজ এবং বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট জয়নাল আবেদীনও ছিলেন পিটার হাসের টেবিলে। তবে দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ওই আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী একেএম মোজাম্মেল হক ও সরকার দলীয় সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক, ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী বিএনপি নেতা বরকত উল্লাহ বুলু, গণফোরাম (মন্টু) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য প্রগতি লাইফ ইন্সুরেন্সের ডিরেক্টর তাবিথ আউয়াল, গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলন, নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর হেলাল প্রমুখ অংশ নিয়েছিলেন।
সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৯টা অবধি চলা ওই নৈশভোজে আমন্ত্রিত বিদেশি কূটনীতিকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিঙ্গাপুর দূতাবাসের ইউসুফ এম আশরাফ, শিলা পিল্লাই, মার্কিন দূতাবাসের চিফ পলিটিক্যাল কাউন্সিলর শ্রেয়ান সি. ফিজারল্ড প্রমুখ।
অতিথি এবং অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় বিভিন্ন ব্যাংক এবং বহুজাতিক কোম্পানীর শীর্ষ কর্মকর্তারাও ছিলেন বলে জানা গেছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, নৈশভোজে আমন্ত্রিত অতিথিদের আগমনে মধ্যরাত অবধি মুখরিত ছিল গুলশান-২ এর ১১৫ নম্বর সড়কস্থ সৈয়দ আলতাফ হোসের বাড়িটি।
উল্লেখ্য, ২৮শে অক্টোবরকে ঘিরে ক’দিন ধরে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে দেশের রাজনীতি। এ উত্তাপে ঘি পড়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের জরুরি বৈঠকে। বিএনপির মহাসমাবেশকে টার্গেট করে সড়কে যানচলাচল বন্ধ বা কমিয়ে দেয়া হবে কি না? তা নিয়ে আলোচনার বিষয়ে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মার্কিন দূতাবাস। এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে মর্মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবির পর মার্কিন দূতাবাস সাফ জানিয়েছে সড়ক বন্ধ করা নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের কোনো কথা হয়নি। শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচির বিষয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। দূতাবাসের বিবৃতির পর পাল্টা বিবৃতি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাতে বলা হয়, গত রোববার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত সৌজন্য সাক্ষাতে আসন্ন নির্বাচন, বিএনপির ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ, চলমান দুর্গাপূজা, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বিষয় এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়।
আলোচনায় রাষ্ট্রদূত উল্লিখিত বিষয়ে নানা প্রশ্ন করেন এবং সরকারের অবস্থান জানতে চান। সাক্ষাতের পর মিডিয়া ব্রিফিং করেন মন্ত্রী। সেখানে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে পূর্বাপর আলোচনার মর্মার্থ এবং তথ্যের ভিত্তিতে আলোচনা-বহির্ভূতও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন মন্ত্রী। স্মরণ করা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে সড়ক বন্ধ করা হবে কি না তা জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। এ ধরনের পরিকল্পনা নেই বলে তাঁকে জানানো হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ পরিস্থিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রেখেছে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন। আগামী ২৮ শে অক্টোবর বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো মহাসমাবেশের যে ঘোষণা দিয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বিরোধী দলগুলোর সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে?
জানতে চাইলে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র বলেন, ম্যাথিউ মিলার জানান, বাংলাদেশে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি বাংলাদেশের সরকার, রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যমসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের অংশীদারদের সহিংসতা, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান তিনি।
সর্বশেষ তথ্য হচ্ছে ২৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে পূর্বঘোষিত মহাসমাবেশ সফল করতে সবরকম প্রস্তুতি রেখেছে বিএনপি। ক্ষমতাসীনদের হুঁশিয়ারি, মামলা-হামলা-ধরপাকড়সহ সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মহাসমাবেশ সফল করার কথা বলছেন দলটির নেতারা। একই দিনে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগের জনসভা এবং মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার ঘোষণা রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর। অবশ্য ২৮ শে অক্টোবর ঘিরে সজাগ রয়েছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
মানব জমিন