বাস থেকে হাজার কোটি টাকা ঘুষ-চাঁদা আদায়

বাস থেকে হাজার কোটি টাকা ঘুষ-চাঁদা আদায়.ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস থেকে বছরে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা ঘুষ ও চাঁদা আদায় করা হয়। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বাসের ফিটনেস ও অন্যান্য কাগজ হালনাগাদ করতে ৯০০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ঘুষ নেয়। মামলা থেকে বাঁচতে বাস মালিকরা হাইওয়ে এবং ট্রাফিক পুলিশকে ৮৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঘুষ দেন। রাজনৈতিক পরিচয়ে চাঁদা তোলা হয় ২৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। মালিক ও শ্রমিক সংগঠন ১২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে বাস থেকে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভার ইজারাদাররা পার্কিং ইজারার নামে ৩৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা চাঁদা তোলেন।

দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন ব্যবসায় শুদ্ধাচার’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, মালিক-শ্রমিক সংগঠন সরকারের চেয়ে ক্ষমতাধর; চলছে অনিয়ম-দুর্নীতির মহোৎসব।
এ প্রতিবেদনকে ভুয়া আখ্যা দিয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছেন আজগুবি তথ্য দেওয়া হয়েছে। পুলিশও বলছে, প্রতিবেদনটি একপেশে। তবে যাত্রী কল্যাণ সমিতির ভাষ্য, ঘুষ ও চাঁদাবাজির অঙ্ক আরও অনেক বড়।

প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি সমকালকে বলেছেন, মালিক সংগঠন নির্ধারিত চাঁদা আদায় করে। এর বাইরে অবৈধভাবে কেউ চাঁদা তুললে তা প্রতিরোধ করা হয়। অভিযোগ পাওয়ামাত্র ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও সিন্ডিকেট পরিবহন খাতকে জিম্মি করেছে। ক্ষেত্রবিশেষে এই আঁতাতের কাছে সরকারও ক্ষমতাহীন। ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন ব্যবসায় শুদ্ধাচার নিশ্চিতে ১৫ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গবেষণা পরিচালনা করেছেন টিআইবির রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মুহা. নুরুজ্জামান ফরহাদ, রিসার্চ ফেলো ফারহানা রহমান এবং মোহাম্মদ নূরে আলম। গত মে থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। জরিপ চালানো হয় ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত। জরিপে ৩২ জেলার ৭০১ বাস শ্রমিক, ১৬৮ মালিক প্রতিনিধি ও ৬৯৬ যাত্রী অংশ নিয়েছেন। পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে ৫১ বাস টার্মিনাল। মুখ্য তথ্যদাতা হিসেবে মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, পুলিশ, বিআরটিএ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, এনজিও প্রতিনিধি এবং গবেষকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।

জরিপে অংশগ্রহণকারী বাস শ্রমিকদের ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ জানান, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির এক বা একাধিক বাসের নিবন্ধনসহ কোনো না কোনো সনদের ঘাটতি আছে। ২৪ শতাংশ জানান, কোনো না কোনো বাসের ফিটনেস সনদ নেই। ২২ শতাংশ বলেছেন, বাসের রুট পারমিট নেই। ১১ দশমিক ৯ শতাংশ বাস মালিক জানান, তাদের কোম্পানিতে এক বা একাধিক লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সধারী চালক আছেন।

৮২ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, নিয়োগপত্র ছাড়াই কাজ করছেন। ৬৯ দশমিক ৩ শতাংশ জানিয়েছেন, নির্ধারিত মজুরি নেই। শিশু শ্রমিক রয়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। বাস শ্রমিকরা গড়ে দৈনিক ১১ ঘণ্টা কাজ করেন। সর্বোচ্চ ১৮ ঘণ্টাও কাজ করেন। ৬২ দশমিক ২ শতাংশ শ্রমিক দিনে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। সড়ক পরিবহন বিধিমালায় একটানা ৫ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ হলেও, ৫৯ দশমিক ১ ভাগ কোম্পানির দূরপাল্লার বাসে বিকল্প চালক নেই। চালকের বিশ্রাম প্রয়োজন হলে হেলপার দিয়ে বাস চালানো হয় বলে জানিয়েছেন ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ শ্রমিক, যদিও আইনে তা নিষিদ্ধ।
শ্রম আইন অনুযায়ী, একজন চালকের মাসে সর্বনিম্ন ২১ হাজার ৭৪৫ টাকা মজুরি নির্ধারিত থাকলেও, চালকের গড় আয় ১৭ হাজার ৬৫০ টাকা। জরিপে অংশ নেওয়া ৩৭ দমমিক ৪ শতাংশ দুর্ঘটনার পর মালিকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। তবে তা চিকিৎসা ব্যয়ের মাত্র ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।

৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ বাসের গতি ডিভাইসের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ হয়। জরিপে নগর পরিবহনের বাসের ৮৯ দশমিক ২ এবং আন্তঃজেলার ৬০ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, তাদের কোম্পানির বাসে নিয়ম অনুযায়ী টায়ার, ইঞ্জিন অয়েল, ব্রেক পরিবর্তন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। ৪০ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির গাড়িতে নকশা পরিবর্তন করে অতিরিক্ত আসন সংযোজন করা হয়েছে। সিটি সার্ভিসের ৪২ দশমিক ৫ এবং দূরপাল্লার ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়।

জরিপে মালিকরা জানিয়েছেন, বাসের নিবন্ধনে ১৪ দিন পর্যন্ত সময় লাগার কথা। লাগে গড়ে ৩০ দিন। ৪১ দশমিক ৯ শতাংশ বাসের নিবন্ধন পেতে ঘুষ দিতে হয়েছে। বাসপ্রতি গড়ে ১২ হাজার ২৭২ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। ফিটনেস নবায়নে গড়ে ৭ হাজার ৬৩৫ এবং রুট পারমিট নবায়নে ৫ হাজার ৯৯৯ টাকা ঘুষ দিতে হয় বাসপ্রতি। তবে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেছেন, গবেষণার নামে আজগুবি তথ্য দেওয়া হয়েছে। বিআরটিএর কে কোথায় ঘুষ নিয়েছে, প্রমাণ দিতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিআরটিএ ব্যর্থ হয়েছে, যাত্রী সেবার ব্যর্থতা ঢাকতে লোকবল সংকটকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। বিআরটিএর অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ লেনদেনের সবই চলছে যোগসাজশের মাধ্যমে।

২৮ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমিক জানান, গত ছয় মাসে ট্রাফিক বা হাইওয়ে পুলিশ এক বা একাধিক মামলা দিয়েছে। মামলা ও রিকুইজিশন এড়াতে ঘুষ দেওয়ার তথ্য জানিয়েছেন ২৯ শতাংশ শ্রমিক। দূরপাল্লার বাসে গড়ে মাসে ১ হাজার ১৯ টাকা, আন্তঃজেলায় ১ হাজার ১৩৩ টাকা এবং সিটি সার্ভিসে ৫ হাজার ৬৫৬ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।
তবে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মাসুদুর রহমান সমকালকে বলেছেন, টিআইবি সারাজীবন একপেশে প্রতিবেদন দেয়। যে শ্রমিকদের কথা বলা হচ্ছে, তারা কোন ইউনিয়নের? পুলিশের নিজস্ব নজরদারি রয়েছে। একটিও ঘুষ, চাঁদাবাজির ঘটনা নেই। পুলিশের গায়ে ক্যামেরা এবং সিসি ক্যামেরা রয়েছে মহাসড়কে। ঘুষ নিলে তা ক্যামেরায় থাকত। টিআইবি সেকেন্ডারি তথ্য নিয়ে গবেষণা করে, যা বিজ্ঞানসম্মত নয়।

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনিয়ম-দুর্নীতির কেন্দ্রে রয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সমর্থনপুষ্টদের দ্বারা পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের বিষয়। জরিপে অংশগ্রহণকারী ২২ কোম্পানির ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ বাসের মালিকানা রয়েছে। তাদের ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে। মালিক ও শ্রমিক সংগঠনে তাদের একচেটিয়া ক্ষমতা চর্চার পাশাপাশি আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা তৈরির মাধ্যমে পরিবহন খাতকে জিম্মি করে রেখেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মালিকরা রুট নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করেন। এ কারণে বাস ব্যবসায় প্রতিযোগিতার পরিবেশ নেই। মালিক সমিতির আয়ের উৎস এককালীন চাঁদা ও ট্রিপ প্রতি ফি আদায়। তবে সমিতির মহাসচিব সমকালকে বলেছেন, রাজনৈতিক পরিচয়ে চাঁদাবাজির সুযোগ নেই। কিছু অনিয়ম, অবৈধভাবে চাঁদা আদায়ের ঘটনা রয়েছে। সরকার এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে মালিক সমিতি সহযোগিতা করবে।

বাস পরিচালনায় অনিয়ম-দুর্নীতির মূলে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও সিন্ডিকেটের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশের মালিক ও পরিচালনা পর্ষদে থাকা ব্যক্তিদের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। ৮০ শতাংশ ক্ষমতাসীন দল ও ১২ শতাংশ অন্যান্য দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাস পরিবহন ব্যবসায় বিভিন্ন আঙ্গিকে চাঁদাবাজি ও অবৈধ লেনদেন হয়। সিটি করপোরেশন, হাইওয়ে পুলিশ, মালিক-শ্রমিক সংগঠনের যোগসাজশ রয়েছে। তবে অভিযোগের বিষয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বক্তব্য জানা যায়নি।
সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী সমকালকে বলেছেন, চাঁদাবাজির অভিযোগ সরকারকে জানানো হয়েছে। তবে এর সঙ্গে শ্রমিক সংগঠনের সম্পর্ক নেই। ফেডারেশন ঢাকার চারটি টার্মিনাল থেকে বাসপ্রতি দিনে ১০ টাকা চাঁদা নেয়। শ্রমিক ইউনিয়ন ৩০ এবং স্থানীয় শ্রমিক কমিটি ১০ টাকা নেয়। সারাদেশে ১৩ হাজার বাস থেকে বছরে ১৩ কোটি টাকা আদায় সম্ভব নয়। বিআরটিএ নিবন্ধিত ৮০ হাজার বাস-মিনিবাস ধরে হিসাব করে, যা বাস্তবসম্মত নয়। এত বাস সড়কে নেই।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সমকালকে বলেন, বাস ব্যবসায় ঘুষ ও চাঁদাবাজির সামান্য অংশই এসেছে টিআইবির গবেষণায়। দেশের নিবন্ধিত বাস ৮০ হাজার। সচল আছে ৫০ হাজারের বেশি। বছরে অন্তত ৪-৫ হাজার কোটি টাকা চাঁদা ও ঘুষ আদায় হয়।

জরিপে অংশ নেওয়া ২২ দশমিক ২ শতাংশ বাস শ্রমিক জানান, নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে চালক গাড়ি চালান, চালকের সহকারী ও সুপারভাইজার বাসে দায়িত্ব পালন করেন। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, অতিরিক্ত আসন সংযোজন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কথা জানিয়েছেন জরিপে অংশগ্রহণকারীরা।

৩৫ দশমিক ২ শতাংশ যাত্রী জানিয়েছেন, যাত্রাপথে কোনো না কোনো সময় নারী যাত্রীকে যৌন হয়রানির শিকার হতে দেখেছেন। আন্তঃজেলার বাসে এই হার ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ। শহরের অভ্যন্তরে লোকাল বাসে এই হার ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ। ৮৩ দশমিক ২ শতাংশ যৌন হয়রানি সহযাত্রী এবং ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ হেলপারের দ্বারা হয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ৯২ দশমিক ৯ শতাংশ যাত্রী অভিযোগ করেননি।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।

সমকাল