বাম ছাত্রসংগঠন: বোধোদয় আর হলো না
ডাকসু নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হয়েছে, সে প্রশ্নে না গিয়েও সমাজের একটি প্রবণতা চিহ্নিত করা যায়, তা হলো, যে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো এত দিন নিজেদের ছাত্রসমাজের একমাত্র প্রতিনিধি মনে করত, তাদের ভরাডুবি হয়েছে এবং অরাজনৈতিক স্বতন্ত্র সংগঠনের শিক্ষার্থীদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। ১৮টি হল সংসদ নির্বাচনে ১২টিতে ভিপি পদে ছাত্রলীগ জয়ী হলেও বাকি ছয়টি হলে ভিপি পদে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এখানেও ছাত্রলীগের বাইরে প্রথাগত ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রার্থীরা পিছিয়ে রয়েছেন। বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রার্থীরা দ্বিতীয় স্থানেও নেই।
বামপন্থীদের একমাত্র প্রাপ্তি হলো কবি সুফিয়া কামাল হল সংসদের সদস্যপদে ছাত্র ফেডারেশনের লামইয়া তানজিন তানহা এবং বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল সংসদে সদস্যপদে ছাত্র ইউনিয়নের ফারজানা আক্তার মীমের বিজয়ী হওয়া। ব্যাপারটা হলো, নির্বাচন পুরোপুরি অবাধ ও সুষ্ঠু হলে ছাত্রলীগ/ছাত্রদল বা এরা কটি আসন পেত, বলা মুশকিল। কিন্তু এই ফলাফল যে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর বাস্তবতা প্রতিফলিত করছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই বললেই চলে।
অথচ একসময় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর কী জনপ্রিয়তাই না ছিল! অন্যান্য ক্ষেত্রে বামপন্থীদের তেমন শক্তি না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের ছাত্র সংসদে তাদের দাপট ছিল। পাকিস্তান আমলে মেধাবী ছাত্ররা বাম ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হতেন। এমনকি ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার এরশাদ পতনের আন্দোলনেও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর উজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পরবর্তীকালে কী এমন হলো যে তাদের এখন খুঁজে পাওয়া ভার।
১৯৯০-পরবর্তী যুগকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণের মাধ্যমে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপক সুযোগ তৈরি হয়। তাই দেখা যায়, ১৯৮০-এর দশকের অনেক নামজাদা ছাত্রনেতাও পরবর্তী সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি অনেক ছাত্রনেতার নৈতিক স্খলনের কথাও শোনা যেতে থাকে। পাশাপাশি মানুষের চিন্তা-চেতনাতেও বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। আগের মতো রাজনীতি নিয়ে মশগুল থাকার চেয়ে মানুষ নিজের ও পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জোর দেন। আর্থসামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে যদি বাম ছাত্ররাজনীতির দুরবস্থা চিহ্নিত করতে হয়, তাহলে বলতে হয়, তারা ঠিক এখানেই পিছিয়ে পড়ে।
যা হোক, ডাকসু নির্বাচনের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। প্রথমত, বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো একজোট হতে না পারা। তবে একজোট হলেই যে অনেক কিছু হয়ে যেত, তা-ও হয়তো নয়। এই বিভক্তি অবশ্য তারা উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করছে। দ্বিতীয়ত, দেশের উদীয়মান মধ্যবিত্ত ও তার আকাঙ্ক্ষার প্রতি নির্লিপ্ততা। তৃতীয়ত, বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো মূল দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সব সময়ই ব্যতিব্যস্ত থাকে যে তাদের পক্ষে এখন আর ছাত্র আন্দোলন সংঘটিত করা কঠিন। বামপন্থী দলগুলোর কৃষক-শ্রমিক বা পেশাজীবী সংগঠন এখন একপ্রকার নেই বললেই চলে, তাই হারাধনের শেষ ছেলেটি হলো এই ছাত্রসংগঠন।এই বামপন্থী দল ও ছাত্রসংগঠনগুলো এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে গেছে। মূল দলের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে করতে এবং কাল্পনিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে দেখতে তারা এখন আর সমাজের নাড়ি টের পায় না। এদের অনেকেই আবার ধ্রুপদি সংগীতের/শিল্পের ভক্ত। ধ্রুপদি সংগীত প্রীতি থাকাটা নিশ্চয়ই খারাপ কিছু নয়, কিন্তু তা যদি বাস্তবতা থেকে পালানোর মাধ্যম হয়, তাহলে বিপদ। আবার কেউ কেউ নানা রকম ছোটখাটো সুবিধা নিতে ব্যস্ত বলে শোনা যায়।
কোটার দাবিতে আন্দোলন পাঁচ/ছয় বছর আগে শুরু হলেও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো তাতে অংশ নিয়েছে অনেক পরে। কোটা নিয়ে যে অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছে, তা বুঝতে না পারাটা বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। তারা হয়তো মনে করেছে, বামপন্থীরা এসব চাকরির আন্দোলন কেন করবে! তারা একবারে বিপ্লবই করবে।
মোদ্দাকথা হলো, সমাজে নতুন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই শ্রেণির ছাত্ররাই অধিক সংখ্যায় পড়তে আসছেন। তাঁরা নতুন ও সচ্ছল জীবন আকাঙ্ক্ষা করেন। এখন এই ছাত্রদের বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়ে বা তাঁদের কাছে সরকারের শ্রেণি চরিত্র বিশ্লেষণ করে বিশেষ ফায়দা যে হবে না, তা এই নির্বাচনের ফলাফলেই পরিষ্কার। এই ছাত্ররা উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব নিয়ে চিন্তিত। তাঁদের মাথাব্যথা কোটা নিয়ে, কারণ সরকারি চাকরিতে কোটার আধিক্য থাকলে তাঁরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বেন। তাঁরা কেবল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ছেন, তা নয়। তাঁরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ছেন। এঁদের সবাই যে সচ্ছল পরিবারের, তা নয়। বরং অনেকেই কষ্টেসৃষ্টে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। সে জন্য তারা ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন করেন। এঁরা হয়তো অনেক বেশি চিন্তিত তাঁদের জন্য অভিভাবকদের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এরাই এখন সমাজের চালিকাশক্তি। তাঁদের না বুঝলে রাজনীতি করতে যাওয়াটাই বৃথা।
ক্ষমতার দাপট দেখানো রাজনীতি করা বামপন্থীদের পক্ষে সম্ভব নয়। তা আমাদের কাঙ্ক্ষিতও নয়। কিন্তু ছাত্রদের বাস্তবজীবনের সমস্যা যদি তাঁদের আন্দোলনের বিষয়বস্তু না হয়, তাহলে যা হওয়ার কথা ছিল তা-ই হলো। তবে তাঁরা যে আন্দোলন করেন না, তা নয়। ফি বৃদ্ধি, সন্ধ্যাকালীন কোর্স বাতিল, যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন—এসব ক্ষেত্রে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। যদিও তাদের অনেক তৎপরতার রাজনৈতিক অভিপ্রায় নিয়ে ছাত্রসমাজের মনে নানা প্রশ্ন আছে। মূল কথা হলো, ছাত্রসমাজের মূল সমস্যায় নজর না দিলে তাদের আস্থা অর্জন করা যায় না। সে জন্য ছাত্ররা নিজেরাই পথ দেখে নিতে শুরু করেছেন।
আর্থসামাজিক বাস্তবতা বদলে গেছে। এখন ছাত্রদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পড়া শেষের বেকারত্ব। অন্যদিকে সমাজের ক্রমবর্ধমান অসমতা সবাইকে চোখ রাঙাচ্ছে। তাই বামপন্থী রাজনীতির অভিমুখ সেদিকে ঘুরে যাওয়া উচিত।
প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক