শীর্ষ নেতৃত্বের উপস্থিতিতে বাদানুবাদ এড়াতে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে এর অর্থ এই নয় যে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে স্বজনদের প্রার্থী করার বিষয়ে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। বরং সময় নিয়ে, ‘কেস টু কেস’, অর্থাৎ প্রার্থী হওয়া স্বজনদের প্রত্যেকের বিষয় পৃথকভাবে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে ক্ষমতাসীন দলটি।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এই ধারণা পাওয়া গেছে। অন্যদিকে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটায় সংসদ ভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে দলের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা থাকবেন। ওই বৈঠকে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের কড়া বার্তা দিতে পারেন বলে দলটির নেতারা জানিয়েছেন। এ ছাড়া যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, এমন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের দলীয় নির্দেশনা অমান্য করার বিষয়টি ব্যক্তিগতভঅবে স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী।
গত বুধবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যেসব মন্ত্রী-সংসদ সদস্য তাঁদের স্বজনদের ভোটের মাঠে নামিয়েছেন, ওই বৈঠকে তাঁদের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে বলে জোরালো আলোচনা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলীয় প্রধান বিষয়টি নিয়ে কথা বলেননি। অন্য নেতারাও তা তোলেননি।
গত ১৮ এপ্রিল মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে নির্দেশনা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু প্রায় সবাই দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটের মাঠে আছেন।
আওয়ামী লীগের হিসাবে, প্রথম পর্বের উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের ৫০ জনের মতো স্বজন প্রার্থী আছেন। দ্বিতীয় ধাপের ভোটের মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল বুধবার। প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যমতে, এই ধাপে ৩ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও ১১ জন সংসদ সদস্যের স্বজন ভোটে আছেন। তবে আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, দল বিচার-বিশ্লেষণ করছে। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যের জন্য শাস্তি হবেই। কখন হবে, সেটা দলই ঠিক করবে।
‘আশঙ্কা ছিল বাদানুবাদের’
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ১৮ এপ্রিলের পর থেকেই মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান, পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের ভোট থেকে সরাতে কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকেরা ফোনে কথা বলেছেন। তাঁদের কাউকে কাউকে ডেকে নিয়েও নেতারা কথা বলেছেন। কিন্তু বারবার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁরা। এ জন্য অনেক কেন্দ্রীয় নেতা অভিযুক্ত মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের ওপর ক্ষুব্ধ। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অভিযুক্ত মন্ত্রী-সংসদ সদস্যও রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আলোচনার সূত্রপাত হলে বাদানুবাদ হওয়ার আশঙ্কা ছিল। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হোক, তা চাননি নীতিনির্ধারকেরা। এ জন্যই বৈঠকের আগেই বিষয়টি উত্থাপন না করার বার্তা দেওয়া হয়েছে দায়িত্বশীল জায়গা থেকে।
নিজের ছেলেকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করে দলের নেতাদের তোপের মুখে পড়েছেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান। এর মধ্যে ২৩ এপ্রিল বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সময় তিনি একধরনের তর্কবিতর্কে জড়ান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে।
‘সময়মতো ব্যবস্থা’
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির চার-পাঁচজন নেতার ঘনিষ্ঠ স্বজন দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী রয়েছেন। তাঁদের প্রতিপক্ষও কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন। ফলে আঞ্চলিক ও গোষ্ঠীগত রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে সুযোগ পেলে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করবেন তাঁরা। এ জন্যই হয়তো বিতর্ক এড়াতে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বিষয়টি প্রকাশ্যে ফোরামে তুলতে চাননি। ওই নেতা আরও বলেন, তবে এর ফলে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করা মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা পার পেয়ে গেছেন, এমনটা মনে হয় ঠিক নয়। সময়মতো ঠিকই কোনো না কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বুধবার রাতে নির্বাহী কমিটির বৈঠক শেষে বেরিয়ে গণভবনের গেটে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি সেটা বলব না, পরিস্থিতি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। আমি আপনাদের বরাবর একই কথা বলেছি যে সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ৩০ তারিখে কোনো সিদ্ধান্ত আসবে, তা কিন্তু আমি বলিনি। এখনো একই কথা বলব, সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন আমরা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’
তবে আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশনাটি মূলত কিছু ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে নেওয়া হয়েছিল। কারণ, তাঁরা নিজের সন্তান, পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের প্রার্থী করে তৃণমূলে অসন্তোষ তৈরি করেছেন। পুরো নির্বাচনী এলাকা পরিবারের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় আছেন। এটা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব পছন্দ করেননি। কিন্তু স্বজনদের ভোটের মাঠে রাখার মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের অনড় অবস্থান বিষয়টিকে জটিল করে দিয়েছে।
একজন দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতা নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের তাঁদের অবস্থান থেকে সরিয়ে আনা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আবার শাস্তি দেওয়া না হলে দলের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে। তবে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনের মধ্যে যাঁরা আগেরবার নির্বাচন করে জয়ী হয়ে এবারও ভোট করছেন, তাঁদের বিষয়ে নমনীয় থাকবে দল। মন্ত্রী-সংসদ সদস্য যাঁরা প্রথমবারের মতো নিকটাত্মীয়দের ভোটে নামিয়েছেন, তাঁদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার বিষয়টি এখনো বিবেচনা করছে আওয়ামী লীগ।
prothom alo