বাকশালের সাংস্কৃতিক রূপ এবং ‘জাফর-ইবনে-বান্দর’ গং

 আমার দেশ
২৫ জানুয়ারী ২০২৩

মিনার রশিদ

মিনার রশিদ

মিনার রশিদ

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করলেও সেই স্বাধীনতা হোঁচট খায় ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি! বাকশাল কায়েমের পর তাজউদ্দীন বলেছিলেন, মুজিব ভাই, “এই পদক্ষেপের ফলে আপনি শুধু নিজে মরবেন না। আমাদেরকেও সাথে নিয়ে মরবেন। “তাঁর এই ভবিষ্যৎ বাণীটি শুধু অক্ষরে অক্ষরেই ফলে নাই- এর মাধ্যমে মুক্তির একটা রাস্তাও তৈরি হয়েছিল, যদিও তা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক! যাকে তাজউদ্দীন আহমদ অত্যাবশ্যক হিসাবে ঠাহর করেছিলেন! সব কিছু দেখে মনে হয় ইতিহাসের এই মহানায়ক একটি ট্র্যাপে পড়ে হয়তোবা এই কাজটি করেছিলেন। বাকশালের মূল মন্ত্রণাদাতাদের পুরো পরিকল্পনা বা রোডম্যাপটি হয়তো তাঁর কাছে স্পষ্ট ছিল না।

এদেশের মানুষের পরম আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতন্ত্রের জন্য। ভয়াবহ একটা যুদ্ধে জড়িয়েছিল মূলত একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে! সেই যুদ্ধে আমাদেরকে যারা সহায়তা করেছিল তাদের মতলব ছিল ভিন্ন। ফলে শুরু হয় এই দেশ ও জাতিকে নিয়ে নতুন খেলা।বাকশালের রাজনৈতিক শাখার সাথে সাথে খোলা হয় সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শাখা।

বাকশালের রাজনৈতিক রূপটি যতটুকু দানবীয় প্রতীয়মান হয়েছে এর সাংস্কৃতিক রূপটি ততটুকুই মোহনীয় বা আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা হয়েছে। জাতীয় আবেগ অনুভূতি এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে অত্যন্ত কৌশলে এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে যে মুক্তিযুদ্ধ জাতিকে মুক্ত করার কথা তা আরও অদৃশ্য শেকলে জাতিকে বেঁধে ফেলেছে।

তখন কাকের মত আমরা নিজের (গণতন্ত্রের) ছানা ভেবে কোকিল (বাকশাল) ছানাকে লালন করেছি। বাকশালের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কোকিলেরা নিজের বাচ্চাকে অন্যের বাসায় বড় করেছে! কাকের মতই বোকা হিসাবে কাজ করেছে এদেশে বাকশাল বিরোধী গণতন্ত্রমনা দলগুলি!

বাকশালের এই সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বাচ্চা- কাচ্চাগুলি এদেশে নানা সময়ে নানা রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করে আমাদের মুখে তুলে দিয়েছে। মতাদর্শিক নৈকট্যের কারণে হিন্দুত্ববাদের সাথে সহজেই মিশে গেছে! ছায়ানট, উদীচী এসব সংগঠনগুলি বাকশালের সবচেয়ে মজবুত ও কৌশলগত ঘাঁটি হিসাবে কাজ করেছে! সংস্কৃতি বলতে এরা কিছু গান-বাজনা ও বিনোদন কর্মকাণ্ড বুঝিয়েছে এবং এসংক্রান্ত একটা হীনমন্যতা আমাদের মাঝে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফলে উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজেদেরকে সংস্কৃতিবান প্রতিপন্ন করতে গিয়ে এদের খপ্পরে পড়েছে। এই সুযোগে মগজ ধোলাইয়ের কাজটি করে নিয়েছে।

আমাদের সার্বিক অসচেতনতা ও হীনমন্যতার কারণে এই বুদ্ধিবৃত্তিক পালোয়ানরা গত অর্ধ শতাব্দী ধরে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছে! জাতীয়তাবাদী বলয় থেকেও এদের মুখোমুখি না হয়ে এক ধরনের বোঝা পড়ার মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করা হয়েছে।

এই কাজে এদের অস্ত্র ছিল স্বাধীনতার চেতনা নামক মেওয়াটি। বুদ্ধিবৃত্তিক এই পালোয়ানদের সবাই ভয় করতেন। কারণ এই গ্রুপকে নাখোশ করলে সুশীল বুদ্ধিজীবী হিসাবে নিজের অবস্থান ধরে রাখা তো দূরের কথা- মগজে সামান্য বুদ্ধি অবশিষ্ট আছে কি না তা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিত।

ক্ষমতায় থাকুক আর বাইরে থাকুক, বাকশালের এই সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়টি জাতীয় মানস ও চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করেছে! কাজেই বলা যায় রাজনৈতিক বাকশালের প্রথম প্রচেষ্টা বাহ্যত ব্যর্থ হলেও সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বাকশাল কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ভালোভাবেই অর্জন করেছে। এরা আমাদের চিন্তার জগতে এতটুকু নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলে যে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, বাঘা বাঘা জাতীয়তাবাদী নেতার বাসায় বা অফিসে কোন দৈনিক পত্রিকাটি রাখা হবে সেটাও এরা ঠিক করে দিতে পারতেন! এদের হাতে এত সংখ্যক পত্রিকা ছিল যে দুয়েকটাকে দলীয় মুখপাত্র হিসাবে পরিচিত করিয়েও অনেকগুলোকে নিরপেক্ষ ও অগ্রসর মানুষের কাগজ হিসাবে তুলে ধরত। মতলববাজি নিরপেক্ষতার নামে এরা সমাজকে যতটুকু ডিপলিটিসাইজ করেছে- সেই মেওয়াটুকুও এরা সেই একই বাকশালকে খাইয়েছে! এরা যে রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করে দিতেন তা অতি সহজেই ছড়িয়ে পড়ত।

এরা সবচেয়ে সফল হয়েছে তথাকথিত এক-এগারোর প্রেক্ষাপট তৈরিতে। মূলত: এক-এগারো মাধ্যমেই বাকশালের পুনর্জন্ম হয়ে গেছে। আর এক- এগারোর প্রেক্ষাপট তৈরির পেছনে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বাকশালের দীর্ঘ সময়ের নিরলস প্রচেষ্টা আজ একটু পেছনে তাকালেই স্পষ্ট দেখা যায়। দুজন পত্রিকা সম্পাদক তো প্রকাশ্যেই জানিয়েছিলেন যে এক-এগারো তাদেরই ব্রেইন-চাইল্ড। এরা সবাই বৃহত্তর বাকশাল পরিবারের সদস্য।

২০১১ সালের ৩০শে জুলাই লন্ডনের বিখ্যাত সাময়িকী দা ইকোনমিস্ট বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া সম্পর্ককে “Embraceable You” শিরোনাম দিয়ে একটি আর্টিকেল ছাপিয়েছিল! Embraceable you একটি রোমান্টিক গান। একই টাইটেল দিয়ে একটি রোমান্টিক সিনেমাও তৈরি করা হয়েছিল। কাজেই এখানে ইঙ্গিতটি সহজেই বোধগম্য। সেই আর্টিকেলটির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ছিল নিম্নরূপ :
“ Ever since 2008, when the Awami League, helped by bags of Indian cash and advice, triumphed in general elections in Bangladesh, relations with India have blossomed. To Indian delight, Bangladesh has cracked down on extremists with ties to Pakistan or India’s home-grown terrorist group, the Indian Mujahideen, as well as on vociferous Islamist (and anti-Indian) politicians in the country. India feels that bit safer.”

আসলে এই টাকা এবং উপদেশের থলির বড় অংশ গিয়েছে ইলেক্ট্রনিক এবং প্রিন্টিং মিডিয়ায়। এটা শুধু এক এগারোর আগে আগে নয়। স্বাধীনতার পর পর কিংবা তারও আগে থেকেই Embraceable তৈরির এই প্রজেক্টটি শুরু হয়েছিল।

এদের মূল কাজ ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যমে একক জাতিসত্তার চমৎকার রাষ্ট্রটিকে স্থায়ীভাবে বিভক্ত করা। দেখা যায়, ১৯৭১ সালে যে টগবগে তরুণ যুদ্ধে না গিয়ে গর্তে বসবাস করেছিলেন, সেই বৃদ্ধ এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষক হিসাবে ঘৃণাযুদ্ধের বিরাট বড় সিপাহসালার সেজে বসেছেন। উনি নির্বাচনের আগের রাতে ঘুমিয়ে পরের দিন সকালে যদি দেখেন, যে দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছে এবং যে দল পরাজিত হয়েছে উভয়ই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি- তাতেই তিনি খুশি। রাতের বেলায় ব্যালট বাক্স নিয়ে কী হয়েছে , সেটা নিয়ে প্রশ্ন করবেন না! দেখুন, কী ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট ভাবনা এরা নিজেদের অন্তরে গেঁথে রেখে পুরো সমাজকে কলুষিত করেছে! একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে এরাই মূল প্রতিবন্ধক!

আমাদের সেনাবাহিনীতে যেমন করে একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রজেক্টের আওতায় এরশাদ, নাসিম এবং মইন ইউ আহমেদদের তৈরি করেছে, তেমনি এদেশের মিডিয়া জগতকে নিয়ন্ত্রণের বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহন করে। আমরা জানি আমাদের পাশের দেশের কলকাতায় সংবাদ পত্রের পাঠকের সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে সবসময় বেশি ছিল! তারপরেও কলকাতায় যে সময় দুয়েকটি সাদামাটা দৈনিক কাগজ ছাপা হত সেই সময়ে ঢাকায় রং-বেরংয়ের জৌলুসপূর্ণ অনেকগুলি পত্রিকা বের হওয়া শুরু করে। বিশেষ করে নব্বই সালের শেষদিকে এবং ২০০০ এর শুরুর দিকে!

এগুলি সব ছিল ইনভেস্টমেন্ট। সেই ইনভেস্টমেন্ট এখন হাজারগুণ লাভে তুলে নিচ্ছে! এক কোটি রেমিট্যান্সযোদ্ধা যে ডলার দেশে পাঠায় তার বড় অংশ কয়েক লাখ ইন্ডিয়ান বিনা ভিসায় চাকুরি করে তা নিয়ে যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রগুলি থেকে প্রাপ্ত লাভ যোগ করলে তা কত বিলিয়ন ডলার হবে তা ক্যালকুলেটর দিয়েও গণনা করে শেষ করা যাবে না। আবার নিজের মুখ দিয়ে একথা স্বীকারও করেছেন, ইন্ডিয়াকে যা দিয়েছি তা কোনোদিন ভুলতে পারবে না!

নিজ দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে এদের অপকর্মের সংখ্যা এবং তার মাত্রা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে , একজন মানুষের বাচ্চার পক্ষে আদৌ কি এগুলি করা সম্ভব? এর জবাব এরা নিজেরাই দিয়েছেন। এদের বিশ্বাস, মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত হিসাবে আদম-হাওয়ার মাধ্যমে এই পৃথিবীতে আসে নাই- বরং বানর থেকে পরিবর্তিত হয়ে মানুষ হয়েছে!

পুরো মানবজাতি বান্দর থেকে সৃষ্টি না হলেও এদের কয়েকজনের পূর্বপুরুষ যে বান্দর ছিল তাতে একবিন্দু সন্দেহ নাই। এদেরকে জাফর ইবনে বান্দর, দিপুমনি বিনতে বান্দরি এরকম করে ডাকা সমীচীন হবে।

মানুষের বাচ্চাদের ন্যূনতম দেশপ্রেম থাকে, বান্দরের বাচ্চাদের তা থাকে না! দেশের ক্ষতি দেখলে মানুষের বাচ্চাদের অন্তর কেঁপে ওঠে- বান্দর-বান্দরির বাচ্চাদের তা হয় না।

লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী