ভারতে সুলতানি শাসনামলে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হত। ভারতের সুলতানদের পর এই ধারাবাহিকতা মোগল শাসনামলের প্রথমদিক পর্যন্ত বজায় ছিল। সেটার সমর্থন পাওয়া যায়, সম্রাট আকবরের সভাসদ এবং ঐতিহাসিক আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’তেও।
এতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘আগে মোগল সম্রাটরা রাজ্য পরিচালনায় ও রাজস্ব আদায়ে হিজরি সন ব্যবহার করতেন।’
পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন সালের প্রচলন তো ছিলই। ফলে কোনো সালই সেভাবে সার্বিক স্বীকৃতি পায়নি। স্বাভাবিকভাবেই সালের এই সব ভিন্নতা প্রজাদের জন্য বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে ছিল।
মূল হিজরি পঞ্জিকা চান্দ্রমাসের ওপর নির্ভরশীল। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরর চেয়ে ১১ থেকে ১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন।
একারণে চান্দ্র বছরে ঋতুগুলো ঠিক থাকে না। আর চাষাবাদ ও এই ধরনের অনেক কাজ ঋতুনির্ভর।
ফসল ঘরে উঠলেই তো প্রজারা কর দিতে পারবে। স্বভাবতই শাহি লেনদেন এবং প্রজা-সাধারণের সুবিধার্থে একটি সৌর সাল প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন মোগল সম্রাট আকবর।
দিন তারিখ গণনার সময়োপযোগী ও গ্রহণযোগ্য বর্ষপঞ্জি সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আর এজন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে।
১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (১৫৫৬) থেকে। আর এজন্যই বঙ্গাব্দের সঙ্গে খ্রিস্টাব্দের পার্থক্য (১৫৫৬-৯৬৩ বঙ্গাব্দ)।
প্রথমদিকে এই সালের নাম ছিল ‘তারিখ-ই-এলাহি’। এই মোগলাই সালের মাসের নামগুলো স্বাভাবিকভাবেই প্রচলিত ছিল ফার্সি ভাষায়। যথা- কারোয়ার দিন, উর্দি বাহিশ, খোরদাদ, তীর, মুরদাদ, শাহরিবার, মেহের, আযান, আজার, দে, বাহমান ও ইস্কান্দার মিজ।
পরে ‘তারিখ-ই-এলাহি’ পরিচিত পায় ‘ফসলি সাল’, ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা বর্ষ’ নামেও। সম্রাট আকবরের আমলে প্রতি মাসের ৩০/৩১ দিন প্রতিটি দিনের আলাদা নাম ছিল। এতসব দিনের নাম সাধারণ মানুষের মনে রাখা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। সম্রাট আকবরের পৌত্র সম্রাট শাহজাহান পুনরায় বঙ্গাব্দ সংস্কার করেন।
ধারণা করা হয়, কোনো এক পর্তুগিজ জ্যোতির্বিদের সহায়তায় পশ্চিমের পঞ্জিকা অনুসরণে সম্রাট শাহজাহান মাসের ৩০/৩১ নাম বিলুপ্ত করে ৭ দিনে এক সপ্তাহ এবং ৭ দিনের নাম রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবারের প্রচলন করেন।
বঙ্গাব্দ বা ফসলি সাল প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তখন প্রচলিত স্থানীয় চান্দ্রমাসগুলোকেও সৌরমাসে পরিণত করা হয়। ফলে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ প্রভৃতি নামও বঙ্গাব্দের বিভিন্ন মাসের নামরূপে গৃহীত হয়। তবে সেটা স্থানীয়দের সুবিধার জন্য।
তবে খাতাপত্রে স্থান পেতো ‘তারিখ-ই-এলাহি’ সালের ফার্সি ভাষার মাসগুলোই।
আকবরের বাংলা সাল প্রবর্তনের পর হয়ত কৃষি ও ঋতুর সঙ্গে যুক্ত অনেক অনুষ্ঠান এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে।
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এরপর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন।