মাসখানেক হলো সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময়ে আলোচিত হচ্ছে যখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি দল ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্যাকেজের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৫৩ বছর ধরে রিপোর্টাররা অবাধে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। কখনো তাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। হঠাৎ করে রিপোর্টারদের প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে কেন? ব্যাংক খাতের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা ঢাকতে সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে বলে মনে করেন তারা। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা মনে করেন, নিষেধাজ্ঞা দেয়া ঠিক নয়। তথ্য পাওয়ার অধিকারের দিক থেকেও প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা অনুচিত। কারণ এতে ভুল সংবাদ প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন তারা। এদিকে বিশিষ্টজনদের মতে, নানা অনিয়ম ও বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি-গ্রুপ, স্বার্থান্বেষী মহল ও ব্যাংক পরিচালকরা এক হয়ে সাধারণ মানুষের আমানতের অর্থ লুটেপুটে খাচ্ছেন। এতে করে সংকটে পড়েছে দেশের আর্থিক খাত। দুর্বল হয়ে পড়েছে অনেক ব্যাংক।
এসব অনিয়মের বিচার না করে জনগণের অর্থ দিয়ে তাদেরই সহযোগিতা করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব তথ্য যেন গণমাধ্যমে না আসে তাই প্রভাবশালীদের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাসহ নিয়মের নানা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। সস্পর্শকাতর তথ্য গোপন রাখতে এ পদক্ষেপ কিনা তা নিয়েও আলোচনা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের অর্থের শেষ অবলম্বন বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এমন পদক্ষেপকে জনস্বার্থে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের তথ্য প্রকাশে গণমাধ্যমের পেশাগত দায়িত্ব পালনের পথে অভূতপূর্ব প্রতিবন্ধকতা উল্লেখ করে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে সাংবাদিকদের একাধিক সংগঠন। বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্টারদের নির্বিঘ্ন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে অর্থনীতি বিটের সংবাদকর্মীদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)।
এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লুটপাট ও দুর্নীতি লুকিয়ে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি-গ্রুপ, স্বার্থান্বেষী মহল ও ব্যাংক পরিচালকদের চাপে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মন্তব্য করেন এ বিটে কর্মরত সংবাদকর্মীরা। তারা দ্রুত এ ধরনের কালো সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে আগের মতো সাংবাদিক প্রবেশের অনুমতি দিয়ে আর্থিক খাতের অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ও ঋণ কেলেঙ্কারির সংবাদ প্রকাশের সহযোগিতা করার দাবি জানান। তারা বলেন, হলমার্ক, বেসিকের ঋণ জালিয়াতি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, অ্যাননটেক্সের ও ক্রিসেন্ট কেলেঙ্কারির মতো ব্যাংক খাতের বড় বড় অনিয়মের মাধ্যমে লাখ লাখ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এসব তথ্য সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়েছে। জনগণও এসব লুটপাটের তথ্য জানতে পেরেছে। তাই অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করার জন্য দেশ, জনগণ ও অর্থনীতির স্বার্থে সাংবাদিকদের প্রবেশের সুযোগ দেয়া জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া কোনোভাবেই ঠিক না। সাংবাদিকরা নিজেরাই বোঝে কোন তথ্য স্পর্শকাতর। প্রবেশ বন্ধ করা ভুল সংবাদ প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাই প্রবেশ একেবারে বন্ধ করা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, এখন থেকে সাংবাদিকরা ব্যাংকের নির্দিষ্ট অনুমতিপত্র (প্রবেশ পাস) নিয়ে শুধু মুখপাত্রের কাছে যেতে পারবেন। তবে কোনো কর্মকর্তা যদি সাংবাদিকদের পাস দেন, সেক্ষেত্রে তারা শুধু সেই কর্মকর্তার কাছে যেতে পারবেন। তবে আগের মতো তারা অবাধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো বিভাগে প্রবেশ করতে পারবেন না। অর্থাৎ সরাসরি না বলে সাংবাদিকদের প্রবেশে এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২৫শে এপ্রিল সাংবাদিকদের প্রবেশের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে দেখা করেছেন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। গভর্নর বিষয়টি সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে সময়ক্ষেপণের পদ্ধতি নেন। একইদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের না ঢুকতে দেয়ার প্রতিবাদে গভর্নর ভবনের নিচে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন ব্যাংকখাত নিয়ে প্রতিবেদন করা সাংবাদিকরা।
ব্যাংকিং খাতের রিপোর্টার ও দৈনিক সমকালের বিশেষ প্রতিবেদক ওবায়দুল্লাহ রনি বলেন, সাংবাদিকদের জন্য আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে অবাধ যাতায়াত ছিল। বর্তমানে সেখানে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এখন সাংবাদিকরা পাস ইস্যুর মাধ্যমে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কর্মকর্তার কাছে যেতে পারবেন। এর বাইরে অন্য কোথাও বা কোনো কর্মকর্তার কাছে যেতে পারবেন না। তিনি জানান, এর আগেও পাস ইস্যুর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেতরে অবাধ যাতায়াত ছিল। বর্তমানে তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ব্যাংক বিটের সাংবাদিকরা জানান, এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিসিপশন ডেস্কের রেজিস্ট্রার খাতায় একজন সংবাদকর্মী তার নাম, প্রতিষ্ঠানের নাম ও মোবাইল নম্বর লিখে স্বাক্ষর করে পাস ইস্যুর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রবেশ করতে পারতেন। গত ৫৩ বছর ধরে সংবাদকর্মীরা এ নিয়মেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রবেশ করছেন। কিন্তু গত এক মাস ধরে তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
অনেকের অভিযোগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যোগদানের পর থেকে দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সেগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখছে না, উল্টো দেশের মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এ ছাড়া তিনি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে এপর্যন্ত ডলার বাজারের অনিয়ম রোধে ব্যর্থ হয়েছেন। ঋণখেলাপি অন্য গভর্নরদের চেয়ে রউফ তালুকদারের সময় রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। রির্জাভও কমেছে রেকর্ড পরিমাণ। এসব বিষয়গুলো গণমাধ্যমে চলে আসায় তিনি সাংবাদিকদের প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করছেন। গভর্নর নিজের দুর্বলতাকে ঢাকতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সাবেক ব্যাংক বিটের সাংবাদিক ও চ্যানেল২৪-এর সিনিয়র রিপোর্টার আব্দুল কাইয়ুম তুহিন বলেন, এখন এমন কী ঘটলো যে বাংলাদেশ ব্যাংকের দরজাই বন্ধ হয়ে গেল সাংবাদিকদের জন্য! যেদিন ইসলামী ব্যাংকটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে সেদিনই তো এই দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে। এটাকে এখন লুটেরাদের সুযোগ সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবেই দেখা হয়, এ ছাড়া আর কিছুই ভাবে না এদেশের মানুষ। সাংবাদিক ঠেকানোর মধ্যদিয়ে চোর-ডাকাতদের পাহারাদারের ভূমিকায় নেমেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সাংবাদিক ঠেকিয়ে নয়, লুটেরাদের ঠেকান বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
manabzamin