বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ জনতা ব্যাংক

আর্থিক সূচক ও কর্মদক্ষতা উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংককে যে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটি তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, যা খুবই উদ্বেগজনক ঘটনা।

দেশের ৬১টি তালিকাভুক্ত বা তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে জনতা ব্যাংকের আমানত ও ঋণ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার বাণিজ্যিক ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নে খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়, খেলাপি ঋণের অনুপাত কমানো, মূলধন ভিত্তির উন্নয়ন, ঋণের প্রবৃদ্ধি, মুনাফা ইত্যাদি বিষয়ে কর্মদক্ষতা উন্নয়নের দ্বিবার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে আসছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফ-সাইট সুপারভিশন বিভাগের কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট অনুসারে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে জনতা ব্যাংক সব বিষয়েই কর্মদক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।

খেলাপি ঋণ অনুপাতের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রায়াত্ত চার ব্যাংককে প্রতিটির জন্য ঋণের সীমা বেঁধে দিয়েছে। তারপরও জনতা ব্যাংক এই সীমা অতিক্রম করেছে।

গত ৩০ জুন পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের ৬৪ শতাংশ ছিল বড় ঋণ। যদিও ব্যাংকটির বড় ঋণ  অথবা বড় গ্রাহকদের ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ছিল ৩০ শতাংশ।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ইচ্ছা করলেই বড় ঋণের পরিমাণ কমানো সম্ভব না।’

বড় আকারের ঋণের পরিমাণ কমাতে ব্যাংকটি পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে।

গত এপ্রিলে দায়িত্ব নেওয়া আব্দুল জব্বার আরও বলেন, ‘আমরা বড় ঋণগ্রহীতাদের নতুন ঋণ দিচ্ছি না। তাই আগামী মাসগুলোয় আমাদের ঋণের পরিমাণ বাড়বে না।’

সোনালী ব্যাংকের জন্য বড় ঋণের সীমা ছিল ৩৮ শতাংশ  কিন্তু ব্যাংকটির বড় ঋণের পরিমাণ ছিল সব ঋণের ৪৮ শতাংশ।

গত ৩০ জুন পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের বড় ঋণ ছিল মোট মোট ঋণের ৩৪ শতাংশ। এর সীমা ৩০ শতাংশ।

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গত দুই বছরে আমাদের ব্যাংক বড় কোনো ঋণ অনুমোদন করেনি।’

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মুরশেদুল কবীর ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের বড় ঋণের পরিমাণ বাড়ছে না। আমরা এখন আর বেঁধে দেওয়া সীমা ছাড়িয়ে বড় ঋণগ্রহীতাদের ঋণ দিচ্ছি না।’

তিনি জানান, ইতোমধ্যে যেসব ঋণ নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করেছে সেগুলো কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে অগ্রণী ব্যাংক।

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত আরও বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে আমাদের ব্যাংক বড় ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনছে।’

রূপালী ব্যাংকের বড় ঋণ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের আরোপিত ৩৪ শতাংশের মধ্যে।

গত ৩০ জুন পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের বড় ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ছিল ৬৭। এটি সবচেয়ে বেশি। এই ব্যাংকটির বেশিরভাগ গ্রাহক একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করেছে।

গত ১৪ নভেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সোনালী ব্যাংকের ২১ বড় ঋণগ্রহীতা ও ১৩ একক ঋণগ্রহীতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করেছে।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আফজাল করিম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের বড় ঋণগ্রহীতাদের বেশিরভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। তারা নিয়মিত ঋণ শোধ করছে।’

প্রতিবেদন অনুসারে, সোনালী ব্যাংকের ২১ বড় ঋণগ্রহীতার ১৭টিই সরকারি খাতের।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, অগ্রণী ব্যাংকের ৫৫ বড় ঋণগ্রহীতার ২০ জন একক গ্রাহক ঋণসীমা ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছেন।

গত ৩০ জুন পর্যন্ত রূপালী ব্যাংকের ৩৫ বড় ঋণগ্রহীতার ১০ জনের একক ঋণের পরিমাণ নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি ছিল।

জনতা ব্যাংকের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতাদের ১৭ জন খেলাপি।

জুনের শেষে বাকি তিন ব্যাংক মিলিয়ে ১৭ বড় ঋণগ্রহীতা খেলাপি হয়।

জনতা ব্যাংকের ১৭ বড় ঋণগ্রহীতার খেলাপির পরিমাণ ১০ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। এটি বাকি তিন ব্যাংকের মোট বড় ঋণগ্রহীতার ঋণের তুলনায় বেশি।

প্রতিবেদনে অনুমোদিত সীমার তুলনায় বেশি ঋণ নেওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বা যারা খেলাপি হয়েছেন তাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

কর্মদক্ষতা উন্নতির আরেকটি লক্ষ্য ছিল ব্যাংকটির শীর্ষ পাঁচ শাখায় ঋণের পরিমাণ কমানো।

সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের শীর্ষ পাঁচ শাখায় ঋণের পরিমাণ দুই শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে আনা গেছে। শীর্ষ পাঁচ শাখায় রূপালী ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ছয় মাস আগের মতোই ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে জনতা ব্যাংকের শীর্ষ পাঁচ শাখায় ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।

জনতা ব্যাংকের ৯৩ হাজার ৩৭১ কোটি টাকার মোট ঋণের ৭৭ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পাঁচ শাখা—লোকাল অফিস শাখা, জনতা ভবন কর্পোরেট শাখা, চট্টগ্রামের সাধারণ বীমা ভবন কর্পোরেট শাখা, দিলকুশা কর্পোরেট শাখা ও মতিঝিল করপোরেট শাখা থেকে।

বাকি ২৩ শতাংশ ঋণ বিদেশে চার শাখাসহ দেশের ৯১৭টি শাখার মাধ্যমে বিতরণ করা হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক শীর্ষ ২০ ও অন্যান্য খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণের টাকা আদায়ের জন্য আলাদা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে এবং তিন ক্যাটাগরির মধ্যে দুটিতে জনতা ব্যাংকের অবস্থান সবচেয়ে খারাপ।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার বলেন, ‘চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ঋণের টাকা উদ্ধার করা খুব কঠিন। আমাদের ব্যাংক পুনঃতফসিলের মাধ্যমে ঋণের একটি ভালো অংশ আদায় করেছে।’

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে নগদ আদায় হয়েছে ১৬ কোটি টাকা। এটি লক্ষ্যমাত্রার দুই শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকও শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে লক্ষ্যমাত্রার দুই শতাংশ আদায় করতে পেরেছে।

বছরের প্রথমার্ধে সোনালী ব্যাংক যে ২৬ কোটি টাকা আদায় করেছে তা শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে আদায়ের নয় শতাংশ।

রূপালী ব্যাংক শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে ৬৫ কোটি টাকা আদায় করেছে। এটি লক্ষ্যমাত্রার ১৯ শতাংশ। অন্যান্য খেলাপিদের কাছ থেকে আদায়ের ক্ষেত্রেও এটি সবচেয়ে ভালো করেছে। এই ব্যাংক ২৬৮ কোটি টাকা আদায় করেছে। এটি লক্ষ্যমাত্রার ৪৭ শতাংশ।

রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বছরের শেষ নাগাদ আমরা ভালো ফল দেখতে পারবো। কারণ ঋণের একটি বড় অংশ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ব্যাংক বড় ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ভালো পরিমাণ টাকা আদায় করেছে। এটি বড় ঋণের ঘনত্ব কমাতে সহায়তা করবে।’

জনতা ব্যাংক অন্যান্য খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার ১৭ শতাংশ পূরণ করতে পেরেছে। এটি চার ব্যাংকের মধ্যে সর্বনিম্ন।

তবে খেলাপি ঋণ থেকে নগদ অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকটি তুলনামূলকভাবে ভালো করেছে। এটি ২৮ কোটি টাকা আদায় করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার আট শতাংশ। সোনালী ব্যাংকও খেলাপি ঋণ থেকে টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার মাত্র আট শতাংশ আদায় করতে পেরেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুলোকে তাদের শ্রেণিবদ্ধ ঋণ কমানোর যে নির্দেশনা দিয়েছে সেখানেও জনতা ব্যাংকের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৮৭ দশমিক আট শতাংশ।

জুন শেষে ব্যাংকটির মোট ঋণের ৩২ দশমিক ছয় শতাংশ খেলাপি হয়েছে। এটি চার ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং অন্য তিন ব্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি।

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে রূপালী ও সোনালী ব্যাংক তাদের খেলাপি ঋণ যথাক্রমে ১২ দশমিক ৮৬ শতাংশ ও এক দশমিক ৩৭ শতাংশ কমাতে পেরেছে। অন্যদিকে, অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সাত দশমিক ১১ শতাংশ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের নতুন সমন্বিত ঋণের অন্তত ৫০ শতাংশ সিএমএসএমই, খুচরা ও অন্যান্য ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। সোনালী ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা ৪০ শতাংশ।

সোনালী ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করলেও বাকি তিন ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুরশেদুল কবীর বলেন, ‘এখন এসএমই ও কৃষি ঋণের ওপর বেশি মনোযোগ দিয়ে ঋণ বিতরণের ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছি।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রূপালী ব্যাংক ছাড়া বাকি তিন ব্যাংকের মূলধনের অবস্থা চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে খারাপ হয়েছে।

ব্যাংকগুলোর মূলধন ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ অনুপাত (সিআরএআর) কমপক্ষে ১০ শতাংশ হওয়ার কথা ছিল এবং সোনালী ব্যাংকের এই অনুপাত বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সীমা পূরণ করে না। তবে বাকি তিন ব্যাংকের অনুপাত কমেছে।

ডেইলি স্টার