বাংলাদেশ-ফ্রান্স সম্পর্কের কৌশলগত সমীকরণ

Nayadiganta|মাসুম খলিলী

– ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের উল্লেখযোগ্য কোনো ঐতিহাসিক সম্পর্কের বিষয় সেভাবে জানা যায় না। ব্রেক্সিটের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সর্বাধিক প্রভাবশালী দেশের একটি হিসেবে ফ্রান্সের গুরুত্ব কিছুটা বেড়েছে। আর ‘অকাস’ চুক্তির জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনের সাথে সৃষ্ট দূরত্ব ফ্রান্সকে ভবিষ্যৎ ইউরোপীয় নিরাপত্তা জোটের নেতায় পরিণত করতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। কিন্তু এটিই কি ফ্রান্সের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা তথা কৌশলগত সম্পর্ক সৃষ্টির আগ্রহপত্র স্বাক্ষর করার জন্য কারণ হিসেবে কাজ করেছে? এই আগ্রহপত্রের পথ ধরে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহে ফ্রান্স গুরুত্বপূর্ণ উৎস দেশে পরিণত হওয়ার কথা জানা যাচ্ছে। সেটি বাস্তবে ঘটে থাকলে এই ধরনের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক চীনসহ যাদের সাথে রয়েছে তার ওপর এর কোনো প্রভাব পড়বে কি না সেটিও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯ নভেম্বর থেকে থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত ফ্রান্স সফর করেন। ১৯৯৯ সালে তার প্রথম সফরের পর এটি শেখ হাসিনার দ্বিতীয় ফ্রান্স সফর। ফ্রান্সে থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ফরাসি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সাথে দেখা করেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, এই সফরের মধ্য দিয়ে ঢাকা ফ্রান্সের সাথে সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চায়। সেটি করতে হলে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স উভয়কেই তাদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে।

সম্পর্কের ইতিহাস
১৭ শতকে ফরাসি বণিকরা বাংলায় এলে তাদের সাথে যে যোগসূত্র তৈরি হয় সেটিই বাংলাদেশ-ফ্রান্স সম্পর্কের পুরনো কোনো ঘটনা। ইংরেজদের সাথে বৈরিতা থাকায় পলাশীর যুদ্ধে ফরাসিরা বাংলার শেষ সার্বভৌম নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে পাশাপাশি যুদ্ধ করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর উভয় দেশের মধ্যে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। ১৯৮৭ সালে দু’দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সম্পর্ক আরো মজবুত হয়। ১৯৯০-এর দশকে তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁ বাংলাদেশ সফর করেন। এরপর ১৯৯০-এর দশকে ফ্রান্স বাংলাদেশকে সেচ প্রকল্প ও বন্যা ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে। ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনা প্রথম বাংলাদেশী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফ্রান্স সফর করেন। ১৯৯৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দুই দেশের মধ্যে মন্ত্রীপর্যায়ের বেশ কয়েকটি সফরও হয়েছিল।

কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিকাশ লাভ করেছে। ফ্রান্স বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় রফতানি গন্তব্যগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশ মূলত সেখানে তৈরী পোশাক রফতানি করে। ফ্রান্স বাংলাদেশে খাদ্যপণ্য, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক দ্রব্য রফতানি করে থাকে। ২০২০ সাল নাগাদ, দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মূল্য ছিল ২.৭৬ বিলিয়ন ইউরো। ফ্রান্সে বাংলাদেশের রফতানি ছিল ২.৫২ বিলিয়ন ইউরো, আর বাংলাদেশে ফ্রান্সের রফতানি ছিল মাত্র ২৫০ মিলিয়ন ইউরো।

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বাইরেও রয়েছে দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক। ২০২০ সালে ফ্রান্স বাংলাদেশকে ১৫০ মিলিয়ন ইউরো মূল্যের কোভিড-১৯ ঋণ দিয়েছে। কোভিড ঋণের পাশাপাশি ফ্রান্সের বাংলাদেশে ৩৬৭ মিলিয়ন ইউরো মূল্যের একটি সবুজ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি প্রকল্প রয়েছে। তা ছাড়া, নারায়ণগঞ্জে একটি পানি উৎপাদন কেন্দ্র এবং লাফার্জ-সুরমা সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে ২৭৫ মিলিয়ন ইউরোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফরাসি বিনিয়োগ রয়েছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ফ্রান্স হাইটেক সেক্টরেও সহযোগিতা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ তৈরি করেছে ফরাসি কোম্পানি থ্যালেস। বর্তমানে থ্যালেস বাংলাদেশে এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নে কাজ করছে।

ফ্রান্সের উচ্চ-প্রযুক্তি পণ্য এবং প্রতিরক্ষা হার্ডওয়্যারেও দক্ষতা রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে, ফ্রান্সের স্টার্ট-আপগুলোর জন্য একটি চিত্তাকর্ষক ইকোসিস্টেম রয়েছে, যা ‘লা ফ্রেঞ্চ টেক’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের সাথে তাদের বর্তমান বাণিজ্য ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে ফরাসিদের বিবেচনা করার জন্য উচ্চ প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা বিক্রয় ভালো বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং ড্যাসল্ট অ্যাভিয়েশনের প্রেসিডেন্টের সাথে হাসিনার সাক্ষাৎকালে প্রস্তাব দেয়া হয় যে, এই দিকটিতে বিশেষ সহযোগিতা হতে পারে, কারণ ইতোমধ্যে ফ্রান্স বাংলাদেশকে রাফায়েল বিমান বিক্রির বিষয়ে আলোচনা করছে।

ফ্রান্সের ব্যাপারে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ধারণা সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক নয়। আফ্রিকার অনেক দেশের ফরাসি উপনিবেশের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে তেমনটি বাংলাদেশের নেই। তবে অতি সম্প্রতি ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ নবী মুহাম্মদ সা:কে চিত্রিত করা কার্টুন নিষিদ্ধ করতে অস্বীকার করেন এবং ইসলামকে বিশ্বসভ্যতার সঙ্কট হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি নিজ দেশে মুসলিম মেয়েদের জন্য হিজাব নিষিদ্ধ করেছেন এবং অনেক মসজিদ বন্ধ করে দেন। তার ইসলামফোবিক হিসেবে দেখা মন্তব্য ও কর্মকাণ্ডের পরে বাংলাদেশে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড গণবিক্ষোভে লক্ষাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করে। এ সময় কিছু সংগঠন ফরাসি পণ্য বয়কটের আহ্বানও জানায়।

নতুন ভাবনা ও যৌথ বিবৃতি
এখন দুই দেশের নেতারা বলছেন, গভীর রাজনৈতিক সম্পর্ক উভয় দেশকে তাদের উদ্দেশ্য অর্জনে সাহায্য করতে পারে, বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে। ফ্রান্সের নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল রয়েছে। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং উদীয়মান তাৎপর্যও পারস্পরিক সুবিধা অর্জনের জন্য দেশদ্বয়কে একত্রিত করতে পারে।

ফরাসি প্রেসিডেন্টের সাথে শেখ হাসিনার বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। হাসিনা ও ম্যাক্রোঁর এই যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে এবং সবার জন্য ভাগ করে নেয়া সমৃদ্ধিসহ একটি মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য ফ্রান্স এবং বাংলাদেশ একই দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করেছে।’

এই বিবৃতিতে বলা হয়, ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি সফরে উচ্চপর্যায়ের অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি, কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন এবং প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সমস্যাগুলো। আলোচনায় ফ্রান্স ও বাংলাদেশ তাদের কৌশলগত দিকনির্দেশনার জন্য নিয়মিত রাজনৈতিক পরামর্শের মাধ্যমে অংশীদারিত্বের বিকাশ করার কথা বলেছে। উভয় দেশ রাজনীতি ও কূটনীতি, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়সহ সব ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সঙ্কল্প পুনর্ব্যক্ত করেছে।

১৪ দফা সংবলিত যৌথ বিবৃতিতে ফ্রান্স এবং বাংলাদেশ তাদের অংশীদারিত্বের মধ্যে প্রতিরক্ষা এবং সুরক্ষা উপাদানকে আরো উন্নত করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। সেই লক্ষ্যে, উভয় দেশ সংলাপ জোরদার এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে সম্মত হয়েছে। তারা প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে সহযোগিতা বাড়ানোরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

বিবৃতিতে দুই দেশ সন্ত্রাসবাদ, তার সমস্ত রূপ ও প্রকাশ, বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে গুরুতর হুমকিগুলোর মধ্যে একটি বলে উল্লেখ করে যৌথভাবে সন্ত্রাস দমন প্রচেষ্টার জন্য সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত হয়।

উপরন্তু, ফ্রান্স এবং বাংলাদেশ ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে আদান-প্রদানের সুবিধার্থে এবং টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নীত করার লক্ষ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় সংযোগ জোরদার করতে সক্রিয়ভাবে অবদান রাখার লক্ষ্যে তাদের সহযোগিতা ও সংলাপ বাড়ানোর কথাও উল্লেখ করেছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য জাতিসঙ্ঘের সুপারিশে ফ্রান্স বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে শ্রম খাতে ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন বাংলাদেশের জমা দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে, ফ্রান্স এর ব্যাপক বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে। একই সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি রেগুলেশনের অধীনে উপযুক্ত বাণিজ্য পছন্দের সুবিধা গ্রহণসহ বাংলাদেশকে তার রফতানিমুখী প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য অর্জনে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে।

বিবৃতিতে দুই দেশ বাংলাদেশের ওপর রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে সৃষ্ট উল্লেখযোগ্য চাপের কথা উল্লেখ করেছে এবং উভয় দেশ বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসঙ্ঘের যৌথ পরিকল্পনার জন্য তহবিল নিশ্চিত করা এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিয়ানমারে তাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবর্তন সক্ষম করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে।

ঘোষণাপত্রে উভয় দেশই বাংলাদেশের সাথে ফরাসি উন্নয়ন সংস্থার (এএফডি) দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্বকে স্বাগত জানিয়েছে। ফ্রান্স বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পাশাপাশি সুনীল অর্থনীতি, জ্বালানি ও পানি খাতের জন্য অব্যাহত সমর্থন অব্যাহত রাখতে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। উভয় পক্ষই স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ এবং পানি শোধনাগারের ক্রেডিট-সুবিধা চুক্তি স্বাক্ষরকে স্বাগত জানিয়েছে।

ভারত-ফ্রান্স অংশীদারিত্বের প্রভাব
ফ্রান্স এবং ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঐতিহ্যগতভাবে ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ। উভয় দেশের একে অপরের সাথে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ রয়েছে। তা এতটাই গভীর যে, হাডসন ইনস্টিটিউটের একজন গবেষক ফ্রান্সকে ‘ভারতের নতুন সেরা বন্ধু’ বলে অভিহিত করেছেন। উভয় দেশের বাণিজ্য সম্পর্কের শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। ১৭ শতক থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত, ফ্রান্স ভারতীয় উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক উপস্থিতি বজায় রেখেছিল; পুদুচেরি (পন্ডিচেরি) ফ্রান্সের সাবেক ভারতীয় উপনিবেশ, যা ভারতে ফরাসি পর্যটকদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।

১৯৯৮ সালে কৌশলগত অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে, রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান পর্যায়ে নিয়মিত উচ্চস্তরের বিনিময় এবং প্রতিরক্ষা, পারমাণবিক কৌশলগত ক্ষেত্রগুলিসহ ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক বিনিময়ের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা এবং নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ারস গ্রুপ কর্তৃক প্রদত্ত মওকুফের পরে ফ্রান্সই প্রথম দেশ যার সাথে ভারত পারমাণবিক শক্তির বিষয়ে একটি চুক্তিতে প্রবেশ করে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং শিক্ষার মতো ক্ষেত্রেও ক্রমবর্ধমান এবং বিস্তৃত সহযোগিতা রয়েছে।

ফ্রান্স এবং ভারতের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কে সামরিক বিষয় ছাড়াও মহাকাশ এবং বেসামরিক পারমাণবিক শক্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক সহযোগিতা হয়েছে। ২০১১ সালের নভেম্বরে, নতুন দিল্লিতে ফাউন্ডেশন ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি রিসার্চ ভারতের কৌশলগত অংশীদারদের একটি তুলনামূলক মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে। এই মূল্যায়নে ৯০ পয়েন্টের মধ্যে ভারতের শীর্ষ কৌশলগত অংশীদারদের র‌্যাঙ্ক করা হয়েছে। এতে রাশিয়া ৬২ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে রয়েছে, তারপরে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৫৮), ফ্রান্স (৫১), যুক্তরাজ্য (৪১), জার্মানি (৩৭) ও জাপান (৩৪)।

ইন্দো-ফরাসি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তির অধীনে কাঠামোগত আলোচনার অধীনে শিল্প সহযোগিতা এবং পরিষেবা বিনিময়ের বিষয়ে বেশ কয়েকটি বৈঠক নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির অধীনে ভারতীয় এবং ফরাসি নৌবাহিনী একে অপরের নৌঘাঁটি ব্যবহার করতে সক্ষম হবে। ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ ভারত ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে ফরাসি ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। ২০১৮ সালে সিঙ্গাপুরে সাংগ্রি লা সংলাপে, ফরাসি এবং ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা ঘোষণা করেছিলেন, তারা চীনের সামরিক সম্প্রসারণকে চ্যালেঞ্জ জানাতে দক্ষিণ চীন সাগর দিয়ে যুদ্ধজাহাজ চালাবেন।

ফ্রান্সের সাথে ভারতের এই গভীর কৌশলগত অংশীদারিত্ব বাংলাদেশকে একই ধরনের অংশীদারিত্বে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রভাবিত করেছে।

নতুন সময় নতুন সমীকরণ
ফ্রান্সের সাথে বাংলাদেশের কৌশলগত সম্পর্ক তৈরির এই উদ্যোগের পেছনে নতুন এক সমীকরণ সক্রিয় রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারতের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে তার ভূরাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের কারণে। ভারতের উদ্বেগ হলো, দেশটির উত্তর পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই তার নিয়ন্ত্রক রাডারে রাখতে হবে। এই উপলব্ধি থেকেই গত এক দশকে বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সব ক্ষেত্রে দিল্লি প্রভাব বিস্তারের নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চেয়েছে।

এ ক্ষেত্রে ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতি হলো, বাংলাদেশের উন্নয়ন সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল ও প্রতিরক্ষা সমরাস্ত্র সরবরাহে সামর্থ্যরে অভাব। সাশ্রয়ী ও টেকসই সমরাস্ত্রের জন্য বাংলাদেশ বরাবরই চীনের ওপর নির্ভর করে এসেছে। ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সমরাস্ত্র এখনো চীন থেকে বাংলাদেশ নিয়ে থাকে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক ও জাপানসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিকল্প উন্নয়ন সহায়তা উৎস হিসেবে চীন উঠে এসেছে গত দুই দশকে। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে সৃষ্ট টানাপড়েনের পর ঢাকা উন্নয়ন সহায়তার জন্য চীনের উপরই নির্ভর করছে।

ভারতীয় নীতি প্রণেতারা দেখেছেন, এ দুটি কারণে বাংলাদেশে চীনা প্রভাব এতটাই শিকড় গেড়ে বসেছে যে, তা থেকে কোনোভাবেই ঢাকাকে দূরে সরানো যাচ্ছে না। গত এক দশকে ভারত বাংলাদেশকে কিছু কিছু প্রতিরক্ষাসামগ্রী সরবরাহের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তা বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর জন্য সেভাবে যুৎসই না হওয়ায় তা নেয়া হয়নি। সর্বশেষ, ভারতের তৈরি জঙ্গিবিমান বাংলাদেশকে অফার করার কথা জানা যায়; কিন্তু এ ব্যাপারেও খুব একটা সাড়া পাওয়া যায়নি। বরং বাংলাদেশ চীন থেকে জে-১০ জঙ্গিবিমান কেনার জন্য আলাপ-আলোচনা শুরু করে। এটাকে নিবৃত্ত করার জন্য ফ্রান্স থেকে রাফায়েল জঙ্গিবিমান কেনার প্রস্তাবে সম্মত করার জন্য ঢাকার ওপর দিল্লির প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টার কথা জানা যাচ্ছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ব্যাপারে যে আগ্রহপত্র ফ্রান্সের সাথে স্বাক্ষরিত হয়েছে তার পথ ধরে বিমান বাহিনীর জন্য আট থেকে ১০টি এই জঙ্গিবিমান ও নৌবাহিনীর জন্য একটি ডেস্ট্রয়ার কেনার বিষয়ে কথা হচ্ছে বলে জানা গেছে। আনুষ্ঠানিক বক্তব্যেও এ ধরনের ইঙ্গিত রয়েছে।

ভারতীয় বিমানবাহিনী দীর্ঘ দিন ধরে ফ্রান্সের মিরেজ ও রাফায়েল জঙ্গিবিমান ব্যবহার করে আসছে। এই দুই জঙ্গিবিমানের কিছু প্রযুক্তিও দিল্লিকে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ভারতীয় বৈমানিকদের দক্ষতা এখন যে পর্যায়ে তাতে বাংলাদেশ এই বিমান কিনলে এ জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান ও রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধা ভারতই দিতে পারবে। এতে করে জে-১০ জঙ্গিবিমান চীন থেকে না নেয়ার কারণে এক দিকে বেইজিংয়ের সাথে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাবাহিনীর যোগসূত্র ও নির্ভরতা কমবে; অন্য দিকে সেই শূন্যতা ফ্রান্সের মতো ভারতের কৌশলগত মিত্র এবং দিল্লি নিজেই পূরণ করতে পারবে।

ফ্রান্সের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশের চাপ ও পরামর্শ ছাড়াও সরকারের নিজস্ব কিছু হিসাব-নিকাশ রয়েছে। ২০১৮ সালের বিশেষ নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চাপ ছিল, এ দেশে দ্রুত একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের আয়োজন করা যেখানে সব দল অংশগ্রহণ করবে। ঢাকার পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক আশ্বাসও তখন দেয়া হয়েছিল। সেসাথে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু সমরাস্ত্র ও বিমান কেনার আগ্রহও দেখানো হয়েছিল। পরে এসব বিষয় আর সেভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্রকে একপ্রকার পাত্তা না দিয়ে চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করা হয়েছে।

বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার অঙ্গীকার পূরণে অগ্রসর হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্রচর্চাকারী দেশগুলোকে নিয়ে একটি বৈশ্বিক গণতন্ত্র সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এর মাধ্যমে আমেরিকা এই বার্তা দিতে চাইছে যে, বাংলাদেশ একনায়কতান্ত্রিকতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে তারা মনে করে এবং এ প্রক্রিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র অনুমোদন করবে না। বাংলাদেশে প্রশাসনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তির আমেরিকান ভিসা বাতিলের মাধ্যমেও এ ব্যাপারে ওয়াশিংটন বার্তা দিয়েছে। এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা ও বিধিনিষেধের আওতা সামনে আরো বাড়তে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিস্তৃত হলে বাংলাদেশের করোনা উত্তর বৈরী অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি হবে।

‘অকাস’ চুক্তির কারণে আমেরিকার ব্যাপারে বিক্ষুব্ধ, ফ্রান্সের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক নির্মাণ করতে পারলে দেশটি বৈশ্বিক ফোরামে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াতে পারে। বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়ন হলো, বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের সবচেয়ে বড় গন্তব্য। ইইউর যে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনকও হতে পারে। ফ্রান্স সহযোগিতা করলে এই ধরনের বিধিনিষেধ এড়ানো সম্ভব হতে পারে। কিন্তু এতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র কতটা বৈরী হয় সেটি দেখার বিষয়।

বর্তমান সরকারের একটি অনুসৃত কৌশল হলো, আন্তর্জাতিক সব পক্ষকে যথাসম্ভব খুশি রাখার চেষ্টা করা। যুক্তরাষ্ট্রের সন্তুষ্টি অর্জন বাইডেন প্রশাসনের এই সময়ে এসে ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। ফ্রান্সের সাথে নিরাপত্তা ও কৌশলগত সম্পর্কে নয়াদিল্লিও সন্তুষ্ট হবে। চীনকে সন্তুষ্ট করার জন্য তাদের কাছে এই বার্তা পৌঁছানো হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে যে, বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক প্রকল্পের ব্যাপারে কোনো বাধা প্রতিবেশী দেশের পক্ষ থেকে এলে তা ঢাকা শুনবে না। চীন বর্তমান সরকারের ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত বেশ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করছে। চীনা প্রকল্প সহায়তা করোনা-উত্তর অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটাতেও সহায়তা করছে। অবশ্য ফ্রান্সের সাথে নতুন সম্পর্ককে বেইজিং কিভাবে দেখবে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে।

কত দূর যাওয়া যাবে?
বর্তমান সরকার বৈশ্বিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবাইকে খুশি করে কতটুকু সামনে এগোতে পারবে, সেটি নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। রোহিঙ্গা ইস্যু ও বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশের ওপর কোয়াড প্লাস জোটে যোগদানের ব্যাপারে আমেরিকার চাপও রয়েছে। কিন্তু কোয়াড নিয়ে ভারতের সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগে বেশ অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। দিল্লি আকস্মিকভাবে রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে। এস৪০০ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছাড়াও অত্যাধুনিক সুখোই জঙ্গিবিমানসহ বেশ কিছু প্রতিরক্ষা যান কেনার জন্য মস্কোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে। আফগানিস্তান নিয়ে দিল্লি যে নিরাপত্তা সম্মেলন সম্প্রতি আয়োজন করেছে তাতে রাশিয়া তার মধ্য এশীয় প্রতিবেশী দেশগুলোকে সাথে নিয়ে যোগ দিয়েছে। অথচ ভারত এতে যুক্তরাষ্ট্রকে আমন্ত্রণই জানায়নি। এতে বুঝা যাচ্ছে, ভারত বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সাথে একধরনের ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইছে। এর অংশ হিসেবে কোয়াডে দিল্লি সক্রিয়তাকে যদি কমিয়ে আনে তার প্রভাব দক্ষিণ এশীয় পরিস্থিতিতে পড়তে পারে। আর সে প্রভাব থেকে বাংলাদেশও মুক্ত হবে না বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে ওয়াশিংটনের সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগ ও তৎপরতায়।

বৈশ্বিক সম্পর্কের টানাপড়েনের মাত্রা যা-ই হোক না কেন, বাংলাদেশকে একধরনের কঠিন ও জটিল সময়ের মধ্য দিয়ে সামনে এগোতে হবে বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে শুধু রাজনৈতিক শক্তিই নয়, একই সাথে রাষ্ট্রের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

[email protected]