বাংলাদেশ পরিস্থিতি : রণবীর সমাদ্দারের বিশ্লেষণ

mzamin

facebook sharing button

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়ে গেল। ব্যাপক সংঘর্ষ আর প্রাণহানির পর এখন কারফিউ চলমান রয়েছে। সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এ নিয়ে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন প্ল্যাটফরম একটি ভিডিও চিত্র নির্মাণ করেছে। যেখানে আন্দোলনসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। ভিডিওচিত্রে সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের অধ্যাপক রণবীর সমাদ্দারের। তিনি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া এই আন্দোলনকে জনবাদী অভ্যুত্থান হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

আনন্দবাজারকে রণবীর সমাদ্দার বলেন, আজকের যে স্বতঃস্ফূর্ত একটা অভ্যুত্থান, এটা কিন্তু স্বকীয়তা এবং স্বতন্ত্র আমাদের স্বীকার করতে হবে। এটার একদিকে একটা অতীত আছে। কিন্তু অন্যদিকে একটা নিজস্ব চেহারাও রয়েছে।

এটা কিন্তু রাজনৈতিক দিক দিয়ে ভাগাভাগি করলে চলবে না। ক্রমাগত পৃথিবী যেদিকে যাচ্ছে এটা কিন্তু একটা জনবাদী অভ্যুত্থান। এটা রাজনীতির কক্ষ থেকে রাজনীতির ভাগ্য নির্ধারিত হবে না। আলাপ- আলোচনার কক্ষ থেকে নির্ধারিত হবে রাস্তা। কে রাস্তা দখল করবে। এগুলো তার ফলে নতুন নতুন সেøাগানের জন্ম দিচ্ছে। এবং বাংলাদেশ সবসময় অনেক বেশি অভিনব সেøাগানের জন্ম দেয়। এই যে এদের কথা… কে বলছে রাজাকার সে হচ্ছে স্বৈরাচার। এগুলোর অনুরণন, এগুলোর যে ব্যাঞ্জনা- প্রচলিত ধারা সেগুলোকে উল্টে দিচ্ছে। যেটা আমি বলছিলাম, তুমি সমাজকে ভাগ করে রেখেছো, এখনও পর্যন্ত কে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে এবং কে নেয়নি। এই ভাগাভাগি করে এটাই যদি সমাজকে চালাতে চাও তাহলে তুমি বেশ, যেহেতু তুমি আমাকে আজ সমাজ থেকে বঞ্চিত করলে, চাকরি দিলে না- আমি তাহলে মেনে নিচ্ছি। আমি তাহলে রাজাকার। আমাকে গুলি মারো। কিন্তু বলছে কে রাজাকার, যে নিজে স্বৈরাচার। তাহলে তোমার বলার কি হক আছে? তোমার বৈধতা সরকারের কোথায়? এখন ছাত্র অভ্যুত্থানের এই যে চেহারা, আমাদের দেশের ছাত্র অভ্যুত্থানের চেহারা যেটা ৬৫ থেকে ৬৮, ৬৯ পর্যন্ত হয়েছে। 

নরসিংদী জেল থেকে কয়েদি বের হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি এটার কারণ যত না বলবো এর একটা ঐতিহাসিক পরম্পরা আছে, ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার আছে-  সেগুলো আমরা ইতিহাসের সবাই স্বীকার করি, বাংলায় লিখতেও ভালো লাগে। কিন্তু এর মূলটা হচ্ছে কনজাংচার, যে এমন একটা জাংচার যেখানে অনেকগুলো সময়, অনেকগুলো ঘটনা, প্রবণতা, অনেকগুলো পরম্পরা এক জায়গায় এসে হাজির হচ্ছে, তার ফলেই এই অভ্যুত্থানটা ঘটছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে চেয়েছে, আমাদের মনে করার কি কারণ আছে যে এর পেছনে জনসাধারণের সম্পর্ক ছিল?

ওখানে নির্বাচনটাও ক্রমাগত বৈধতা হারাচ্ছে। এবং সরকারের এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না যে, জনসাধারণের যে অসন্তোষ- এটাকে সম্মান দিচ্ছে না। অর্থাৎ রাজনীতিটা দলের ঊর্ধ্বে গিয়ে রাস্তায় গড়ছে এটা বিএনপি তৈরি করে দিয়েছে বা জামায়াত তৈরি করে দিয়েছে- এই যদি আমাদের রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা হয়, তাহলে সেই সরকারের মুখের উপর এসে বোমা ফেটে পড়ে তখন ভাবে এটা কি হলো। এটা তো একটা যুদ্ধ। ঘোষিত-অঘোষিত যুুদ্ধ। যে সামাজিক যুদ্ধটা বলতে পারো তোমার মাটির তলায় ছিল তা ফেটে বাইরে বেরিয়ে এসে পড়েছে। এর তীব্রতা তোমাকে হতচকিত করে দিয়েছে।
জনসাধারণের মধ্যে এই যে দু’টো ভাগ, মুক্তিযুদ্ধ কারা করেছে আর কারা করেনি, সেই ভাগটা একাত্তরের পর খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটা যুদ্ধের ভেতর থেকে যে সমাজ বেরিয়ে এসে পড়েছে। এবং আমরা ধরে নিতে পারি তারপরের কুড়ি বছরও এই ভাগটা কোনো না কোনোভাবে থেকে গেছে। সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার সপরিবারে নিহত হয়েছেন। সামরিক শাসক মারা গেছেন, সবই হয়েছে। কাজেই আমি ধরেই নিচ্ছি যে, এই ভাগটা হয়তো তখনো ছিল। যত সমাজটা এগোতে লাগলো এবং পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে তো এখন, চুয়ান্ন পঞ্চান্ন বছর হতে লাগলো। কাজেই এই ভাগটা সমাজের মধ্যে অনেকটা কমে গেছে।

আজকে তুমি আমি মুক্তিযুদ্ধের পরিবার বলে এসব সুযোগ আমার সেটা হয়তো সাধারণ সমাজ মেনে নাও নিতে পারে। একদলকে তুমি বললে রাজাকার আরেক দলকে তুমি বললে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের। এক সময় ভাগের একটা কারণ ছিল, কিন্তু এটা দিয়ে তুমি যদি সমাজের চিরকালের একটা ফাটল রেখে দাও সেটা হয়তো সমাজ চালানোর ক্ষেত্রে ঠিক রাস্তা নাও হতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি ধুঁকছে, এমন প্রসঙ্গে রণবীর সমাদ্দার বলেন, এখন সরকার হয়তো এর থেকে শিক্ষা নিতে পারে। আমি নিজে মনে করি, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী এটার একটা দোলাচলের মধ্যে আছেন। প্রধানমন্ত্রী আগে বেশকিছু ক্ষেত্রে সাহস দেখিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতার নিজস্ব একটা যুক্তি থাকে- ইদানীং সফল বৈদেশিক নীতি দিয়ে দেশ চালানো এটা চলে না। আমরা এতদিন অমৃতটা দেখেছিলাম। উৎপাদন বাড়ছে, এই বাড়ছে, আমরা এটা দেখিনি যে ধরনের শোষণ বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে মেয়েদের ক্ষেত্রে হচ্ছে, মেয়েরা তার প্রতিবাদ করছে, পুলিশ মারছে, সারা পৃথিবীতে আমেরিকানরা কতকিছু হইচই করছে। আজকে নড়ে-চড়ে বসেছে কেন? তার কারণ হচ্ছে- ওই হিংসা। নেমে গিয়ে দ্য স্ট্রিট স্পিচ, রাস্তায় কথা বলছে। কাজেই সরকার এখান থেকে একটা শিক্ষা নিতেই পারে। হয়তো যাবে না ওদিকে।

সাভার থেকে শুরু করে যে অত্যন্ত একটি শান্তিপূর্ণ গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেল- যেখানে দাবি করা হলো- যুদ্ধাপরাধী কিংবা সাম্প্রদায়িকতায় কোনো কিছুর সঙ্গে আমরা আপস করবো না। এক অর্থে আওয়ামী লীগ তাতে লাভবান হয়েছে। কিন্তু সেটা আবার বলছি এটা ছিল পথের সমাবেশ। দু’বছর আগে বাংলাদেশের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে মেয়েদের সঙ্গে যে লড়াইটা হলো পুলিশের। তুমি ফ্রান্সের সঙ্গে তুলনা করো ইয়েলো ফেস মুভমেন্ট, হলুদ কুর্তা বা পিট কুর্তা আন্দোলন এর পূর্বসূরি কারা?

বামপন্থিরা বলছে এটা বামপন্থি আন্দোলন না। লরি ড্রাইভাররা এই হলুদ কুর্তা আন্দোলন চালিয়েছিল। সারা ফ্রান্স বলেছে, কোনো বামপন্থিরা এর পক্ষে দাঁড়ায়নি। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনটিও হাসিনা সরকারের বিরোধিতার চেহারায় নিয়েছিল- এমন এক প্রসঙ্গে রণবীর সমাদ্দার বলেন, শাসন বিরোধী, ক্ষমতা বিরোধী মানে অন্তত এই শাসনের বিরোধী। এর মধ্যে হতে পারে যে, যারা বলবে আওয়ামী লীগ ভালো। অর্থাৎ এর একটা ধূসর চেহারা আছে। এটা সাদাকালো করতে যেও না। সেজন্য আমি বারবার বলছি, যে এটা জনবাদী অভ্যুত্থান।  ইটস অ্যা ভেরি ক্লাসিক পপুলিস্ট রাইজিং। কিন্তু পপুলার মানে এই নয় যে, এটা একটা আদর্শ দিয়ে বাঁধা আছে। কোনো বামপন্থি এটাকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ইনফ্যাক্ট এটা হয়তো নেতৃত্বহীন ওই অর্থে। এই যে একটা জনবাদী আন্দোলন, যে কারণে আমি কোটা আন্দোলনের কথা বললাম, ১৯৫২’র ভাষা বিদ্রোহের কথা বললাম- এটা যে সবসময় একটা বিরাট নকশালপন্থি, তাতো নয়। এটুকু বলতে পারি, এটা ঘটতই আজ বা কাল।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে মিশে আছে বিএনপি জামায়াত এবং রয়েছে ভারতবিরোধী স্লোগানও। এমন এক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি এ কথা বলতে পারি না যে, এটা কোনো বড় একটা সনদ বা দাবি সনদের দিকে যাবে। হয়তো যাবে না। কেননা কোনো রাজনৈতিক দল এটাকে চালাচ্ছে না। দাবি সনদ দেয়াটা অর্থাৎ আন্দোলনটাকে আরও প্রশস্ত করাটা বামপন্থিদের কৌশল। কিন্তু হয়তো সে রকম নেই। হয়তো সেটাই তার গুণ যে, এটা ফোকাস রাখতে পারে। এটার মধ্যে বাড়তি দাবি কিছু যোগ করবে না। কাজেই এই ছাত্র আন্দোলন থেমে যাবে। কিন্তু যে তুমি আমায় আজকে রাজাকার বলছো, তুমি কে তুমি তো স্বৈরাচার। এই যে সমাজকে ভাগ করে দিলো যে যুক্তিতে সেটাকে পুরোটা পাল্টে দেয়া। এটা তো আনথিংক্যাবল ইমাজিনেশন। এইভাবে যে ভাবা যায় আমরা তো কেউ ভাবিনি। ঠিক যেভাবে বলা যায় তুমি যদি আমাকে বলো আমি নিগার। ইয়েস আই অ্যাম নিগার।

manabzamin