বাংলাদেশের রাজনীতি বিশেষত অত্যাসন্ন দ্বাদশ নির্বাচন প্রশ্নে নিজ নিজ অবস্থান স্পষ্ট করেছে বন্ধু রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র এবং ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারত। গত ১০ই নভেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যায়ের যৌথ বৈঠকের (টু প্লাস টু ডায়ালগ) পর স্বতন্ত্র ব্রিফিং করেন ভারতের বিদেশ সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা। যদিও ওই বৈঠকের জয়েন স্টেটমেন্টে বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনার প্রসঙ্গটি ছিল পুরোপুরি অনুপস্থিত। বৈঠকে বাংলাদেশ ইস্যুতে নয়াদিল্লির বক্তব্যের জবাবে ওয়াশিংটন কী বলেছিল তার কিছুটা আভাস রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাঙ্ক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের রিপোর্টে। ১৭ই নভেম্বর প্রকাশিত ওই রিপোর্টে বলা হয়, নয়াদিল্লিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার টু প্লাস টু ডায়ালগের ফল বিশ্লেষণ করেছে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স। ডায়ালগে বিভিন্ন ইস্যুর পাশাপাশি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা হয়। বৈঠকে আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা হয়।
এতে নয়াদিল্লির প্রতিনিধিরা বলেন- বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা মন্তব্য করবে না ভারত। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর প্রসঙ্গে এই মন্তব্য আসে। বৈঠকে বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন উঠে। সেখানেই যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান স্পষ্ট করে।
ওয়াশিংটনের প্রতিনিধিরা জানান, বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং সহিংসতামুক্ত হওয়া উচিত। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের রিপোর্টের দাবি, এর পর এ নিয়ে কোনো পক্ষই কথা বাড়াননি বা মন্তব্য করেননি। তবে রিপোর্টে বলা হয়, বৈঠক থেকে আফগানিস্তানে মানবাধিকার সুরক্ষিত রাখতে তালেবানদের প্রতি যৌথভাবে আহ্বান জানান ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রীরা। আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা থেকে বিরত থাকার আহ্বানও জানান তারা। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের রিপোর্টে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যকার টু প্লাস টু ডায়ালগে দুই দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে ছিল ইন্দো-প্যাসিফিকের নিরাপত্তা, ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ, ইউক্রেন যুদ্ধ, যৌথ প্রতিরক্ষা উদ্যোগ বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব জোরদারের গুরুত্ব এবং গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন। রিপোর্টে বলা হয়, যদিও এই ডায়ালগ ঐক্যবদ্ধ একটি ফোরাম হিসেবে মনে করা হয়েছিল, তবুও মিটিংয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু চ্যালেঞ্জের পূর্বাভাস ছিল। বৈঠকে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র নিজ অবস্থানে অনড় ছিল।
ফলে বৈঠকের পরও তাদের মতপার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। এই আলোচনায় বিষয় উঠতে পারে বলে পূর্বাভাস ছিল। ভারত-কানাডার মধ্যে চলমান কূটনৈতিক ফাটলের বিষয়টি বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে তা-ও অনুমেয় ছিল। মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যস্ততা সত্ত্বেও এই ডায়ালগ বন্ধ করতে আগ্রহী নয় দুই পক্ষ। এতে তাদের সম্পর্কের গুরুত্বের প্রতিশ্রুতি ফুটে উঠে।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স আরও লিখেছে, এই মিটিংয়ের কেন্দ্রীয় এজেন্ডা ছিল অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক বজায় রাখার চেষ্টা। এক্ষেত্রে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র শুধু তাদের প্রতিশ্রুতিই পুনর্ব্যক্ত করেনি, বরং এখানে চূড়ান্ত করা হয়েছে সিকিউরিটি অব সাপ্লাই অ্যারেঞ্জমেন্ট (এসওএসএ)। এর উদ্দেশ্য দুই দেশের মধ্যে স্বাধীনভাবে সরবরাহ চেইনকে শক্তিশালী করা। পাশাপাশি রয়েছে ২০২৩ রোডম্যাপ ফর ইউএস-ইন্ডিয়া ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো-অপারেশন। এর ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং যৌথভাবে উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে। উপরন্তু দুই দেশ যৌথভাবে সাঁজোয়া পদাতিক যান তৈরি শুরু করতে সম্মত হয়েছে। আলোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল গাজা ও ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ।
বৈঠককালে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধের একটি রাজনৈতিক সমাধানে যৌথ সমর্থন ঘোষণা করেছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। উভয় দেশই মানবিক কারণে যুদ্ধ বিরতি এবং ওই অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সঙ্গে কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনা তথা সহযোগিতা চালিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। গাজায় নিরীহ ফিলিস্তিনিদের প্রতি মানবিক সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উভয়পক্ষ। ইউক্রেন যুদ্ধে যে মানবিক সংকট স্পষ্ট হয়েছে তাতে পারস্পরিক অভিন্ন উদ্বেগ তুলে ধরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। লক্ষণীয় বিষয় হলো- এই যুদ্ধে দুই পক্ষই একই রকম অবস্থান নিয়েছে। সামাজিক পরিণতিসহ এই যুদ্ধের অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন তারা। ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিকদের জন্য মানবিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র।
চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। প্রকাশ্যে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন যে, চীনের আগ্রাসন মোকাবিলায় একমত হয়েছেন তারা। শেষে সেমি-কন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহীর বিষয়ে অংশীদারিত্ব বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। সেমি-কন্ডাক্টর উৎপাদন খাতে সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছেন অ্যান্টনি ব্লিনকেন। তিনি দুই দেশের শিক্ষা বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন।
ব্লিনকেন বলেন, এই সহযোগিতা আংশিকভাবে অর্জন করা যেতে পারে ভারতীয় অভিবাসীদের ভিসার জন্য অপেক্ষার সময় কমিয়ে আনার মাধ্যমে। এ ইস্যুটি ভারত সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, আগের বৈঠকের সিদ্ধান্ত মতে এবারের ৫ম টু প্লাস টু বৈঠকের হোস্ট ছিল নয়াদিল্লি। আগের চতুর্থ বৈঠকটি ওয়াশিংটন হোস্ট করেছিল। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের যৌথ নেতৃত্বে ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন। আর ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং।
রুটিন এবং স্ট্রাকচার্ড ফর্মেটে বছরান্তে টু প্লাস টু বৈঠক হলেও এবারের আয়োজনে ভিন্নমাত্রা ছিল। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের রিপোর্ট মতে, বৈশ্বিক নিরাপত্তা নিয়ে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে দুই দেশ, তার প্রেক্ষিতে এই ডায়ালগ ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাক্ষাতের আনুষ্ঠানিক ফলোআপ। দুই নেতা চলতি বছরেই দু’দফা (জুনে এবং সেপ্টেম্বরে) বৈঠকে মিলিত হন।
মানব জমিন