শেখ হাসিনার রাজনৈতিক মৃত্যু এবং কূটনৈতিক পতন মোদি সরকারের জন্য একটি বড় ধাক্কা। ১৫ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকাকালীন হাসিনার সঙ্গে সব কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, শক্তি এবং সম্পদ বিনিয়োগ করার পরে হঠাৎ এমন পালাবদলে অনেকটা সিদ্ধান্তহীনতা এবং বেকায়দায় পড়ে যায় নয়াদিল্লি। তবে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ায় নয়াদিল্লি কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে।
ড. ইউনূসের একটি আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি রয়েছে এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দুই বলয়ের কাছাকাছি। তিনি এখন পর্যন্ত সঠিক বার্তা সবাইকে পাঠিয়েছেন, এই অস্থায়ী সরকারের অধীনে সংখ্যালঘুরা নিরাপদ। সেইসঙ্গে অনেকটা উৎকণ্ঠায় থাকা হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শনে যান তিনি এবং আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের বিষয়ে জনগণকে আশস্ত করেন। তবুও, নতুন পরিস্থিতি নয়াদিল্লিতে উদ্বেগ ও অনিশ্চিয়তা রয়েই গেছে যে ইউনূস দীর্ঘমেয়াদে এসব নিশ্চিত করতে পারবেন কিনা।
ভারতের উদ্বেগ অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে যতটা নয়, তার চেয়েও বেশি পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে কোন দল ঢাকায় ক্ষমতার মসনদে বসবেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং বিশেষ করে বিএনপির জোটভুক্ত দলগুলো পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর প্রভাববলয়ে রয়েছে বলে মনে করে নয়াদিল্লি, যারা ভারতের জাতীয় স্বার্থের সম্পূর্ণ বিরোধী এবং বিদ্বেষী।
‹নয়াদিল্লি এখন বাংলাদেশে একটি ভয়ঙ্কর কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এবং সম্পর্কটি দ্রুত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে,› এমনটি বলেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত অনিল ওয়াধওয়া।
বাংলাদেশের নতুন প্রেক্ষাপটে জামায়াত ইসলামীর সরব উপস্থিতি, যারা স্বাধীনতারবিরোধী ছিল এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছিল, তা ভারতের জন্য চরম উদ্বেগের বিষয়। ২০০১ সালে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি।
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের অদম্য সমর্থনের কারণে আওয়ামী লীগবিরোধীদের মাঝে যে তিক্ততা এবং ক্ষোভ জন্মেছে তা সামাল দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা মোদি সরকারের জন্য সহজ হবে না। এ প্রসঙ্গে সাবেক কূটনীতিক রাজীব ভাটিয়া বলেন, ‹এটি ধীরে ধীরে করতে হবে, ধাপে ধাপে।›
ভারতের পার্লামেন্টে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের বাংলাদেশ নিয়ে বিবৃতি নিয়ে ঢাকায় হতাশা দেখা দিয়েছে। জয়শঙ্করের বিবৃতিতে পুলিশের হাতে নিহত বিক্ষোভকারীর সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি করার অনুমতি নাকচ করার জেরে হাসিনা সরকার উৎখাতের শিকার হয়েছে। তাই সরকার পতনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন ভারতে আশ্রয় নেয়া শেখ হাসিনা। তবে নিজের ত্রুটিগুলো স্বীকার না করে বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপকে দোষারোপ করা দক্ষিণ এশিয়ার নেতাদের একটি পুরোনো অজুহাত। অতীতে ইন্দিরা গান্ধী প্রায়ই ‹বিদেশি শক্তির ইন্ধনের অভিযোগ তুলেছিলেন। ইমরান খানও অনাস্থা ভোটে হেরে যাওয়ার পরে যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করেছিলেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আউটলুক ইন্ডিয়ায় সম্প্রতি প্রকাশিত সীমা গুহার নিবন্ধে এমন সব পর্যালোচনা উঠে এসেছে।
এর আগে, ও পি জিন্দল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা আছে। ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি হলেন প্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্ব। তাকে দেখে তারা উদ্বুদ্ধ হন। শ্রীরাধার মতে, ইউনূসকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছেন শেখ হাসিনা। ভারতের সঙ্গে হাসিনা ও আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিতে ড. ইউনূসই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বিকল্প।
সাবেক আইপিএস কর্মকর্তা শান্তনু মুখোপাধ্যায় কর্মসূত্রে একসময় বাংলাদেশে ছিলেন। এই সুরক্ষা বিশেষজ্ঞও বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ড. ইউনূসই সবচেয়ে ভালো বিকল্প। শান্তনু মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ড. ইউনূস পশ্চিমা বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। ছাত্ররাও তাকে চাইছেন। সেনাবাহিনীর কাছেও তিনি গ্রহণযোগ্য। তিনি ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারবেন।
এই আইপিএস কর্মকর্তা বলেছেন, তবে অধ্যাপক ইউনূসের সামনে সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে সহিংসতা বন্ধ করা। সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা। প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত রায় চৌধুরীও মনে করেন, নোবেলজয়ী ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তিনিই বর্তমান পরিস্থিতিতে সেরা বিকল্প। তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও দেশের ভেতরে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ভারতের কাছেও তিনি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
inqilab