- সালিম সাফি
- ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০৬:৩১
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। সেই মুহূর্তে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহেনা দেশের বাইরে ছিলেন। আল্লাহ হয়তো তাদের দু’জনকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন শেখ মুজিবের উত্তরসূরী বানানোর জন্য। শেখ হাসিনা ছাত্র অবস্থাতেই রাজনীতিতে যুক্ত হন। একই সাথে মাঠের রাজনীতি শেখার যেসব স্তর রয়েছে, সেগুলো ভালোভাবে অতিক্রম করেন। তিনি নিজে যেমন জেলে গিয়েছেন, ঠিক তেমনি অসংখ্য মানুষকে জেলে পুরেছেন।
যেভাবে হোক শেখ হাসিনা অন্তত চারবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত অর্থনীতির দেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দাবি করেছিল তার সরকার- এসব কারণে কিছু দিন বহু মানুষের বাহবা ও প্রশংসা কুড়াতে সমর্থ হন শেখ হাসিনা।
একসময় বাংলাদেশে তিনি বেশ গ্রহণযোগ্য ছিলেন, ছিল তার প্রচুর জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের মানুষ দেশের উন্নয়ন ও উন্নতির প্রশংসা করছিল। কিন্তু শেষমেষ এমন হলো, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয়- শেখ হাসিনা জনগণের সেবার পরিবর্তে স্বীয় চাওয়া ও ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে নির্ধারণ করলেন। তার মধ্যে অহংবোধ বাসা বাঁধল। তিনি জনগণের সমস্যা দূরী করার বদলে বিপরীত মতের মানুষদের দমনে মনোযোগী হন এবং একই সাথে তাদের প্রতি প্রতিহিংসার ও প্রতিশোধের যে আগুন তার মধ্যে ছিল, তা দমাতে বলপ্রয়োগকে প্রাধান্য দিলেন; জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করলেন। বেগম খালেদা জিয়ার মতো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকেও জেলে ঢুকান। সমালোচকদের কণ্ঠ রোধ করেন। এমনকি গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির মতো কাজও করেন শেখ হাসিনা। ১৫ বছরের শাসনামলে তিনি নিজের ক্ষমতা সবদিক থেকে সুরক্ষিত করেন। কিন্তু সর্বশেষ কোটা পদ্ধতি তার ক্ষমতার সূর্য অস্তমিত করার কারণ হলো, যা তার নিজের কিংবা অন্যকারো কল্পনার ও ধারণারও বাইরে ছিল।
একইভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে কার্যত প্রভাবহীন করে ফেলেছিলেন শেখ হাসিনা। তবে ধুলো তো ঠিকই কোনো না কোনো ছিদ্র দিয়ে বের হবে, ফলে রাজনৈতিক নেতাদের বদলে মাঠে নামলেন শিক্ষার্থীরা। তারা কোটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা শুরু করলেন। কোটা সিস্টেমে বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ সংরক্ষিত ছিল আর মাত্র ৪৪ শতাংশ বরাদ্দ ছিল মেধাবীদের জন্য। যখন শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলেন, শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিলেন তাদের কঠোরভাবে দমনের। নিজের রাজনৈতিক পীড়নকে বৈধ করতে তিনি আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ আখ্যায়িত করলেন আর এই ভুল তার গলার কাটা হয়ে উঠল; বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের অন্যতম স্লোগান হয়ে উঠল- ‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার- স্বৈরাচার’।
এ পরিস্থিতির পর শেখ হাসিনা আরো কঠোর হলেন, বললেন, তারা আন্দোলনকারী নন; বরং সন্ত্রাসী। তার নির্দেশে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো শুরু করে। এতে বহু মানুষ হতাহতের শিকার হন। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলো বুঝতে পারল যে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের সাথে রাস্তায় নেমে পড়েন। এবং তাদের থেকে প্রকাশ হতে শুরু করে বিগত ১৫ বছরের ক্ষোভ।
এ পরিস্থিতি দেখে শেখ হাসিনা দেশজুড়ে কারফিউ জারি করেন। তবে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যরা সংবাদ সম্মেলন করে সেনাবাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে না দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। এক দিন আগে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি না ইস্তফা দেবেন, না আন্দোলনকারীদের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখাবেন! কিন্তু ৫ আগস্ট সোমবার যখন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান বললেন যে, তারা দেশের জনগণের সাথে থাকবেন- এতে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এবং দেশ থেকে পালাতেও বাধ্য হন। তিনি দেশ ছাড়ার আগ মুহূর্তে একটি ভিডিও বার্তা দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সে সুযোগ তাকে দেয়া হয়নি। ফলে তিনি তার পছন্দের দেশ ভারতে পালালেন। এভাবে তার ১৫ বছরের দীর্ঘ শাসনকালের ইতি ঘটল।
শেখ হাসিনা ওয়াজেদের পরিণতি থেকে যে কেউ অন্তত তিনটি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন-
এক, ক্ষমতার পেশিশক্তি ও রাজনৈতিক পীড়নের মাধ্যমে কিছুকাল হয়তো জনগণকে দাবিয়ে রাখা যাবে কিন্তু এভাবে খুব বেশি দিন দমিয়ে রাখা যায় না।
দুই, জনগণের কল্যাণের বদলে যেসব শাসক নিজের ক্ষমতা বিরোধীদের দমনে ব্যবহার করেন, তাদের শেষ পরিণতি ভালো হয় না।
তিন, যুবসম্প্রদায় এ যুগের আসল শক্তি। যদি কোথাও বেশির ভাগ যুবসমাজ কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাদের ঠেকানো অসম্ভব। এতে অনেক সময় বড়দেরও তাদের অনুসরণ করা অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
লেখক- পাকিস্তানি কলামিস্ট।
লেখাটি পাকিস্তানের জিও নিউজে (উর্দু ভার্সন) প্রকাশিত
বেলায়েত হুসাইন অনূদিত