বাংলাদেশে শক্তিশালী সিন্ডিকেট এবং দূর্নীতি

সহ্য করতে না পারলে পড়বেন না। এড়িয়ে চলুন। লেখাটা অনেকের জন্য খুব অপছন্দের। অনেকেই লেখার মর্ম বুঝবেন না। রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকলে তার পক্ষে হজম করাও কঠিন।
দূর্নীতি বাংলাদেশের সৃষ্টির পর থেকে আজ অবধি ধ্রুবক। এমন কোন শাসনামল আমরা দেখিনি যখন দূর্নীতি ছিলনা। সামরিক শাসন, বেসামরিক শাসন সব আমলেই দূর্নীতি ছিল বাংলাদেশের উত্থানের প্রধান অন্তরায়।
যারা ভাবছেন অমুক না থেকে অমুক থাকলে দূর্নীতি থাকত না দেশে, তারা বোকার স্বর্গে আছেন। অথবা তাদের গোল্ডফিস মেমরি। আমরা খুব দ্রুত ভুলে যায় দূর্নীতির ঘটনা গুলি। আর সমালোচনা করলে শুধুমাত্র আমরা রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের করি। বলতে রাজনৈতিক ব্যাক্তিরাই বিভিন্ন শাসনামলে দূর্নীতির সমালোচনার প্রধান লক্ষ্য বস্তু। কথা হল রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ কি দূর্নীতি করেনা? আলবাত করে।
কিন্তু এই সমালোচনার আড়ালে একটি পক্ষ সমালোচনার উর্ধে থেকে যায়। যাদেরকে আমরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখি। কারা এরা?
দূর্নীতিবাজ আমলা এবং সিন্ডিকেটের কথায় বলছি। আওয়ামীলীগ ক্ষমতা ছাড়লে আসবে বিএনপি, বিএনপি ছাড়লে আসবে আওয়ামীলীগ বা অন্য দল। পালাবদল সেই যুগ যুগ ধরেই আমরা দেখতেছি। কিন্তু দূর্নীতি বন্ধ হয়েছে?
একটু মাথা ঠান্ডা করে ভেবে দেখুন। মন্ত্রী, প্রতি মন্ত্রী, রাজনৈতিক দল, ক্ষমতা পালাবদল হয়। কিন্তু আসল ক্ষমতায় যারা তারা অপরিবর্তিত থেকে যায়। মন্ত্রী পরিবর্তন হলেও মন্ত্রনালয়ের দূর্নীতিবাজ আমলারা পরিবর্তন হয়না। কিছু হলেই জনরোসে পড়ে আমরা মন্ত্রীদের পদত্যাগ চাই। কিন্তু আমলাদের পদত্যাগ চাইনা।
এই আমলারা ক্ষমতার পালাবদলে ভোল পালটে একেক সময় একেক রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারন করে। কিন্তু ধ্রুবক ঠিকি থেকে যায়।
একটি মন্ত্রণালয়ে প্রধান কাজ কিন্তু আমলাদের। দূর্নীতি, বটির দাম ১০ হাজার, পর্দার দাম লাখ টাকা এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু সুন্দর করে প্রস্তুত করে আমলারাই। পরে সেগুলা দূর্নীতি গ্রস্থ মন্ত্রী এমপিদের কাছ থেকে পাশ করিয়ে সাবার করার দায়িত্বেও থাকে আমলারা। এই আমলাদের বিরুদ্ধে আমরা কখনো একমত হতে পারিনি। এদেরকে কখনো সমালোচনা করতে পারিনি।
অনেক মন্ত্রণালয় রয়েছে যেখানে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মকর্তার ঢাকায় ৮-১০ টা ফ্লাট রয়েছে। বড় পদের কর্মকর্তাদের রয়েছে দেশে বিদেশে বিশাল সম্পদ। কিন্তু এদেরকে আমরা সাধারন জনগণ অন্ধের মত এড়িয়ে চলি।
এই আমলাদের সবাই খারাপ? অবশ্যই না। মাহবুব কবির মিলন স্যারের কথায় ধরা যাক অথবা ধরা যাক বানসুরী স্যারের কথা। দূর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যেয়ে বানসুরী স্যার বাংলাদেশ বিমানের অনেক পরিবর্তন আনতে পেরেছিলেন। এতে অনেকের টাকা কামানোর রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলাফল কি হল? তাকে বিমান থেকে প্রত্যাহার করা হল। মিলন স্যার খাদ্য ডিপার্টমেন্ট এর পর রেল খাতে দায়িত্ব পেয়েই আমুল পরিবর্তনের জন্য প্রচেষ্টা করলেন। বন্ধ করলেন টিকিট নিয়ে কালোবাজারি। বন্ধ হল নিয়োগ বাণিজ্য, যাত্রী হয়রানি। ফলাফল কি হল? তাকে করা হল ওএসডি। চমৎকার।
রেলের সামনে ১৫ হাজারের বিশাল নিয়োগ আসত। সেখানে হয়ত শত কোটি টাকার ভাল বাণিজ্য থেকে বঞ্চিত হত মিলন স্যার থাকলে। তাহলে কি করতে হবে? তাকে যেভাবেই হোক সরাতে হবে।
এদেশে একটা ওপেন সিক্রেট আছে। কেউ উপরি আয় বন্ধের তোড়জোড় করলে দূর্নীতিগ্রস্থ অন্য আমলারা প্রয়োজনে চাঁদা তুলে উপর মহলের উদর পূর্তী করিয়ে হলেও তাকে বদলি করে দেয়। এই শক্তিশালী আমলাতান্ত্রিক সিন্ডিকেট নিয়ে আমরা জনগণ খোজ ও রাখিনা সমালোচনাও করিনা। তারাও জানে এটা। দূর্নীতির বিরুদ্ধে সমালোচনার টলারেন্স সবথেকে বেশি রাজনীতিবিদদের। মজার ব্যাপার হল তাদের গায়ে লাগেনা। এর কারন তাদের বিরুদ্ধে আনীত যেকোন মামলায় বিরোধীদল (যে দল বিরোধীদলের ভূমিকায় থাকুক) এটাকে রাজনৈতিক মামলা হিসাবে চালিয়ে দিতে পারে। বোকা জনগণের বিশাল অংশ ভক্ত হিসাবে বিশ্বাস ও করতে চায়না তাদের প্রিয় নেতা একটা পাক্কা দূর্নীতিবাজ। আর এজন্যই রাজনীতিবিদদের দূর্নীতির যতই সমালোচনা করা হোক এতে তাদের যায় আসেনা।
মাঝে আড়ালে থাকে এই সিন্ডিকেট যারা কোন প্রকল্পের এস্টিমেশন থেকে শুরু করে প্রোকিউরমেন্ট, ইমপ্লিমেন্টেশন সবকিছুর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রক। এমনকি অডিট ও এই আমলারা করেই সন্তোষজনক সার্টিফিকেট দেয়। রাস্তা তৈরির এক মাসের মধ্যে ভেঙে গেলেও মোটা অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেশনে থাকে রাস্তা নির্মাণ সন্তোষজনক। ভেবে দেখেছেন কখনো?
এর থেকে মুক্তির উপায় কি? মুক্তির কোন উপায় নেই। কারন আমলা বা সরকারী কর্মকর্তাদের দূর্নীতির সাথে যুক্ত হলে শাস্তি হিসাবে জনগণকে দেখাতে তাকে বদলি করা হয়। বছর খানেক পর সে আবার তার উপার্জিত কষ্টার্জিত দূর্নীতির টাকা ঢেলে আবার ভাল এলাকায় বদলি নিবে। আপনি আমি খবরো রাখব না। আপনারা কি জানেন? যেখানে পয়সা বেশি সেখানে বদলি পাওয়া কতটা প্রতিযোগিতাপূর্ণ? এর জন্য লবিং লাগে। লাগে টাকা ছড়ানোর ক্ষমতা। লাগে উপর মহলে অংশ বিশেষ পৌছে দেয়ার যোগ্যতা। তাহলে কিভাবে করবেন দূর্নীতি দমন।
এই রাজনৈতিক দল ক্ষমতা ছাড়বে অন্য দল আসবে। অন্য দল ক্ষমতা ছাড়বে আরেক দল আসবে। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা যাদের হাতে তারাতো ক্ষমতা ছাড়েনা। তাদের তো নির্দিষ্ট দল নেই। তাদের সিন্ডিকেট টিকিয়ে রেখেছে তাদের। দানবে পরিণত করেছে তাদের। আর এই দানব সব সময় আপনার আমার চক্ষুর আড়ালে থাকে।
আমলাদের ভেতর যাদের ভাল এবং সৎ থাকার সাহস রয়েছে তারাও একটা নির্দিষ্ট সময় পর গড্ডালিকায় ভেসে যেতে বাধ্য হয়। কতদিন সুস্থ থাকবেন আপনি। অনেক ক্ষেত্রে এমন হয় যে আপনি সরাসরি না নিলেও আপনার টেবিলে অর্থ চলে আসবে। এসব কিছু ছাপিয়ে দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে কিছু সৎ কর্মকর্তা টিকে যায়। মিলন স্যার, বানসুরী স্যারের সাথে যেমনটি হয়েছে তাদের সাথেও তেমনটি হয়। শুধু আপনি আমি জানিনা। আমাদের জানার সুযোগ থাকেনা। এজন্য সমালোচনাও থাকে না।
এই দূর্নীতি বন্ধ করতে গেলে প্রথম এবং একমাত্র কাজ হল আইন পরিবর্তন। অসৎ কর্মকর্তাদের শাস্তি হিসাবে বদলি করা বন্ধ করতে হবে। চাকরিচ্যুত করতে হবে। সবার মাঝে একটা সাধারন ধারনা আছে যে সরকারি চাকুরী নিরাপদ। চাকুরী যায়না। এই ধারনা দুর্নীতিকে আরো উৎসাহিত করেছে। এজন্য বিন্দুমাত্র প্রমাণ পেলে তাকে বদলি বা সাসপেন্ড করার আইন বাতিল করে অব্যাহতি দেয়ার আইন করতে হবে। সেই সাথে দূর্নীতির সাথে যুক্ত কর্মকর্তার পরিবারের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। পরিবারের সম্পদ কেন বাজেয়াপ্ত করার কথা বলছি? কারন এরা নিজেদের নামে সম্পদ বানায় না। এরা বউ, ছেলে, মেয়ে, শ্যলক, শ্যালিকার নামে সম্পদের পাহাড় গড়ে। এই মেসেজ পৌছে দিতে হবে যে আপনার চাকুরী নিরাপদ নয়। সৎ পথে থাকতে বাধ্য করতে অসততার উত্তম শাস্তি বিধান ছাড়া উপায় নেই।
বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক সিন্ডিকেটের বাইরে আরেক ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট আছে। এরা হল ব্যাবসায়ী সিন্ডিকেট। এই দুই সিন্ডিকেটের সংযোগ বেশ গভীর। এই ধরুন টেন্ডার দিবে পর্দা কেনার। টেন্ডার পাইয়ে দিতে ভাল এমাউন্ট ব্যয় করবে এই সিন্ডিকেট। আবার মনে করুন এন-৯৫ মাস্ক দেয়ার বদলে নকল মাস্ক দিবে। কিছুই বলতে পারবেন না। বললেই আপনার বিরুদ্ধে একশন। কারন এর সাথে যে কাজ পাইয়ে দিয়েছে তার স্বার্থ যে জড়িত। দুজন দুজনার। কি করবেন আপনি আমি?
রোজার আগে চিনি, ডাল, ছোলা সহ নিত্য দ্রব্যের দাম বাড়বে এটা আমাদের মুখস্ত হয়ে গেছে। নিয়ন্ত্রন শক্তিশালী সিন্ডিকেটের। কেউ সাহস করেনা এদের বিরুদ্ধে কিছু বলার।
দম্ভের সাথে বলতে শুনবেন মন্ত্রী এমপি তাদের পকেটে থাকে। লিটারালি পকেটেই থাকে। মন্ত্রীদের থেকে এদের ক্ষমতা কোন অংশে কম নয়। মন্ত্রীর মন্ত্রীত্ব খেয়ে দেয়ার যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে এই সিন্ডিকেটের। কারন কি জানেন? মন্ত্রীর পক্ষে একদল সমর্থক থাকলেও তার বিপক্ষে আছে আরেকদল। কিন্তু এই সিন্ডিকেটের ভেতর কোন দলাদলী নেই। এরা এদের যায়গায় একতাবদ্ধ। কেউ ভাঙতে চাইলে তাকেই উল্টা ভেঙ্গে যেতে হয়। এদের সমালোচনার সাহস মিডিয়ার ও নাই। মিডিয়ার অনেক গুলির মালিক ও এরাই। কোন দিকে যাবেন?
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এদেশের মানুষের রক্তে। তাজা রক্তে। সেই রক্তের উপর দাঁড়িয়ে এরা এদেশের ক্ষতি করছে আমরা নিরব। আমাদেরকে বুঝতেও দেয়া হয়না যেন কেন দুর্নীতি দমন কমিশন করেও দমনের ছাতাটাও হয়না অল্প কিছু অভিযান ছাড়া। আজ সাহস করে এদের বিরুদ্ধে লিখলাম। জানিনা কপালে কি আছে। তবে এদেশে সত্যের জয় হবেই। দূর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জনগণ সোচ্চার হয়ে এদেশের মাটি আবার পবিত্র হবে সেই কামনা করি।
আর ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এদেশটার জন্য খারাপ লাগে। এত অর্জন সব বিসর্জন হয়ে যাচ্ছে এই সিন্ডিকেটের জন্য।
Image may contain: sky, outdoor and water
3.1K
335 Comments
537 Shares
Like
Comment
Share

Comments

Most Relevant